প্রবীণ বনাম নবীন দ্বন্দ্বে
স্টুডিয়ো সংবাদদাতা: মহৎ অন্তঃকরণ যার, তার নাম যদি মহাশয় ওরফে ‘মশায়’ হয়, তবে জীবন মশায় সত্যিই মহাশয় ব্যক্তি। পুরুষানুক্রমে কবরেজি তাদের পেশা ও নেশা। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় দখল আসাধরণ। জীবন মশায় বলতে আশপাশের পাঁচ-দশটা গাঁয়ের লোক সাক্ষাৎ এই দেবতাটিকেই বোঝে। কত রোগ বিরোগ, কত কঠিন মহামারীর হাত থেকে লোককে বাঁচিয়েছেন। তার আরোগ্য নিকেতন এখনও পাড়ার লোকে সরগরম হয়ে থাকে সকাল সন্ধ্যে। জীবন মশায় তাদের সামনে স্মৃতি-বিস্মৃতির ঝুড়ি উপুড় করে দেন।
নিজের ছেলেকে ডাক্তার করতে চেয়েছিলেন কবরেজ মশায়। অনেক আশা নিয়ে সত্যবন্ধুকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন।
কম্পোজ়িট শট। জীবন মশায় ও সত্যবন্ধু। স্থান রেল স্টেশন।
জীবন: আজ কিন্তু তোমাকে আমার হিংসে হচ্ছে সত্যবন্ধু।
সত্য: কেন বাবা।
জীবন: আমি যা হতে চেয়েছিলাম, পারিনি, তুমি তাই হতে চলেছ। কবিরাজ বংশের প্রথম ডাক্তার। চিকিৎসা বিদ্যার কত আধুনিক পদ্ধতি, কত নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে পরিচয় হবে তোমার।
কাট।
আরও পড়ুন: শেষ নাহি যে
ট্রেনের তীক্ষ্ণ বাঁশি বেজে ওঠে। গাড়ি নিয়ে যায় সত্যবন্ধুকে জীবন মহাশয়ের কাছ থেকে। আর সে ফিরে আসেনি। দুর্গাপুজোয় বাড়ি না আসার দরুণ জীবন মশায় কলকাতা এসে তার সুপুত্রের কাণ্ডকারখানা দেখে বাড়ি ফিরে আতরবউকে বলেছিলেন, আজ থেকে আমরা জানব আমাদের ছেলে মৃত। মশায়বংশ নির্বংশ।
এইভাবে দিন কাটে জীবন কবরেজের।
একদিন শহর থেকে জমিদার ভুবন রায় এলেন গাঁয়ে। মশায়ের কাছে এসে বললেন, দেখো তো কবরেজ, তোমার নিদান কী বলে? বাঁচব ক’দিন আর?
জীবন ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বলে, বিষয় আশয়ের একটা ব্যবস্থা করো। নাতনিটার একটা গতি করো। তারপর আর কী, কাশীবাসী হয়ে যাও।
কবরেজের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বুঝতে পারে ভুবন জমিদার। জীবন ‘হাতুড়ে’র ওপর বিশ্বাস হারিয়ে হাসপাতালের তরুণ ডাক্তার প্রদ্যোতের এর শরণাপন্ন হয়।
আরও পড়ুন: ‘এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে’
মিড শট। ভুবন রায়ের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে প্রদ্যোৎ।
জীবন: নমস্কার।
প্রদ্যোৎ: নমস্কার।
জীবন: আপনি তো আমাদের নতুন ডাক্তারবাবু। দূর থেকে দেখেছি, আলাপ হয়নি।
প্রদ্যোৎ: (হেসে) আজ্ঞে হ্যাঁ। ক’মাস হলো এসেছি। এমন জড়িয়ে রয়েছি হাসপাতালটা নিয়ে সকলের সঙ্গে…মানে দেখা করে উঠতে পারিনি।
জীবন: আমি জীবন মশায়। জীবন সেন।
কাট।
আরও পড়ুন: ‘এক ফিল্ম হিরোর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি’
ক্লোজ় শট। প্রদ্যোৎ।
প্রদ্যোৎ: মশায়! কাট।
ক্লোজ় শট। জীবন।
জীবন: (হেসে) ওই বলে লোকে ডাকে আর কী! তারপর? দেখলেন ভূবেনশ্বরকে?
কাট।
আরও পড়ুন: দীনেন গুপ্তর ছবিতে উত্তমকুমার
ক্লোজ় কম্পোজ়িট শট। প্রদ্যোৎ ও জীবন।
প্রদ্যোৎ: হ্যাঁ। আপনিও তো দেখেছেন কাল। জ্ঞান গঙ্গার ব্যবস্থাও দিয়েছেন শুনলাম।
জীবন: আমার নাড়িজ্ঞানে তাই পেলাম ডাক্তারবাবু। ছ’মাস।
প্রদ্যোৎ: কী বললেন?
কাট।
কম্পোজ়িট শট। জীবন ও প্রদ্যোৎ।
জীবন: ওর ভেতরটা একেবারে জীর্ণ করে ফেলেছে।
প্রদ্যোৎ: তবু উনি বাঁচবেন। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির কথা আপনি জানেন না। সারা দেশময় ছড়িয়ে গেলেও আপনার ভাঙা আরোগ্য নিকেতনের ভেতর সে খবর পৌঁছয়নি।
কাট।
আরও পড়ুন: উত্তমের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার সুপ্রিয়ার
কম্পোজ়িট শট। প্রদ্যোৎ ও জীবন।
প্রদ্যোৎ: ওকে আমি বাঁচাব। এবং তিনি বাঁচবেন। চলি, আমার হাসপাতালের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
প্রদ্যোৎ চলতে শুরু করে, একটুখানি এগিয়ে থেমে আবার ফিরে আসে।
প্রদ্যোৎ: হ্যাঁ, আর একটা কথা।
কাট।
আরও পড়ুন: উভয় সঙ্কটে রাখি মজুমদার?
কম্পোজ়িট শট। প্রদ্যোৎ ও জীবন।
প্রদ্যোৎ: হাতুড়ে চিকিৎসা ছাড়া যখন কোনও চিকিৎসা ছিল না, তখন যা করার করেছেন। কিন্তু এখন এ যুগে এভাবে ‘নিদান’ হাঁকবেন না। এটা মরার যুগ নয়, এটা বাঁচার যুগ। আজকের মেডিক্যাল সায়েন্স যে কত উন্নত তা আপনি জানেন না!
প্রদ্যোৎ চলতে শুরু করতেই ক্যামেরা অনুসরণ করে তাকে।
কাট।
জীবন মশায়ের সঙ্গে প্রদ্যোতের এর এই মনকষাকষি যত না আন্তরিক, বাহ্যিকরূপ তার বেশি। নতুন ডাক্তারের ঔদ্ধত্য অসহ্য হলেও, পুত্রহারা জীবন মশায় তার সেই অঙ্কুরিত নির্মল আশার মধ্যে কোথায় যেন নিজের পূর্ণতা দেখতে পান।
এদিকে নিদান দেওয়া ভুবন জমিদার নতুন ডাক্তারের কাছে ওষুধ খেয়ে কবরেজের ‘তুক’কে মিথ্যা প্রমাণ করতে চান। ক’দিন আগে পাড়ার পাঁড়মাতাল দাঁতু ঘোষাল এসেছিল জীবন মশায়ের কাছে। কবরেজ তাকে নেশাটেশা করতে বারণ করেছিল। কিন্তু দাঁতু ওই হাতুড়ের কথায় বিশ্বাস না করে হাসপাতালের ডাক্তার প্রদ্যোতের শরণাপন্ন হয়েছিল। তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারেনি। জীবন মশায়ের কথা অক্ষরে-অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। এটা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যর্থতা না নিদান, অমোঘ ফল বা কোনও কাকতালীয় ব্যাপার যাই হোক না কেন, প্রদ্যোতের মনে রেখাপাত করে।
আরও পড়ুন: ঋত্বিক ঘটকের পরবর্তী ছবির নায়িকা তাঁর কন্যা?
অপরদিকে ভুবন রায় ধীরে-ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। কবরেজের ছ’মাসের নিদান বুঝি বিফলে যায়! প্রদ্যোৎও নিজের সাফল্যে আনন্দিত হয়। এ সফলতার খবর জানাতে গিয়ে দেখে মনের ঘরে কখন মঞ্জুর (ভূবন রায়ের নাতনি) অকস্মাৎ আগমন ঘটেছে। দাদুর পুনর্জন্মে প্রদ্যোতের কৃতিত্বকে সে শ্রদ্ধা করে, সম্মান জানায়, ভালোবাসে তাকে।
তারপর সত্যি সত্যিই নির্দিষ্ট দিনটি পার হয়ে যায়। জীবন মশায়ের আরোগ্য নিকেতনে সব স্তাবকের দল নির্বাক হয়ে যায়। তাদের মনে সন্দেহ জাগে, সত্যিই তাহলে নিদান দেওয়ার দিন শেষ হলো? যমের হাত থেকে ফিরে আসার আনন্দে সারা গাঁয়ে রোল পড়ে যায়। ভুবন জমিদার আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর এই অতিরিক্ত বিশ্বাস তখন তার মনে অনিয়ম অনাচারের ঢেউ তোলে। তিনি হয়তো বা একটু তাচ্ছিল্যও করেন ভাগ্যকে। অলক্ষ্যের সেই সর্বদ্রষ্টা বুঝি মুচকে হাসেন।
আরও পড়ুন: মোটামুটি একটা মারপিটের সিনেমা হওয়ার উপযুক্ত ছিল?
সেই রাতেই অতিরিক্ত মদ্যপানে আবার শয্যাশায়ী হন ভুবন রায়। এই কি তার শেষ শয্যা? জীবন মশায়ের ‘নিদান’ কি তাহলে সত্যি? প্রদ্যোৎ ডাক্তারের অক্লান্ত চেষ্টা কি প্রকৃতির কোল থেকে ভুবন জমিদারকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না?
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘আরোগ্য নিকেতন’ কাহিনি অবলম্বনে নতুন ছবি মুক্তির প্রতীক্ষায়। বিজয় বসু পরিচালিত এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়। চিত্রগ্রহণে কৃষ্ণ চক্রবর্তী। বিভিন্ন ভূমিকায় রয়েছেন। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় (প্রদ্যোৎ), রুমা গুহঠাকুরতা (প্রদ্যোগের মা), জহর গঙ্গোপাধ্যায় (ভুবন রায়), মঞ্জু (সন্ধ্যা রায়), ছায়া দেবী (আতর বউ), দিলীপ রায় (সত্যবন্ধু) ও রবি ঘোষ (শশি কম্পাউন্ডার)। জীবন মশায়ের চরিত্রে রয়েছেন বিকাশ রায়।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, জৈষ্ঠ্য ১৩৭৫
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





