Flashback

সৌমিত্র-উত্তম একসঙ্গে (পর্ব ১)

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) ও উত্তমকুমার (Uttam Kumar) অভিনীত ছবি ‘দেবদাস’ (Devdas) মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে সেই ছবির সেটে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক স্বপনকুমার ঘোষ। প্রত্যক্ষ করেছিলেন বাংলার দুই সেরা শিল্পীর অভিনয় নৈপুণ্য। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই প্রতিবেদনের পুনর্মুদ্রণের প্রথম পর্ব

বেলা ১১.৪৫। তবু অন্ধকার ছড়িয়ে আছে ফ্লোরের মধ্যে। না, সূর্য ঠিকই উঠেছে। আসলে লোডশেডিং চলছে। টেকনিশিয়নস স্টুডিয়োর মেকআপ রুমের বাইরে চলছে আড্ডা। আসরে আছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সমিত ভঞ্জ, তরুণকুমার, উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

উত্তমকুমারকে বললেন সৌমিত্র, “ক’দিন আগে টিভিতে দেখলাম। ‘চিরকুমার সভা’। তোমার পূর্ণ পরিপূর্ণ।”

অনেকটা সময় কেটে গেল।

বেলা তিনটে। পরিপূর্ণ আলোকে উদ্ভাসিত সকলে। আলো এসেছে। শুরু হয়েছে ব্যস্ততা, ক্যামেরার টানাটানি, সাংবাদিক, আলোকচিত্রীদের ছোটাছুটি। সকলেই প্রস্তুত। ছবি ‘দেবদাস’, পরিচালক দিলীপ রায়। ছবির নামভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। চুনিলাল উত্তমকুমার।

স্টার্ট সাউন্ড, ক্যামেরা, অ্যাকশন। শুরু হল শুটিং।

ভোর হয়েছে। গুনগুন করে গান করতে-করতে মেসবাড়ির প্রধান দরজা দিয়ে চুনিলালের প্রবেশ। ফেলে আসা রাতের আমেজে তখনও পা টলছে। বাসি রজনীগন্ধার সৌরভ তার গায়ে। দেবদাস এল। একটি কাজের লোক জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেল। চুনিলাল তাকাল। আবার এগিয়ে এল। সিঁড়ির মুখে দেবদাসের সঙ্গে দেখা।

চুনিলাল: কী ব্যাপার এত সকালে মালপত্র নিয়ে চললে কোথায়?

দেবদাস: দেশে।

চুনিলাল: এই তো সবে কাল জ্বর থেকে উঠলে। (একটু হেসে) ও বুঝেছি। মায়ের জন্য মন কেমন করছে, না?

দেবদাস: না চুনিদা। একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি।

চুনিলাল: সংশোধন করে ফেলো। তা কবে ফেরা হচ্ছে?

দেবদাস: আর ফিরব না। জানো চুনিদা, কলকাতা আমার নিয়েছে অনেক, দেয়নি কিছুই।

চুনিলাল: কথার-সুরে কেমন বেহাগের গন্ধ পাচ্ছি। ভালো-ভালো, এখানে আর এসো না। এটা হচ্ছে নরক। এখানে থাকলে জীবনের সব ফুলগুলো ঝরে যায়।

দেবদাস: তাহলে সব জেনেও তুমি এখানে পড়ে আছ কেন?

চুনিলাল: আমি পড়ে আছি তার কারণ, আমরা হচ্ছি সেই স্বর্গচ্যুত দেবতা যাঁদের মুনির অভিশাপে স্বর্গে  ফেরার আর উপায় নেই। তাই আমরা এখানে সুন্দরের আরাধনা করি, সাধনা… নাহ্, তোমার দেরি করিয়ে দিচ্ছি। এসো ভায়া এসো, তোমার যাত্রা শুভ হোক।

দেবদাস: (চুনিলালের হাত ধরে) আসি চুনিদা।

দেবদাস চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে চুনিলাল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করল, মুখে শায়রি: মুরদই লাখ বুড়া চাহে তো কেয়া হোতা হ্যায়, ওহি হোতা হ্যায় জো মঞ্জুরে খোদা হোতা হ্যায়।

শট দিয়ে এসে উত্তমকুমার পরিচালককে প্রশ্ন করলেন, “এটা হচ্ছে নরক, এখানে থাকলে সব ফুল ঝরে যায়… এ কথা কেন বললাম বলো তো?”

দিলীপ সঠিক যুক্তি দিয়ে উত্তর দিলেন। উত্তম কনভিনসড হলেন। পরিচালক তখন ছদ্ম-বিনয়ে বললেন, “আমি এখনও পাকা ডিরেক্টর হয়ে উঠতে পারিনি। কঠিন-কঠিন প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারব না।”

দিলীপের কথা শুনে উত্তমকুমার প্রাণখুলে হাসলেন। হেসে উঠলেন সৌমিত্রও।

উত্তম-সৌমিত্র (Uttam-Soumitra) জুটি বাংলা ছবির দর্শকের কাছে বহু আকাঙ্ক্ষিত। ছায়াছবিতে এই জুটির প্রথম সাক্ষাৎ ‘ঝিন্দের বন্দী’তে। এই জুটির অভিনয় দীপ্তি ছবিতে জৌলুস এনেছিল। দর্শকমনে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল দু’জনের মুখোমুখি অভিনয়। দ্বিতীয় ছবি ‘অপরিচিত’। সত্যিকারের চমক এনেছিল দু’জনের অভিনয়। অভিনয়গুণের ভিত্তিতে দু’টি চরিত্রের দিকেই দর্শক সহানুভূতি সমানভাবে ছুটেছিল। কে বড় অভিনেতা? এই প্রশ্ন তখন দর্শককে রীতিমতো ভাবিয়েছিল।

তৃতীয় ছবি ‘স্ত্রী’। এক স্ত্রী সামনে রেখে উত্তম-সৌমিত্র বিরোধের রস দর্শক বেশ উপভোগ করেছিল। দু’জনেই অভিনয়ে সকলকে তৃপ্ত করেছিলেন। চতুর্থ ছবি ‘যদি জানতেম’। রসের দিক থেকে আগের তিনটির তুলনায় কিছুটা নীরস। তবু উত্তমকুমারের ভাবগম্ভীর অভিনয় ও সৌমিত্রের কৌতুককর ও রহস্যময় চরিত্র দর্শককে যথেষ্ট আনন্দ দিয়েছিল।

মনে রাখবার মতো কথা, এই চারটি ছবিই প্রচণ্ডভাবে ব্যবসায়িক-সফল হয়েছিল। বাংলা ছবির প্রযোজক, পরিচালকেরা নিশ্চয়ই সেটা মনে রাখেন। তাই বারবার উত্তম-সৌমিত্র জুটিকে ক্যামেরার সামনে আসতে হয়েছে, দর্শকের ইচ্ছাপূরণের জন্য। এটা সত্য, মাঝেমধ্যে উত্তম-সৌমিত্র জুটির অভিনয়ে দু’জনের মধ্যে প্রতিযোগিতার ভাব লক্ষ করা গিয়েছে। কিন্তু কখনও তা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছয়নি, স্নিগ্ধতার প্রলেপেই ঢাকা থেকেছে। আসলে দু’জনের অভিনয়ধারা দু’প্রকৃতির। অর্থাৎ অভিনয়ের স্কুলিং তাঁদের এক নয়। ফলে উভয়ের অভিনয় রীতিতে দ্বন্দ আসার সম্ভাবনা কম থাকে। যে যাঁর রীতিতে অভিনয় করেন। দু’জনেই ভালোবাসেন অভিনয়কে। ভালোবাসেন শিল্পকে, নিজের সৃষ্টিকে। এ সত্য বারবার প্রমাণিত। আবার প্রমাণের প্রতীক্ষায় দর্শক অপেক্ষমাণ।

‘দেবদাস’ ছবিতে দু’জনের অভিনয় কতটা নতুনত্ব আনবে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়ার জন্য দর্শক সাগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কারণ, এর আগে ‘দেবদাস’ বাংলায় একবার চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। সেখানে দেবদাসের ভূমিকায় ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া এবং চুনিলালের চরিত্রে অমর মল্লিক। দর্শক হয়তো তুলনামূলক বিচার করবেন। প্রমথেশ একরকম প্রবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছেন। দেবদাস আর তাঁকে আলাদা করে ভাবা যায় না। চুনির ভূমিকায় অমরও অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। সুতরাং দর্শকের কৌতূহল আজকের উত্তম-সৌমিত্র প্রমথেশ-অমরের ইমেজ ভেঙে ফেলতে পারবেন কি? প্রথমবার ‘দেবদাস’ পরিচালনা করেন প্রমথেশ নিজে। তাঁর পরিচালনারীতিকে আজকের পরিচালক দিলীপ টপকাতে পারবেন কি? এসব নিয়ে দর্শকের কৌতূহল নিত্যই বাড়ছে। তর্কবিতর্কে বাড়ছে উত্তাপও।

‘দেবদাস’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সার্থক সৃষ্টি। তাই ‘দেবদাস’ একাধিকবার চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। হিন্দিতে দু’বার। এখন আবার হচ্ছে। এর মধ্যে চলচ্চিত্রকারেরা নিশ্চয়ই কিছু খুঁজেছেন। প্রত্যেকে ডাইমেনশনে পরিবর্তন এনে দেখবেন, কী দাঁড়ায়। বড় লেখকেরা তাঁদের লেখার মধ্যে অনেককিছুই অব্যক্ত রাখেন। দু’লাইনের ফাঁকের মধ্যে ভর্তি থাকে অনেক অ-লেখা শব্দ। পাঠক যেমন সেটা উদ্ধার করতে চান, পরিচালকেরাও ঠিক তেমনভাবে উদ্ধার করছেন এবং মূর্ত করছেন ক্যামেরার সাহায্যে। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন স্বাভাবিক। সেই কারণে আজকের দেবদাস ও পূর্বের দেবদাস কখনওই এক হতে পারে না। মূল কাঠামো বজায় রেখে তার পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। এই পরিবর্তন কীভাবে ঘটেছে, কোথায় ঘটেছে এবং কেন ঘটেছে, জানবার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক।

পরের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

প্রথম প্রকাশ: আনন্দলোক, সেপ্টেম্বর ১৯৭৮


Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *