Interviews

‘আমাদের দেশের দর্শক এখনও পরিণত নয়’

তিনি ছিলেন বাংলা ছবির অন্যতম জনপ্রিয় গায়ক-নায়ক। শুধু অভিনয় নয়, তাঁর গানেও মুগ্ধ ছিল বাঙালি দর্শক। আজ থেকে অর্ধশতক আগে পাহাড়ী সান্যালের (Pahari Sanyal) এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নির্মল ধরWBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ 

প্রথম যখন ছবি করতে এলেন, তখন আপনাকে পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে কী ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?

পাহাড়ী: আসলে একটু বড় হওয়ার পর থেকেই বাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কাজেই সিনেমায় অভিনয় করা নিয়ে পারিবারিক দিক থেকে কোনও বাধা বা আপত্তির প্রশ্নই উঠছে না। তবে সামাজিক দিক থেকে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হয়েছি আমি। তখন তো আমাদের অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য বলে মনে করা হতো। এখনকার ধাঙড়রা যেমন সম্মান পায়, তখন সাধারণের কাছ থেকে আমরা সেটুকুও পাইনি। সত্যিই বড় খারাপ লাগত তখন। সমাজের বিবর্তনে মানুষ আজ প্রকৃত শিক্ষিত, সভ্য হয়েছে কি না তর্কের বিষয়। কিন্তু আমাদের প্রাপ্য সম্মানের চাইতে বেশি আমরা পেয়েছি। মাঝে-মাঝে যখন তথাকথিত অনুরাগীদের আনন্দের আতিশয্য উন্মত্ততার আকার ধারণ করে, তখন তা মোটেই সহ্য করা যায় না। তখন মনে হয় এর চাইতে বুঝি আগেকার দিনই ভালো ছিল। তখন সকলের সম্মান পাইনি ঠিকই। তবু যাদের কাছ থেকে পেয়েছি তাদের সেই অনুরাগে আন্তরিকতা ছিল। ভালোবাসা ছিল। কিন্তু এখন তো আমার ধারণা আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও দুটোর কোনওটাই আর নেই। যা আছে তা হুজুগেপনা। আমাদের তারা সিনেমায় কল্পলোকের জীব বলে মনে করে, তাই অনর্থক কৌতূহল। তবে বলতে গেলে এখন আমরা সমাজের অনেক-অনেক লোকের চাইতে অনেক বেশি সম্মানিত।

আরও পড়ুন: ঋত্বিক ঘটকের পরবর্তী ছবির নায়িকা তাঁর কন্যা?

প্রশ্ন: তখনকার পরিচালকদের থেকে অভিনয় করার ব্যাপারে কী ধরনের সহযোগিতা পেতেন?

পাহাড়ী: দেখো, সিনেমা লাইনে আমাকে নিয়ে আসেন দেবকীকুমার বসু। তিনিই আমাকে হাতেকলমে অভিনয় শেখান। তারপর বহু পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। নিউ থিয়েটার্সে থাকাকালীন নীতীন বসু, প্রমথেশ বড়ুয়া, হেমচন্দ্র চন্দ্র অনেকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রমথেশবাবু তো কোনওদিনই অভিনয় কীভাবে করতে হবে বলে দেননি। তিনি দৃশ্যের বর্ণনা করে বুঝিয়ে দিয়ে বলতেন, এই আমি চাই এবার করো। আমার কপি তুমি হও এ আমি চাই না। নিজেই নিজের মধ্যে ক্ল্যারিফিকেশন আনো, তাতে তোমারই ভালো হবে। আবার নীতীন বসু ছিলেন এর ঠিক উল্টো। নিজে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা করে বুঝিয়ে দিতেন কীভাবে করতে হবে। হেমবাবু কিন্তু দুটোই করতেন। মাঝে-মাঝে আমাকে করতে বলতেন আবার কখনও-কখনও দেখিয়ে দিতেন। তবে মোটামুটিভাবে প্রত্যেকের কাছ থেকেই সহযোগিতা পেয়েছি। তাছাড়া তখন আমরা সকলে অনেকটা এক পরিবারের মতো ছিলাম। প্রত্যেক ব্যাপারেই প্রত্যেকে সাহায্য করতে আসত আন্তরিকতা নিয়ে। মানুষের মন তখন এতটা মেকানাইজ়়ড হয়ে যায়নি। নিউকামার বলেই হোক বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, প্রত্যেক পরিচালকের কাছ থেকেই অন্ততপক্ষে অভিনয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতা ও সাহায্য পেয়েছি।

আপনার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে কোন ছবির কোন্ চরিত্রটা আপনাকে বিশেষভাবে অভিভূত করেছে এবং কেন?

পাহাড়ী: এ প্রশ্নের উত্তরের দুটো দিক আছে। এক হলো আমি হয়তো একটা চরিত্রে অভিনয় করলাম যথেষ্ট আন্তরিকতা আর মন দিয়ে কিন্তু দর্শক তা নিল না। সেখানে আমি ব্যর্থ। আবার কোনও চরিত্রে অভিনয় আমার যান্ত্রিক হয়েছে হয়তো কিন্তু দর্শক তাকে ভালোভাবেই নিল। সেখানেও আমি নিজের কাছে প্রতারক। তাই বলছি এ ব্যাপারে কোনটাকে তুমি গুরুত্ব দেবে?

আরও পড়ুন: উত্তমের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার সুপ্রিয়ার

আপনার সেল্ফ-স্যাটিশফ্যাকশন যে চরিত্র করে হয়েছে তার কথাই বলুন

পাহাড়ী: তাহলে ‘বিদ্যাসাগরে’-এর কথাই বলব। ও চরিত্র করতে গিয়ে আমাকে প্রচণ্ডভাবে খাটতে হয়েছে। একে চিরদিনই প্রায় বাংলার বাইরে ছিলাম। বাঙালি বা বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে খুব একটা পরিচিতি তখনও আমার হয়নি। কাজেই বিদ্যাসাগরের মতো খাঁটি বাঙালি চরিত্রে অভিনয় করা যে কীরকম কঠিন কাজ তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ। আমি প্রায়ই তখন বিদ্যাসাগরের পরিচিত ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ঘুরে-ঘুরে তাঁর চালচলন, কথাবার্তা সবকিছু জানতে চেষ্টা করেছি। যেদিন শুটিং থাকত, আমার আগের রাতে ঘুম হতো না। খালি ভাবতাম পারব তো সব ঠিক করতে? সন্দেহ হতো নিজের ওপর। তারপর ছবি যখন রিলিজ় করল তখন দেখলাম আমার এই এতদিনের সাধনার ধন দর্শক ভালোভাবেই নিল। খুব আনন্দ পেয়েছিলাম তখন। আত্মতুষ্টি ও দর্শক মনোরঞ্জন দুটোই করতে পেরেছিলাম বলে আমি গর্ববোধ করি। তারপর ‘গিরিশচন্দ্র’ ছবির কথা ধরো। ছবি করবার সময়ই আমার মনে হয়েছে গিরিশচন্দ্র যেন একপেশে হয়ে যাচ্ছে। গিরিশচন্দ্রের ধর্মের দিকটাতেই বেশি স্ট্রেস দেওয়া হয়েছিল। ওটাতেই আমার ভালো লাগছিল না। তা বলে ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে যে ফাঁক দিয়েছি তা নয়, তবে প্রাণের সাড়া পরিপূর্ণভাবে পাইনি। অথচ ওই ছবিই দর্শক নিয়েছে। এই আর কী।

তখন তো চলচ্চিত্র আঙ্গিকের দিক থেকে আজকের মতো এত উন্নত হয়নি। অভিনয় করতে গিয়ে আপনার এ ব্যাপারে কোনও অসুবিধা হতো কি? হলে কীরকম হতো?

পাহাড়ী: হ্যাঁ, অসুবিধা তো হতোই। সাউন্ড এত সেনসিটিভ ছিল না, লাইটিংয়ের ব্যাপারে অনেক অসুবিধে হতো। থিয়েটারি ঢংয়ে অভিনয় হতো তখন। অভিনয় কলা নিয়ে এতসব পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়নি তখনও। ধরো যে কথাটা আমার আস্তে বলা উচিত, সাউন্ডবক্স দূরে থাকায় স্বরকে স্বাভাবিকভাবেই একটু উঁচুগ্রামে তুলতে হতো। তাতে ঠিক অভিনয়ের যে মানসিক একাগ্রতা তা ভেঙে যেত। ক্যামেরা এখন যেখানে সেখানে বসিয়ে যখন তখন যে কোনও সময়ের দৃশ্য গ্রহণ করা হচ্ছে। তখন এতসব সুবিধা ছিল না। নানা ধরনের লেন্স-টেন্স তখনও আসেনি।

আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্কটে বাংলা ছবি, উদ্বিগ্ন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা

চলচ্চিত্রকে আপনি কী হিসেবে মানতে প্রস্তুত, প্রমোদমাধ্যম না শিল্পমাধ্যম?

পাহাড়ী: আমরা প্রথম যখন এ লাইনে আসি তখন সিনেমাকে প্রমোদমাধ্যম হিসেবেই মূলত দেখা হতো। ছবিকে মাটির কাছাকাছি, মনের কোণের কাছে টেনে এনে যে তাকে শৈল্পিক রূপ দেওয়া যায় তা অবশ্যই সত্যজিৎ রায়ের আগে কেউ ভাবেনি। বিমল রায় যদিও ‘দো বিঘা জ়মিন’ ছবির মধ্যে তার কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন। তবে স্বীকৃতি পাননি এদেশে। আমিও প্রথমদিকে সিনেমাকে প্রমোদমাধ্যম হিসেবেই দেখতুম। তবে এখন আর দেখি না। বিদেশি কিছু ছবি দেখে এ ধারণা আমার বদ্ধমূল হয়েছে। তবে শুদ্ধ আর্ট করতে গিয়ে যদি তা মনোরঞ্জনে অসমর্থ হয়, তবে সে পরিচালক ব্যর্থ। আর্টের সঙ্গে কমার্সকে মিলিয়েও যে ছবি তৈরি করা যায়, তার প্রমাণ ‘চারুলতা’, অপু সিরিজ়, ‘অতিথি’, ‘নির্জন সৈকতে’র মতো ছবিতে পেয়েছি। আর্ট ফিল্মের প্রয়োজন আছে কিন্তু এখন নয়। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের দেশের দর্শক এখনও পরিণত নয়। এখনও একই দর্শক সস্তাদরের ছবি থেকে উঁচু স্তরের ছবি, সব দেখেই আনন্দ পায়। অর্থাৎ সঠিক স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হয়নি এখনও। কাজেই সিনেমাকে আর্ট মিডিয়াম হিসেবে নিয়েও তার কমার্শিয়াল দিকটায় একেবারে নজর না দিলে শিল্পেরই ক্ষতি হবে। আর সেটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়।

বর্তমানে চলচ্চিত্রে অভিনয় সম্পর্কে আপনার কী মত? অভিনয়ের ধারার কি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়? যদি হয়ে থাকে, সেই পরিবর্তন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

পাহাড়ী: অভিনয়ের ধারার পরিবর্তন তো হয়েছেই আর তার প্রয়োজন ছিল। আরও হবে, হওয়া দরকার। আগেকার দিনের অ্যাক্টিংয়ের যুগ আর নেই। এখন চলা, বলা, সবকিছুরই মধ্যে দ্রুততা এসেছে। একটা কথাকে চার-পাঁচরকমভাবে উচ্চারণ করে চার-পাঁচরকম অর্থ করা যায়। সুতরাং অভিনয়ের কৌশলে পরিবর্তন হয়েছে মানে ছবির চরিত্র অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবের কাছাকাছি এসেছে। ছবির কাহিনি বিন্যাস যতই রিয়ালিস্টিক হোক না কেন, অভিনয়ে যদি সেই বাস্তবতা ফুটে না ওঠে তবে সে ছবি দর্শকমানসে কোনও প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি করবে না।

প্রথম প্রকাশ: অমৃত, সংখ্যা অজ্ঞাত


Edited and Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *