‘টাকা চেয়ে বসলেন বাবা’
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়: ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (Bhanu Bandopadhyay) না থাকলে আমার অভিনয় জগতে আসা হত না। এ কথা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ভানুদা আমাদের আত্মীয় ছিলেন। আমার থেকে বয়সে প্রায় ১৬-১৭ বছর বড় ছিলেন। থাক সে কথা। আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন আমি কাননবালা (Kanan Devi) হব। উনি আমার আদর্শ অভিনেত্রী। সেই স্বপ্নেই বিভোর ছিলাম। থাক সে কথা। বিষয় যখন উত্তমকুমার তখন সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
আমিও উত্তমকুমারের গুণমুগ্ধ ছিলাম। আমরা সেদিন কালীঘাটের একটা বাড়িতে নাটকের স্টেজ রিহার্সল করছিলাম। সেখানে মধ্যমণি ছিলেন ভানুদা। হঠাৎ খবর পেলাম, ভানুদার সঙ্গে দেখা করতে উত্তমকুমার (Uttam Kumar) আসবেন। আমি তো খবর শুনেই থ। তাহলে সামনাসামনি উত্তমকুমারকে দেখতে পাব? বেশ খুশিই ছিলাম। মনে-মনে ভাবছিলাম, ভানুদার কাছে যখন আসবেন তখন আলাপ হবে নিশ্চয়।
সেই শুভক্ষণ এল। খবর এল উত্তমকুমার এসেছেন। পড়ি কী মরি দে দৌড় মূল দরজার দিকে, যেখান দিয়ে উত্তমকুমার আসবেন। আমার খেয়াল নেই, সামনে একটি আধভাঙা পোশাকের ট্রাংক রাখা ছিল। সেই ট্রাংকে ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়লুম। পা কেটে গেল, গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল। অন্যেরা দেখতে পাচ্ছে আমার পা কেটে রক্ত ঝরছে, আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমার লক্ষ্য উত্তমকুমার! আমি আর মূল দরজার সামনে যেতে পারলাম না। উইংসের পাশে দাঁড়ালাম। পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে তাঁকে মুগ্ধ চোখে দেখছি। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁকে দেখার উন্মাদনা যে কী, তা বুঝিয়ে বলতে পারব না। সেই প্রথম তাঁকে দেখলাম।
আরও পড়ুন: পরিবেশ-রাজনীতির এক মায়াবী ইস্তাহার
তারপর উত্তমকুমার মঞ্চে উঠে এলেন। মনে আছে, সেদিন উনি স্যুট-প্যান্ট পরেছিলেন। মঞ্চে উঠেই ভানুদার কাছে গেলেন। তাঁরা দু’জনে ফিসফিস করে কী যেন কথা বললেন। তারপর ভানুদা আমাকে ডাকলেন। উত্তমকুমারে সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এই মেয়েটির নাম সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (Sabitri Chatterjee)। আমরা ওকে সাবু বলে ডাকি। আমাদের নাটকে ও অভিনয় করছে। ভালো অভিনয় করে। প্রয়োজনে ওকে কাজে লাগাতে পারিস।’
ভানুদার কাছে উত্তমকুমার এ কথা শোনার পর বললেন, ‘আমাদের একটা নাটকের দল আছে। আপনি কি অভিনয় করবেন?’ আমি বললাম, ‘নিশ্চয় করব। তবে বাবার কাছ থেকে আপনাকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে।’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে আমি আপনার বাবার কাছে যাব।’
আরও পড়ুন: হালচাল ঠিকঠাক হ্যায়
এই বলে উত্তমকুমার ভানুদার সঙ্গে কাজের কথা সেরে চলে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর আমার সারা শরীর শিহরিত হতে লাগল। তখন যেদিকে তাকাই সবই যেন উত্তমকুমার!
যেমন কথা, তেমনই কাজ। একদিন আমাদের বাড়িতে এলেন উত্তমকুমার। আমার বাবা শশধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। আমি বাবার পাশেই বসেছিলাম। বাবা রাজি হলেন। আমি উত্তমকুমারের নাটকের দলে অভিনয় করার অনুমতি পেলাম। ওঁদের কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পরেই, বাবা উত্তমকুমারের কাছ থেকে অগ্রিম চাইলেন। বললেন, ‘তুমি আ্যাডভান্স দিয়ে যাও।’ বাবার মুখে এ কথা শুনে আমার মনে হল, পৃথিবী দু’ভাগ হয়ে যাক, আমি নীচে চলে যাই। নিজের মনেই প্রশ্ন করলাম, বাবার এত সাহস উত্তমকুমারের কাছ থেকে আমার অভিনয়ের জন্য অ্যডভান্স চাইলেন! দেখলাম, উত্তমকুমারও কালবিলম্ব না করে পকেট থেকে টাকা বার করে বাবার হাতে ধরিয়ে দিলেন। উনি কত টাকা দিয়েছিলেন, তা জানতে চাইনি। বাবাও বলেনি।
এই ঘটনার পর আমার ‘প্রিয় বাবা’ আমার কাছে সব থেকে খারাপ লোক হয়ে গেল। দু’দিন কথা বলিনি। উত্তমকুমার চলে যাওযার পর আমি বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করে বাবাকে বললাম, ‘তুমি ওঁর কাছ থেকে টাকা চাইতে পারলে?’
বাবার জবাব, ‘সংসার চলে না, ঘরে অভাব, টাকা তো দরকার। তাছাড়া তুই তো কলকাতায় কাজ করতে এসেছিস। কাজের বিনিয়মে টাকা তো প্রাপ্য। আমি উত্তমকুমারের কাছ থেকে টাকা চেয়েছি তোর কাজের বিনিময়ে।’
আমি বললাম, ‘উনি তো আমার অভিনয় পছন্দ নাও করতে পারেন। তখন?’
বাবা বললেন, ‘তোর অভিনয়ের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা আছে বলেই তো অ্যাডভান্স নিয়েছি।’
তার পরের ঘটনা ক্রমশ ইতিহাস লিখে গেছে বাংলা ছায়াছবির পর্দায়।
অনুলিখন: অশোক সেন
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন