Features

জটায়ু একশো (পর্ব ২)

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

কমলেন্দু সরকার: কানপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। অসংখ্য রেলযাত্রীর ভিড়ে জটায়ু বা লালমোহন গাঙ্গুলি আসছে। চোখেমুখে হালকা উৎকণ্ঠার ছাপ। জটায়ু যখন তার নির্ধারিত কম্পার্টমেন্টটি খুঁজে পেল তখন বিশ্বজয়ের হাসি। এবার কুলিকে নিয়ে কম্পার্টমেন্টে প্রবেশ। তার হালচাল দেখে ওই কম্পার্টমেন্টের সকলেই তার প্রতি মনোযোগ দিল। কুলির সঙ্গে কথোপকথনে বোঝা গেল মানুষটি বেশ ইন্টারেস্টিং।

‘তং মত করো, তং মত করো। কাফি হো গয়া, জাদা হো গয়া। যাও-যাও,’ কথাগুলো বলেই তারপর মাছি তাড়াবার মতো করে ভঙ্গি করে জটায়ু। এটা তার প্রথম সংলাপ নয়। তার আগে তিনি কুলিকে সাবধানে মালপত্র নিয়ে ঢুকতে বলল। মাঝে পরিচালক টুক করে জটায়ুকে দিয়ে বলিয়ে নিলেন সুটকেসটি ‘জাপানি হ্যায়, ইমপোর্টেড।’ এই একটি কথাতেই বোঝা গেল, কম্পার্টমেন্টে নবাগত ভদ্রলোকটি একেবারে মাছেভাতে টিপিক্যাল বাঙালি!

আরও পড়ুন: ‘পচা দুর্গন্ধ ছড়ালে, প্রতিবেশীরাই এসে দাহ করবে’

কম্পার্টমেন্টে জটায়ুকে পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সন্তোষ দত্ত সেই সুযোগ নিলেন এবং সফলও হলেন। ব্যাপারটা এমন, তিনি অভিনয়ে একটা ধারা আনলেন, কমেডি কিন্তু কমেডিয়ান নন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল একটি বাক্যের শেষ শব্দটি ধরে তার নির্যাস চারিত করা। সেটা কেমন অবশ্যই জানতে ইচ্ছা করে।

যেমন, তোপসে বলে, ‘আপনার অনেক লেখা পড়েছি।’

জটায়ু বলে, ‘পড়েছ? কী পড়েছ?’

‘সাহারায় শিহরন।’

‘শিহরন।’

‘হন্ডুরাসে হাহাকার।’

‘হাহাকার।’

‘বোর্নিওর বিভীষিকা।

‘বিভীষিকা। বাহ!’

তোপসে আর জটায়ুর এই কথোপকথন দর্শক বেশ উপভোগ করেন। এখনও করেন। তোপসের কথার শেষটা ধরে রিপিট করা, সাদাচোখে দেখলে হয়তো মনে হতে পারে কিছুই নয়। তবে ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যাবে ওই সিচুয়েশনের একটা দ্যোতনা তৈরি হয়, ভাল লাগাটা হয় বাড়তি পাওনা।

আরও পড়ুন: ‘কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করে না, কি রে খেয়েছিস?’

এইরকম একটা দৃশ্য এর আগে পেয়েছিলাম ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে নবীন মাস্টারের কথায়।

সন্তোষ দত্ত (Santosh Dutta) অভিনয় করার সময় নানারকম ইম্প্রোভাইজ় করতেন—এখনকার কথায় নিজস্ব ইনপুট—বলে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সন্দীপ রায়। সন্দীপের কথায়, “নিজের চরিত্রটি নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা করতেন। ফোন করে অনেক সময় বাবাকে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আমি কি আমার এই চরিত্রটির মধ্যে এই বিষয়টি যোগ করতে পারি?’ এরকম আর কী। আর শুটিংয়ে বাবা যখন একটা টেকের পর আরও একটা সেফটি-টেক নিতেন তখন দ্বিতীয়বার টেকের সময় একটু অন্যভাবে অভিনয় করতেন। এবং তা ভীষণ পছন্দ করতেন বাবা। বাবা তো রীতিমতো সমস্যায় পড়ে যেতেন সন্তোষদার অভিনীত কোন দৃশ্যটি রাখবেন আর কোনটা ফেলবেন। আসলে, বাবা সন্তোষদাকে অভিনয়ে খুব স্বাধীনতা দিতেন। উনি বুঝেছিলেন, এই অভিনেতাটি চরিত্র নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা করে সেটে আসে। একটু ছাড় দিলে নিজে থেকেই অভিনয়ে নানা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার যোগ করতে পারবে।”

তপন রায়ের ‘সাতাত্তর বছরের বাংলা ছবি’ অনুযায়ী, ‘পথ নির্দেশ’ (১৯৫৩) দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে সন্তোষ দত্তের অভিনয়জীবনের শুরু। সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশ পাথর’ নয়।

আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’

সন্তোষ দত্তের নাটকের বা অভিনয়ের হাতেখড়ি তাঁর পিতৃদেব পূর্ণচন্দ্র দত্তের কাছে। তিনি ছিলেন নাট্যরসিক, অভিনেতাও। সন্তোষ দত্তের যখন পাঁচ-ছয় বছর বয়স তখন তাঁর বাবা অফিস থেকে ফিরে নাটক পাঠ করাতেন। সেইসব নাটক বেশিরভাগই ছিল গিরিশ ঘোষের। সন্তোষ দত্তের পিতার নাটকের বইয়ের সংগ্রহও ছিল প্রচুর। গিরিশ ঘোষের কোনও নাটকের দুটি চরিত্র বেছে নিয়ে তাঁরা পাঠ করতেন। অভিনয় করতেন।

একবার সন্তোষ দত্তের পিতা পুত্রকে বলেছিলেন, ‘ভাল অভিনয় করতে হলে মেয়েদের চরিত্র করবি।’ বাবার কথামতো কিছু নাটকে তিনি তাই করেছিলেন। তখন তিনি কলেজের ছাত্র। নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘মাটির বাড়ি’ নাটকে তন্দ্রার চরিত্রে অভিনয় করে সোনার মেডেল পান সন্তোষ দত্ত। এটি ছিল তাঁর অভিনয়জীবনের প্রথম পুরস্কার। এরপর আরও কয়েকটি নাটকে মেয়েদের চরিত্র করার পর তাঁর পিতৃদেব বলেন, ‘তোমার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন ঘটেছে এখন থেকে আর কোনও নারী চরিত্রে অভিনয় করো না।’ এরপর তিনি আর কোনওদিন নারী চরিত্রে অভিনয় করেননি। সন্তোষ দত্ত তাঁর বাবাকে বরাবরই অভিনয়ের শিক্ষাগুরু মানতেন।

আরও পড়ুন: ভোজপুরী ছবি করতে চলেছেন ঋত্বিক ঘটক

সিনেমায় অভিনয় করার ফাঁকেই সন্তেষ দত্ত প্রোফেশনাল থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন। ‘নটনটী’, ‘বিষ’ ছিল তাঁর বাণিজ্যিক থিয়েটারের প্রথম দিকের নাটক। পরবর্তী সময়েও বহু নাটক করেন। উনি মনে করতেন, নাটকে সংলাপের গতি নিয়ন্ত্রণ জানাটা খুবই প্রয়োজনীয়। ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নাটকের পরিচালকও ছিলেন। সেই নাটকে পরিচারকের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন।

সন্তোষ দত্তের মতো অভিনেতা খুব কমই এসেছেন অভিনয়জগতে। কী সিনেমা, কী নাটক! সবচেয়ে বড় ব্যাপার, উত্তম-সুচিত্রার মতোই অত্যন্ত জনপ্রিয় জুটি হল ফেলুদা-জটায়ু। বাঙালির প্রিয় জুটি। অথচ ফেলুদা-জটায়ু খুবই বেমানান একটি জুটি। ফেলুদা অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ, তার মগজাস্ত্র কাজে লাগায়। যা সে একবার বলেছিল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে। রিভলবার ছাড়াও তার আরও একটি অস্ত্র আছে। নিজের মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে বলেছিল, ‘মগজাস্ত্র।’ সবমিলিয়ে চৌকস বাঙালি।

আরও পড়ুন: বাক্স বদল সৌমিত্র-অপর্ণার

ওদিকে লালমোহনবাবু বা জটায়ু ছিল গড়পড়তা বাঙালির আবেদন। সরল, শান্ত, বোকাসোকা মানুষ। তার মুখেই শোনা যায়, গড়পারের লোক। একেবারে পুরনো উত্তর কলকাতা। আর ফেলুদার কাছে জটায়ু ঠিকানা চাইলে জানা যায় সে রজনি সেন রোডের বাসিন্দা, অর্থাৎ দক্ষিণ কলকাতার। মিল বলতে জটায়ু গোয়েন্দা উপন্যাস লেখেন আর ফেলুদা করেন গোয়েন্দাগিরি। তোপসে ওদেরর দু’জনের মধ্যে একজন হয়ে যায়। ফেলুদা, জটায়ু আর তোপসের মধ্যে ছিল মনের মিল। ফেলুদা আর জটায়ু দুটি বিপরীত চরিত্র অথচ অমলিন বন্ধুত্ব। জটায়ুর ভূমিকাটি চমৎকার অভিনয় করে দর্শকদের একশোভাগ আনন্দ দিয়েছিলেন সন্তোষ দত্ত।

‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে সন্তোষ দত্তের সাবলীল অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করে। এছাড়াও আরও কয়েকটি ছবিতে সন্তোষ দত্তের অভিনয় আজও মনে রেখেছেন সিনেমাপ্রেমী দর্শকেরা। যেমন ‘চারমূর্তি’র পিসেমশাই। খেতে বসার আগে টেনিদা আর দলবলের সঙ্গে জঙ্গলের গল্প। ‘লেজ খসা মোষ’ সংলাপটি বলার যে ধরন, মনে হয় সন্তোষ দত্তের হাতে মোষের সেই খসা লেজটি ধরা! এবার সকলকে দেখাবেন। পুরো ঘটনাটা সংলাপের মধ্যে দিয়ে ভিজুয়ালাইজ় করতে পারতেন সন্তোষ দত্ত। খুব বড়মাপের অভিনেতা না হলে এমনটা পারা বেশ কঠিন কাজ!

আরও পড়ুন: ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে আর ভাবছেন না সত্যজিৎ

সন্তোষ দত্তের অভিনয়ে বেশ রকমফের ছিল। তিনি জানতেন কীভাবে কোন চরিত্র অভিনয় করতে হবে। আসলে উনি চিত্রনাট্য খুব ভালভাবে পড়তেন। বুঝতে চেষ্টা করতেন তাঁর অভিনীত চরিত্রটি কীভাবে এগজ়িকিউট করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে একাধিক ছবির নাম করা যেতে পারে। যেমন ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবির নবীন মাস্টার। একেবারে সেকালের গ্রামের স্কুলের মাস্টামশাই। ছোট্ট অভিনয় কিন্তু আচার-আচরণ ব্যবহারে বুঝিয়ে দিলেন ছোট্ট চরিত্র কীভাবে উপভোগ্য করে তোলা যেতে পারে। ক্লাসরুমে ঢোকা থেকে গণ্ডগোল পাকানো পর্যন্ত সন্তোষ দত্ত অসাধারণ।

‘মর্জিনা আবদাল্লা’ (১৯৭৩) ছবিতে আলিবাবা আর ‘গোপাল ভাঁড়’ (১৯৮০) ছবিতে নামভূমিকায় সন্তোষ দত্তকে দর্শক মনে রাখবে জটায়ুর মতো।

কিংবদন্তি অভিনেতা সন্তোষ দত্তের জন্ম কলকাতা, ২ ডিসেম্বর ১৯২৫, মৃত্যু ৫ মার্চ, ১৯৮৮। মৃত্যুর পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “আমরা তিরিশ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি, সেই ‘পরশ পাথর’-এর আমল থেকে। ওঁর সম্পর্কে যে কথাটা বলা যায় তা হলো, ওঁর মতো প্রতিভাবান কমেডিয়ান এখন আর ছিল না। ওঁর চলে যাওয়ায় ছবির জগতে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। আমার ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রেও উনি কাজ করেছিলেন, সেই শেষ একসঙ্গে কাজ করা।

সমাপ্ত
প্রথম প্রকাশ: জাগ্রত বিবেক, জুন ২০২৫


Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *