বাংলা ছবির চাটুজ্যেরা, সেকাল থেকে একাল
কেউ দাপুটে নায়ক, তো কেউ স্নেহশীল দাদা। কেউ তুখোড় নায়িকারূপে হৃদয় জয় করেছেন, তো কেউ যেন আবার পাশের বাড়ির ছেলেটি। কেউ তার সংযমী অভিনয়ে স্বাতন্ত্রের পরিচয় রেখেছেন, কেউ শিশুশিল্পী রূপে যাত্রা শুরু করে পরে লাস্যময়ী নায়িকা হয়ে উঠেছেন। কেউ বছরের পর বছর ইন্ডাস্ট্রিকে ধরে রেখেছেন নিজের ক্ষমতায়, আবার কেউ একের পর এক গোয়েন্দার চরিত্রে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বস্তুত এদের ছাড়া বাংলা ছবির ইতিহাস কল্পনাই করা যায় না, কারণ এরা সকলেই বাংলা ছবির সম্পদ, আর এরা সকলেই চট্টোপাধ্যায়। হ্যাঁ, কাকতলীয় হলেও বাংলা ছবির জগতে চাটুজ্যেদের অবদান কম নয়। আসুন দেখে নেওয়া যাক টলিউডের রঙ্গমঞ্চে চট্টোপাধ্যায় অভিনেতাদের চমক।
অনিল চট্টোপাধ্যায়: পঞ্চাশের দশকে অভিনয় শুরু করে প্রায় দেড়শো ছবিতে নায়ক ও চরিত্রাভিনেতারূপে বলিষ্ঠ অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন। বাংলার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি ছবিতেও সমানভাবে অভিনয় করেছিলেন তিনি। উল্লেখযোগ্য ছবি ‘কোমল গান্ধার’, ‘মহানগর’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘তিন কন্যা’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’।
উত্তমকুমার: আসল নাম অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ১৯৪৭ থেকে শুরু করে ১৯৮০ পর্যন্ত দুশো’র ওপর ছবিতে অভিনয় করেছেন বাংলা ছবির সফলতম নায়ক। একাধারে অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজকরূপে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন মহানায়ক। প্রায় সাত-আট দশক ধরে চলে আসা তাঁর স্টারডম ও ভক্তদের ভালবাসা তাঁকে বাংলা ছবির কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে। তাঁর অসংখ্য ছবির মধ্যে কয়েকটি হলো ‘নায়ক’, ‘সপ্তপদী’, ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘হারানো সুর’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘স্ত্রী’, ‘বাঘ বন্দি খেলা’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ইত্যাদি।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়: দীর্ঘ ষাট বছরের বেশি সময় ধরে অভিনয়ের জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য করে চলেছেন বাংলা ছবির এই কিংবদন্তি নায়িকা। পদ্মশ্রী, সঙ্গীত নাটক একাডেমি, বঙ্গবিভূষণ প্রভৃতি পুরস্কারে ভূষিত অভিনেত্রী এখনও বড় ও ছোট পর্দায় সমান সাবলীল। তাঁর কয়েকটি জনপ্রিয় ছবি ‘নিশিপদ্ম’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘কুহক’, ‘নবজন্ম’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘মোমের আলো’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘প্রাক্তন’, ‘আমার বস’।
বিশ্বজিৎ: ৬০ এর দশকে বাংলা ছবির জগতে পা রাখেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সুদর্শন এই অভিনেতা তাঁর দীর্ঘ অভিনয় জীবনে বহু বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন। মনে রাখার মতো কয়েকটি বাংলা ছবি ‘মায়ামৃগ’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘শেষ পর্যন্ত’, ‘দুই ভাই’, ‘কুহেলী’।
তরুণকুমার: বাংলা ছবির অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা তরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ অভিনেতারূপে কয়েক দশক ধরে দর্শককে উপহার দিয়েছেন অসাধারণ সব ছবি। ‘দাদাঠাকুর’ ছবিটির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হলো ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘মায়ামৃগ’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘চুপি চুপি আসে’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘সপ্তপদী’, ‘বসন্ত বিলাপ’।
শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়: ডাক্তারি ছেড়ে অভিনয় জগতে এসে নায়ক ও চরিত্রাভিনেতারূপে অজস্র মাইলস্টোন ছবি উপহার দিয়েছেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। মনে রাখার মতো কিছু ছবি ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘কোরাস’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘নায়িকার ভূমিকায়’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘লাল দরজা’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘প্রথম কদমফুল’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘ছদ্মবেশী’।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বাঙালির প্রিয়তম এই অভিনেতার অভিনয় ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। ১৯৫৯ এ সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবি দিয়ে বাংলা ছবির দুনিয়ায় যাত্রা শুরু হয় তাঁর। এরপর একে একে অজস্র ছবির মধ্যে দিয়ে বাঙালির হৃদয়ে মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ছবির সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গেছেন মঞ্চাভিনয়ও। দেশ বিদেশের নানা পুরস্কারের সঙ্গে পদ্মভূষণ ও দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত অভিনেতা ২০২০ এর নভেম্বরে প্রয়াত হন। তাঁর অজস্র ছবির মধ্যে কয়েকটি, ‘চারুলতা’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘অভিযান’, ‘কোনি’, ‘আতঙ্ক’, ‘অগ্রদানি’, ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘গণশত্রু’, ‘পদক্ষেপ’, ‘বেলাশেষে’, ‘ময়ূরাক্ষী’।
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়: মূলত হিন্দি ছবির নায়িকা হলেও বাংলা ছবি দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন মৌসুমী। এখনও হিন্দী ও বাংলা ছবিতে মাঝে মাঝেই দেখা যায় তাঁকে। যেসব ছবিতে দর্শক তাঁকে মনে রেখেছে তার কয়েকটি হলো ‘বালিকা বধূ’, ‘পরিণীতা’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘গয়নার বাক্স’, ‘আড়ি’।
ললিতা চট্টোপাধ্যায় (চ্যাটার্জি): ষাটের দশকে অভিনয় জগতে পা রেখে নায়িকা, সহনায়িকা ও খলনায়িকার চরিত্রে দক্ষতার পরিচয় দেন এই অভিনেত্রী। বাংলা ছাড়াও হিন্দি ছবিতেও তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হলো ‘বিভাস’, ‘জয় জয়ন্তী’, ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘আসছে আবার শবর’।
প্রসেনজিৎ: ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’ দিয়ে যার পথ চলা শুরু সেই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের যাত্রা এখনও অব্যাহত। আগাগোড়া নায়ক চরিত্রে বাংলা ছবিকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছেন তিনি। মনে রাখার মতো কয়েকটি ছবি ‘অমর সঙ্গী’, ‘অন্নদাতা’, ‘মনের মানুষ’, ‘অটোগ্রাফ’, ‘চোখের বালি’, ‘দোসর’, ‘জাতিস্মর’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, জ্যেষ্ঠ পুত্র, ‘শেষ পাতা’।
অভিষেক চট্টোপাধ্যায়: আশির দশকে বাংলা ছবিতে অভিষেক ঘটে এই সুদর্শন অভিনেতার। প্রথম ছবি তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় ‘পথভোলা’। এরপর নানা ছবিতে কখনও নায়ক কখনও বা সহনায়ক রূপে পর্দায় দেখা গেছে তাঁকে। দীর্ঘদিন ছবির জগৎ থেকে দূরে থাকলেও কয়েক বছর আগেই ফিরে এসেছিলেন ছোটপর্দায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০২২ এ মাত্র ৫৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন অভিনেতা। উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হলো ‘বাবা কেন চাকর’, ‘লাঠি’, ‘দহন’, ‘আলো’, ‘সজনী আমার সোহাগ’।
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: বাবা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ধারা অনুসরণ করে অভিনয়ের জগতে পা রাখলেও প্রথমদিকে ছোট পর্দাতেই অভিনয় করতেন শাশ্বত। পরবর্তীকালে বড় পর্দায় চরিত্রাভিনেতা রূপে কাজ শুরু করে একের পর এক অনবদ্য অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ফেলুদার সহকারী তোপসে ও ব্যোমকেশের সহকারী অজিতরূপে জনপ্রিয় হবার পর তিনি নিজেই গোয়েন্দা শবররূপে অবতীর্ণ হন এবং অচিরেই বাঙালি দর্শকের মন জয় করেন। গত কয়েক বছরে বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ও দক্ষিণী ছবিতেও বাংলার প্রতিনিধিত্ব করছেন বাঙালির গর্বের এই অভিনেতা। অজস্র ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কেয়ার অফ স্যার’, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘যেখানে ভূতের ভয়’, ‘আবার অরণ্যে’, ‘চার’, ‘আশ্চর্য প্রদীপ’, ‘প্রলয়’, ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’।
আবির চট্টোপাধ্যায়: বর্তমান বাংলা ছবির জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে আবিরের নাম অন্যতম এ কথা বলাই বাহুল্য। ছোটপর্দা দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করে পরে বড়পর্দায় পা রাখেন তিনি। একাধারে ফেলুদা ও ব্যোমকেশরূপে তিনি বাঙালি দর্শকের মন জয় করেছেন, অন্যদিকে নায়ক হিসেবে একের পর উল্লেখযোগ্য পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করে চলেছেন আবির। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি ‘ব্যোমকেশ বক্সী’, ‘বাদশাহী আংটি’, ‘মায়াকুমারী’, ‘বাস্তুশাপ’, ‘বোঝেনা সে বোঝেনা’, ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’, ‘শ্রী স্বপন কুমারের বাদামী হায়নার কবলে’, ‘রক্তবীজ’, ‘বহুরূপী’।
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: সন্দীপ রায়ের ফেলুদা ছবিতে তোপসের ভূমিকায় অভিনয় থেকে অঞ্জন দত্তর ‘বং কানেকশন’ ছবির অপু, শুরু থেকেই তাঁর চরিত্রাভিনয়ের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছে দর্শক। নায়কসহ নানান ভূমিকায় সাবলীল অভিনয় তাঁকে বাংলা ছবির এক অপরিহার্য অভিনেতা করে তুলেছে গত কয়েক বছরে। কয়েকটি মনে রাখার মতো ছবি ‘কালবেলা’, ‘অপুর পাঁচালি’, ‘প্রলয়’, ‘বাস্তুশাপ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘হেমলক সোসাইটি’, ‘সমান্তরাল’, ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’।
শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়: টেলিফিল্মে কাজ করতে করতেই ১৯৯৭-তে ‘মায়ার বাঁধন’ ছবির মাধ্যমে ছায়াছবির জগতে পদার্পণ ঘটে শ্রাবন্তীর। বর্তমানে বাংলা বিনোদনমূলক ছবির জগতে নায়িকার ভূমিকায় স্বমহিমায় বিরাজ করছেন তিনি। শ্রাবন্তীর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি ‘চ্যাম্পিয়ন’, ‘অমানুষ’, ‘গয়নার বাক্স’, ‘বুনোহাঁস’, ‘উমা’, ‘কাবেরী অন্তর্ধান’, ‘আমার বস’।
অনন্যা চট্টোপাধ্যায়: টেলিভিশন ধারাবাহিক দিয়ে অভিনয় শুরু করে পরবর্তীতে বাংলা ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন অনন্যা। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘আবহমান’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ২০১১ সালে। উল্লেখযোগ্য অভিনয় ‘অংশুমানের ছবি’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘জাতিস্মর’, ‘অন্নপূর্ণা’।