টিন, বাক্স, পেয়ালা, পিরিচ বাজিয়ে এক নতুন ধরণের এক্সপেরিমেন্ট
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিনটি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানিয়েছিলেন রবিশঙ্কর (Ravi Shankar)। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই লেখার পুনর্মুদ্রণ
সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) আমাদের পরিবারের অনেক দিনের বন্ধু মানুষ। তিনি যখন ‘পথের পাঁচালী’ (Pather Panchali) ছবির সঙ্গীত রচনা করবার জন্যে আমার কাছে এলেন, আমি না করতে পারিনি। সত্যজিৎ আমাকে ছবির রাশ প্রিন্ট দেখালেন। সত্যি বলতে কী, দেখে ভাবাবেগে আমি অভিভূত হলাম। আমার স্নায়ুতে তখনই যেন বিষণ্ণ সঙ্গীতের অনুরণন অনুভব করলাম। বলতে কী ওখানেই মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা সময়ের মধ্যে গোটা ছবির নেপথ্যসঙ্গীতের মানসলিপি তৈরি হয়ে গেল।
রাশ দেখেই আমি বুঝেছিলাম এ ছবি বিরাট শিল্পকর্ম বলে স্বীকৃত হবে। সত্যজিতের আরও অনেক ছবি দেখেছি কিন্তু ‘পথের পাঁচালী’র মতো অমন প্রাঞ্জল, স্বচ্ছন্দ গতি কোনওটাতেই পাইনি। সব টুকরো-টুকরো কাজ এমন অখণ্ড একে বিলীন হয়েছে যা অনবদ্য।
আরও পড়ুন: মেয়ের মৃত্যুসংবাদ! তবু শট দিয়ে গেল জহর
সত্যজিৎ ছবির সঙ্গীত রচনায় বিশেষ অধিকারী। তিনি জানেন তিনি কী চান। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তাঁর সবিশেষ শিক্ষা আছে। পেশাদার শিল্পীদের মতোই পিয়ানো বাজাতে পারেন। ছবি ও সঙ্গীতে সমান নৈপুণ্য এবং অপরিসীম জ্ঞান লক্ষ্য করেছি চার্লি চ্যাপলিনের মধ্যে। ‘লাইমলাইট’ ছবিতে চ্যাপলিন রচিত সঙ্গীত অসাধারণ! আর একজনের নামও এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, তিনি নোয়েল কাওয়ার্ড। ভারতীয় চিত্রে সঙ্গীত এখনও ঠিক ওই পর্যায়ে উঠতে পারেনি।
অনেকেই এদেশে সঙ্গীত পরিচালকদের কাজকর্ম সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করেন। মতামত দেওয়া শক্ত। প্রতিটি সঙ্গীত পরিচালকের মধ্যে অবশ্যই তফাৎ আছে। একটা মোটরের হর্ন, পাখিদের কিচিরমিচির, অখণ্ড নীরবতা, কখনও-কখনও প্রচণ্ড সঙ্গীতের এফেক্ট সৃষ্টি করতে পারে। সেখানে যন্ত্রের কোনও সঙ্গীত, কোনও অর্কেস্ট্রা পৌঁছতে পারে না।
আরও পড়ুন: শেষ নাহি যে
লক্ষ্য করছি, ছবিতে ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের অপব্যবহার হচ্ছে এবং তা এমনই অনুপযুক্ত যে হাস্যকর শোনায়। তানসেন নিজের মতোই গাইতেন, তাঁর নিজস্ব একটা ভঙ্গী ছিল। বড়ে গোলাম আলি খাঁ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীতে গান। যখন দেখি ‘মুঘল এ আজ়ম’ ছবিতে তানসেনের গলায় গোলাম আলি খাঁয়ের গান, তখন অস্বস্তি বোধ করি। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন: না হতে পারা হিন্দি উত্তম রত্ন
এসব ব্যাপারে সত্যজিৎ অত্যন্ত সতর্ক। ওঁর সঙ্গীত রচনা আমার ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লেগেছে ‘টু’ শর্ট ফিল্মের নেপথ্য সঙ্গীত। দুটি ছেলের প্রচণ্ড কোলাহল ও পারস্পরিক আক্রোশকে তিনি শুধুমাত্র ধ্বনির মধ্যে দিয়ে যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। শুধু ছবির কথা বললে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ (Kanchenjungha) ও ‘মহানগর’ (Mahanagar) আমার ভালো লেগেছে। তবু এখনও ‘পথের পাঁচালী’ই মনে হয় ওঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, কোন বাংলা ছবিতে সঙ্গীত রচনা করে আমি সবথেকে বেশি আনন্দ পেয়েছি। ‘পথের পাঁচালী’ অবশ্যই! টিন, বাক্স, পেয়ালা, পিরিচ বাজিয়ে সে এক নতুন ধরণের এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল। উৎপল দত্তের ‘মেঘ’ আর ‘ঘুম ভাঙার গান’-এ কাজ করেও খুশি হয়েছি।
প্রথম প্রকাশ: ঘরোয়া, জৈষ্ঠ্য ১৩৭৯
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

			



