Features

পিতা নাম দিয়েছিলেন পাহাড়ী, দরাজ গলায় গাইতেন ঠুংরি

পাহাড়ী সান্যালের সঙ্গে শিশুশিল্পী হিসাবে কাজ করেছিলেন শঙ্কর ঘোষ। মেকআপ রুমে বসে তাঁর সঙ্গে কাটানো সময় নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন ‘বাদশা’ ছবির মাস্টার শঙ্কর

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়। পুজোর ঠিক আগে। টালিগঞ্জের অতি প্রাচীন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়ো। ঢুকে একেবারে কোণের দিকের ফ্লোরে শিল্প নির্দেশক সুনীল সরকারের হাতযশে লোকাল ট্রেনের সেট পড়েছে। অপূর্ব সেট। যে ছবির জন্য এই সেট, তার নাম ‘মায়াবিনী লেন’। পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায়। ‘মায়ার সংসার’, ‘আশায় বাঁধিনু ঘর’, ‘আকাশ প্রদীপ’-এর মতো হিট ছবি উপহার দিয়েছেন কনকবাবু। তিনি আমার বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তাই বন্ধুপুত্র হিসেবে ওই ছবিতে নায়ক নির্মলকুমারের ছোটবেলার ভূমিকায় তিনি আমাকে নির্বাচন করেন।

সেদিন ছিল ছবির প্রথম দিনের শুটিং। রাতভর কাজ হবে। তার কিছুকাল আগেই ‘বাদশা’ ছবির দৌলতে শিশুশিল্পী হিসেবে মাস্টার শঙ্কর নামে আমি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলাম। কিন্তু কোনওদিন রাতে শুটিং করতে হয়নি। ‘মায়াবিনী লেন’ ছবিতেই প্রথম রাতে শুটিং করলাম। দৃশ্যটা ছিল লোকাল ট্রেনে গান গেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে পয়সা রোজগার করে পেট চালায়, এমন এক কিশোরের। গানটা ছিল ‘তোমরা বলো কু ঝিকঝিক চলছে ছুটে রেলের গাড়ি’। গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায়, গায়িকা আরতি মুখোপাধ্যায়। যেসব যাত্রী ট্রেনের কামরায় রয়েছেন তাদের মধ্যে একজন পাহাড়ী সান্যাল (Pahari Sanyal), সংসারের চাপে যিনি গানবাজনার জগত থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। অথচ গানবাজনা তাঁর অত্যন্ত প্রিয়।

আরও পড়ুন: ‘ছবি পরিচালনার জন্য এখনও প্রস্তুত নই’

সেদিনই প্রথম আলাপ হলো পাহাড়ীবাবুর সঙ্গে। ফ্লোরের লাগোয়া একখানা মেকআপ রুমের পাশাপাশি বসে আমি আর পাহাড়ী সান্যাল। যেহেতু সেই সময় আমি শিশুশিল্পী ছিলাম, তাই শুটিংয়ে সবসময় আমার বাবা বিনয়কুমার ঘোষ পাশে থাকতেন। সেদিনও বাবা আমার সঙ্গে রাতভর শুটিংয়ে ছিলেন।

পরিচালক বাবার সঙ্গে পাহাড়ী সান্যালের আলাপ করিয়ে দিলেন। তিনি ‌অবাক হয়ে আমার বাবাকে বললেন, ‘আপনি শঙ্করের বাবা? আমি ভাবছিলাম দাদা!’ প্রথম আলাপেই এই যে তারিফ, পরে দেখেছি এটা পাহাড়ীবাবুর চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রশংসা করা, বাহবা দেওয়া, তারিফ করার ব্যাপারে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে এই বিষয়টি যেখানে একেবারেই নেই।

আরও পড়ুন: ‘সুচিত্রা সেন সুন্দরী নয়, ফটোজেনিক ছিল’

মেকআপ নেওয়ার ফাঁকে-ফাঁকে অনেক কথা, অনেক আলাপ হলো। উনি গল্পবাজ, গল্প করতে খুবই ভালোবাসেন। সুন্দর একটি বাক্সে লখনউয়ের নানা ধরনের জর্দা রাখতেন। জর্দা দিয়ে পান খাচ্ছেন, খোশমেজাজে আছেন, সুরভি ছড়িয়ে পড়ছে মেকআপ রুমে। যেহেতু বাবার সময়কালে পাহাড়ী সান্যাল অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন, তাই দু’জনের মধ্যে গল্প জমে উঠল। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার নাম পাহাড়ী সান্যাল হলো কীভাবে?’ উত্তরে পাহাড়ীবাবু বললেন, ‘আমার আসল নাম নগেন্দ্রনাথ। জন্মেছিলাম দার্জিলিয়ে। পাহাড়ে জন্মেছিলাম বলে বাবা নৃপেন্দ্রনাথ ডাকনাম দিয়েছিলেন পাহাড়ী। পরে সব কাজে ওই ডাকনামই ব্যবহার করেছি। পরবর্তীকালে সেটাই আসল নাম হয়ে গেল।’

ফ্লোরে ঢুকলাম। ক্যামেরায় ছিলেন দিব্যেন্দু ঘোষ। গানটার টুকরো-টুকরো অংশের শুটিং হলো। লাইট জ়োন যখন তৈরি হচ্ছে, তখন আমরা আবার মেকআপ রুমে বসলাম। গল্পের ফাঁকে-ফাঁকে টুকরো-টুকরো ধ্রুপদ ধামারের অংশ গলায় ভাঁজছিলেন পাহাড়ীবাবু। এরও যেন কোনও তুলনা নেই! মনে আছে, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিষয়ে বাবা তাঁকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি খুব সুন্দরভাবে এর কারণ বর্ণনা করেছিলেন, ‘স্কুলজীবনে লখনউয়ের বাসিন্দা ছিলাম। প্রতিবেশী ছিলেন কবি অতুলচন্দ্র সেন। তাঁর সংস্পর্শে এসেই গানের প্রতি আকর্ষণের শুরু। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলাম। কিন্তু মাথার মধ্যে ছিল গান। ফিরলাম লখনউতে। মরিস কলেজে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করলাম। সেই সময় কত গুণী মানুষের কাছে গান শিখেছি। শিখেছি উস্তাদ মহম্মদ হোসেন, নাসির খাঁ, ছোটে মোল্লা খাঁ, আহমদ খাঁয়ের কাছে। খেয়াল, ঠুংরি শিখেছি। তবলা শিখব না তাই কখনও হয়? তবলা শিখলাম রাসবিহারী শীল আর আবিদ খাঁয়ের কাছে।’

আরও পড়ুন: ‘ময়লা কাপড়টাও বদলে নিতে দিল না বুড়ো’

কথার মাঝে-মাঝে মেকআপ রুমে বসে দরাজ গলায় টুকরো-টুকরো ঠুংরি শোনাচ্ছিলেন। মন্ত্রমুগ্ধ হতে থাকল বাকিরা। গোটা ঘরের পরিবেশটাই অন্যরকম হয়ে গেল।

আমাদের সময়ে বাবা-মায়েরা সাধারণত সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন না। যদিও বা নিয়ে যেতেন, তা হতো ধর্মমূলক, জীবনীমূলক বা ছোটদের কোনও ছবি। সেই হিসাবে পাহাড়ী সান্যালকে প্রথম দেখি কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত ‘বিদ্যাসাগর’ চবিতে। তিনিই ছিলেন নামভূমিকায়। বিদ্যাসাগরের তেজ, ব্যক্তিত্ব, করুণা পাহাড়ীবাবুর অভিনয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। যদিও পরবর্তীকালে তাঁর অভিনীত অসংখ্য ছবি দেখেছি, তবু মনে দাগ কেটেছিল ‘বিদ্যাসাগর’।

আরও পড়ুন: ‘এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে’

অভিনয়ের সূত্রেই বাবা তাঁর কাছে জানতে চাইলেন কীভাবে তিনি ছবির জগতে এলেন। পাহাড়ীবাবু বললেন, ‘এক বন্ধুর কাছে চিঠি নিয়ে হাজির হলাম নামকরা পরিচালক দেবকীকুমার বসুর কাছে। দেবকীবাবু আমাকে নিয়ে গেলেন বীরেন্দ্রনাথ সরকারের কাছে। বীরেন্দ্রনাথ তখন নিউ থিয়েটার্সের সর্বেসর্বা। বীরেন্দ্রনাথ আমাকে নিউ থিয়েটার্সের শিল্পী হিসেবে বেছে নিলেন। তখনকার দিনে ₹১৫০ মাইনে। নায়ক-গায়ক হিসেবে নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে তৈরি ‘মীরাবাঈ’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করলাম।’

বাবা আর আমার উৎসাহ আরও বাড়তে লাগল। উনি তখন অতীতে ডুব দিয়েছেন। ফের শুরু করলেন, ‘১৯৩৩ সালে চিত্রা (পরে ‘মিত্রা’ হয়) হলে মুক্তি পেল ‘মীরাবাঈ’। প্রথম ছবিতেই দেখেছিলাম দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনা দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, অমর মল্লিকের মতো শিল্পীদের। ছবিটা হিট হয়ে গেল।’ পাহাড়ী সান্যালের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

আরও পড়ুন: ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে আর ভাবছেন না সত্যজিৎ

গল্পে ছেদ পড়ল। ডাক পড়েছে। আবার ফ্লোরে প্রবেশ করলাম। শুটিং শুরু হলো। গানের পিকচারাইজ়েশন হয়ে যাওয়ার পর এবার সংলাপের পালা। সংলাপের সময় তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোথায় থাকি, বাড়িতে কে-কে আছেন, এসব কথা। যখন জানলেন আমি অনাথ, রেলগাড়িতে গান গেয়েই দিন চালাই, তখন তিনি জোর করে আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। সেদিনের শুটিং এই পর্যন্ত ছিল।

‘মায়াবিনী লেন’ ছবিতে তাঁর সঙ্গে আরও পাঁচদিনের কাজ ছিল। সবই ইন্ডোরে। সবই ইন্দ্রপুরীতে। আরও একটা গান ছিল আমার লিপে ওই ছবিতে। ‘শ্যামবাজারের শ্যামসুন্দর করবে চলো বিয়ে’। ছবিতে পাহাড়ী সান্যালের স্ত্রীর ভূমিকায় ছিলেন অপর্ণাদেবী। তাঁরা ছবির নায়িকা সুলতা চৌধুরীর বাবা-মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সুলতার ছোটবেলার ভূমিকায় ছিল মিতা দেবরায়। আমি আর মিতা পুতুলের বিয়ে দিচ্ছি, দৃশ্যটি এমন ছিল। পল্লীর অন্যরাও সেখানে হাজির।

আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্কটে বাংলা ছবি, উদ্বিগ্ন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা

‘মায়াবিনী লেন’-এর সূত্র ধরেই পাহাড়ী সান্যালের মতো দাপুটে অভিনেতার কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৯৬৬ সালের ৬ মে রাধা, পূর্ণ, লোটাসে এ ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ছবির প্রেস শো হয়েছিল ‘রাধা’তে। ইভনিং শো ছিল। ওই শোতে অবশ্য পাহাড়ী সান্যাল আসেননি। পরিচালক রাতে তাঁর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে পার্টি দিয়েছিলেন। অনেকেই এসেছিলেন। সেখানে আবার দেখা পাহাড়ীবাবুর সঙ্গে। সেই হাসি এতবছর পরেও স্মৃতিপটে অমলিন হয়ে আছে।

এর বছর দেড়েক পরে আবার পাহাড়ী সান্যালের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলাম। ছবির নাম ‘বৌদি’। কনকবাবুর সহকারি পূর্ণেন্দু রায়চৌধুরি প্রযোজক। পরিচালক দিলীপ বসু। প্রচুর শিল্পী ছিলেন এই ছবিতে। নামভূমিকায় সন্ধ্যারানি। তাঁর স্বামীর চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ওদের ছেলে চন্দনের চরিত্রে ছিলাম আমি। দেওরের চরিত্রে অনিল চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রেমিকার চরিত্রে লিলি চক্রবর্তী। প্রেমিকার বাবা-মা ছিলেন পাহাড়ী সান্যাল ও পদ্মা দেবী। পাড়াতুতো এক মামার চরিত্রে অনুপকুমার। ছিলেন বিকাশ রায়ও। এ ছবির শুটিং হয়েছিল রাধা ফিল্ম স্টুডিয়েতে। সেই স্টুডিয়ো এখন আর নেই, তৈরি হয়েছে ‘চলচ্চিত্র শতবার্ষ ভবন’। মেকআপ রুমে ফের পাহাড়ী সান্যালের সঙ্গে দেখা। 

আরও পড়ুন: আর্ট ফিল্ম মানে শুধুই যৌনতার ছড়াছড়ি, ক্ষুব্ধ ঋত্বিক

‘বৌদি’ ছবির শেষ দৃশ্যের মজার ঘটনাটি জীবনে ভুলব না। তখন আমার বাড়ন্ত বয়স। লম্বায় বাড়ছি। অনেকদিন গ্যাপ দিয়ে দিয়ে শুটিং হয়েছিল। ফলে কন্টিনিউটি ব্রেক করছিল বারবার। সিনেমার শুটিংয়ে আগের দৃশ্য পরে এবং পরের দৃশ্য আগে, এমনটা হয়েই থাকে। লম্বায় আমি অনুপকুমারের থেকে ছোট ছিলাম। কিন্তু শেষ দৃশ্যের টেকিংয়ের সময় দেখা গেল তাঁর থেকে আমি অনেকটাই লম্বা হয়ে গিয়েছি। তা হলে কী করা যায়? নানা মুনির নানা মত। অনুপকুমার মত দিলেন, শঙ্কর হাঁটু গেড়ে আসার মতো ঢুকুক। এ কথা শুনে সবাই বললেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। তখন মোক্ষম সমাধানের পথ বাতলে দিলেন পাহাড়ী সান্যাল। ‘এক কাজ করো। শঙ্কর দরজা দিয়ে ঢুকেই মায়ের (সন্ধ্যারানি) কোলের কাছে এসে বসে পড়ুক। পরে একে-একে কালী, বিকাশ, অনিল, অনুপ, লিলি, প্রবেশ করবে।’

পাহাড়ী সান্যালের এই কথা সবার মনে ধরল। সেই মতো শেষ দৃশ্যটি টেক হলো। ছবি মুক্তির পর দৃশ্যটি দেখে বুঝতে পারলাম যুক্তিটা কতখানি বাস্তবসম্মত ছিল। ‘বৌদি’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৮ সালের ২৭ নভেম্বর রাধা, পূর্ণ, অরুণা প্রেক্ষাগৃহে।

টেকনিশিয়ন্স স্টুডিয়োর স্কোরিং রুমে ফাইনাল প্রোজেকশন যখন দেখতে বসেছি তখন ফের পাহাড়ী সান্যালের সঙ্গে দেখা। ছবি দেখতে বসে মাঝে-মাঝেই ‘ওয়াহ-ওয়াহ’ বলে চলেছেন। এই ছবিতে আমার লিপে একটি গান ছিল: ‘জুতি পালিশওয়ালা বাবু জুতি পালিশওয়ালা’। প্রণব রায়ের কথায় রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে গানটি গেয়েছিলেন শিপ্রা বসু। ছবি দেখার পর এই গানে সুন্দরভাবে লিপ দেওয়ার জন্য পাহাড়ী সান্যাল আমার প্রশংসা করেছিলেন। এত বছর পরেও এই ভালোলাগা কথাগুলো মনে গেঁথে রয়েছে।


Edited and Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *