Features

জুলাইয়ের দুই জুয়েল

বিপ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য: জুলাইয়ে দুই বাঙালি কিংবদন্তির কথা স্মরণে আসে। একজন ডাক্তার, অন্যজন অভিনেতা। অথচ দু’জনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল চমৎকার। একজন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় (Bidhan Chandra Roy), অন্যজন অভিনেতা উত্তমকুমার (Uttam Kumar)। দু’জনেরই মৃত্যু জুলাইয়ে। বিধানচন্দ্র রায়ের ১ জুলাই, এই দিন তাঁর জন্মদিনও বটে। উত্তমকুমারের প্রয়াণ ২৪ জুলাই। উত্তমকুমারকে সম্বোধন করতেন বিধান রায় শ্যামল নামে। উত্তমকুমার কী করে শ্যামল হলেন তাঁর কাছে! বিস্ময় জাগে? স্বাভাবিক।

উত্তমকুমার তখন শ্যামবাজারে স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী’ করছেন। সারা শহর জুড়ে হইচই। একদিন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এলেন ‘শ্যামলী’ দেখতে। নাটক দেখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় খুব খুশি। উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রর নাম অনিল হলেও বিধানবাবু তাঁর নাম দেন শ্যামল। শ্যামলী থেকে শ্যামল। নাটক-শেষে গ্রিনরুমে গিয়ে সেকথা বলেনও। তারপর থেকে তিনি উত্তমকে ডাকতেন শ্যামল নামেই।

হঠাৎ বিধান রায় আর উত্তমকুমারের প্রসঙ্গ কেন! একজন ছিলেন বাস্তবের ডাক্তার, অন্যজন সিনেমার। উত্তমকুমার বেশকিছু ছবিতে ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে উত্তম একেবারে চরিত্রটির মধ্যে প্রবেশ করে সেটির অন্তর্নিহিত আবেগকে অভিনিবেশপূর্বক অনুকরণের মাধ্যমে তার ব্যতিক্রমী অভিনয়শৈলী সুকণ্ঠস্বর, অসাধারণ সংলাপ প্রক্ষেপণ ও সময় জ্ঞান আর আঙ্গিক অভিনয়ের সাহায্যে তুলে ধরতেন। এর ফলে চরিত্রটি হয়ে উঠত একেবারে জীবন্ত। অবশ্যই উত্তমের ব্যক্তিত্বপূর্ণ সুদর্শন চেহারা ও ভুবনমোহিনী হাসি সর্বদা তাঁকে সহায়তা করেছে।

একই কথা বলা যায় তাঁর চিকিৎসকের চরিত্রে অভিনয়ের ক্ষেত্রে। উত্তম তাঁর অভিনয় জীবনে বেশ কয়েকটি ছবিতে ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ডাক্তারবাবু’ (Doctorbabu), ‘মরণের পরে’ (Maroner Pore), ‘সপ্তপদী’ (Saptapadi), ‘সাগরিকা’ (Sagarika), ‘সূর্যশিখা’ (Suryasikha), ‘অগ্নিশ্বর’ (Agniswar), ‘আমি সে ও সখা’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ (Ananda Ashram)

কেরিয়ারের একেবারে প্রথমদিকে জাতিস্মরবাদের ওপরে তৈরি ‘মরণের পরে’ ছবিতে তিনি ব্রেন স্পেশালিস্ট ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেন। ব্রেন স্পেশালিস্ট বললে হয়তো এখন বুঝতে একটু অসুবিধা হতে পারে কারণ তাঁদের নিউরোলজিস্ট বলা হয়। এই ছবিতে উত্তমকুমার তাঁর সুনিপুণ অভিনয়ে ব্রেন স্পেশালিস্ট ডাক্তারের চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন। সুচিত্রা সেন ছিলেন নায়িকার ভূমিকায়। ছিলেন নাট্যজগতের দিকপাল শম্ভু মিত্র। উত্তমকুমারের হিট ছবিগুলোর মধ্যে ‘মরণের পরে’ অন্যতম।

কেরিয়ারের একেবারে মধ্যগগনে উত্তমকুমার ‘সপ্তপদী’ ছবিতে অভিনয় করেন। ছবিটির  প্রযোজকও তিনি। তাঁর অভিনীত চরিত্রের নাম  কৃষ্ণেন্দু। নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন সুচিত্রা ওরফে রিনা ব্রাউন। ‘সপ্তপদী’র কথা বললেই সেই দৃশ্যটি আমাদের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, যেখানে দেখা যায় দীর্ঘ অদর্শনের পর ঝড়বৃষ্টির রাতে সেনাবাহিনীর মহিলা কর্মী রিনা অচেতন অবস্থায় কৃষ্ণেন্দুর রোগী দেখার ঘরে শুয়ে আছেন। আলো-আধাঁরির সেই দৃশ্যে কৃষ্ণেন্দু হঠাৎ আবিষ্কার করে তার প্রেয়সী রিনাকে। এই দৃশ্যে উত্তমকুমারের পরিশীলিত অসাধারণ অভিনয় সমস্ত দর্শকদের শুধু অভিভূত করেছিল তাই নয়, মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। উত্তমকুমারের মেক-আপ, অঙ্গসজ্জা, বাচনভঙ্গি, আঙ্গিক অভিনয়, সুন্দর কণ্ঠস্বর, পর্দায় তাঁর সুদর্শন উপস্থিতি, সবকিছুর মিশেলে ওই চরিত্রটিতে স্বাভাবিক অভিনয়ে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।

‘সপ্তপদী’তে উত্তমের অভিনীত চরিত্রটি একটু অন্যধরনের ছিল। ডাক্তারেরা শুধুই ডাক্তারি করে তা নয়। তারা খেলাধুলো করে, গান গাইতে পারে, এমনকী প্রেমিকও হয়ে উঠতে পারে। কৃষ্ণেন্দু চরিত্রটির এই গুণগুলো উত্তম তাঁর অপূর্ব অভিনয় দক্ষতা দিয়ে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। ‘সপ্তপদী’ ছবিতে উত্তম-সুচিত্রার অসাধারণ জুটির সুনিপুণ অভিনয় দর্শককে একাত্ম করেছে, কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে অফুরান।

Uttam Kumar

এর পরে আসব ‘পথে হলো দেরি’ ছবিটির কথায়। এই ছবিতে উত্তমকুমার এমন এক ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেন যার ডাক্তারি পড়াশোনায় গভীর জ্ঞান ও আত্মসম্মানবোধ প্রখর। ফলে সিনিয়র ডাক্তারের কাছে মাথা নত না করে নিজের কাজ করে গিয়েছেন সঠিক পথে সঠিকভাবে। পরবর্তী কালে ডাক্তারিতে উচ্চশিক্ষার শেষে দেশে ফিরে আসার পর বেশকিছু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে মিলনান্তক দৃশ্যে ছবিটির সমাপ্তি ঘটে। নায়িকা সুচিত্রা ধনীর দুলালি। ‘সূর্যশিখা’ ছবিতে উত্তমকুমার রোগী দরদি তথা মানবপ্রেমী এক ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁর সুনিপুণ অভিনয় দক্ষতার স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে-ছড়াতে তিনি পৌঁছে যান ছবির মিলনান্তক শেষ দৃশ্যে। এই ছবিতে নায়িকা ছিলেন সুপ্রিয়াদেবী।

‘আমি সে ও সখা’ ছবিতে উত্তমকুমার দুটি চরিত্রে অভিনয় করেন। একটি চিকিৎসকের, অপরটি ওই ডাক্তারের প্রফেসর দাদার চরিত্রে। চিকিৎসকের চরিত্রে ডাক্তারসুলভ বাচনভঙ্গি ও আঙ্গিক অভিনয় যেমন তুলনাহীন, তেমনই প্রফেসর দাদার ভূমিকায় উত্তমের ব্যতিক্রমী অভিনয়শৈলীর মধ্যে দিয়ে কী অপূর্ব পার্থক্যরেখা তৈরি করেছেন। অথচ একই ব্যক্তি অভিনয় করছেন দুটি ভিন্ন চরিত্রে আর সেটা উত্তমকুমার বলেই সম্ভব হয়েছিল।

‘আনন্দ আশ্রম’ ছবিতে ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেন পর্দায় তার সুদর্শন রোম্যান্টিক উপস্থিতির সঙ্গে সুঅভিনয় ছবিটিকে সহজেই সাফল্য এনে দেয়। এই ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর।

‘অগ্নিশ্বর’ উত্তমকুমারের শেষের দিকের ছবি। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তৈরি হওয়া এই ছবিতে তিনি নামভূমিকায় অর্থাৎ ডাক্তার অগ্নিশ্বর মুখার্জির চরিত্রে অভিনয় করেন। অগ্নিশ্বর ছিলেন একজন কর্তব্যপরায়ন, সৎ, জটিলতাহীন ও ডাক্তারিশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। উত্তমকুমার তাঁর ব্যতিক্রমী ও সুনিপুণ অভিনয়ের তুলিতে ডাক্তারের চরিত্রের এই দিকগুলো তিনি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

অল্পবয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমরাই তাঁর অভিনয় সুধাপানে বঞ্চিত হয়েছি।


Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *