আলো জ্বলছে শুধু নীরজার ঘরে
পূর্ণেন্দু পত্রী (Purnendu Pattrea) ছিলেন এককথায় পলিম্যাথ। লেখক, কবি, চিত্রকর ও সম্পাদক তো ছিলেনই, চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার। খুব বেশি ছবি পরিচলনা করেননি। তাঁর তৃতীয় ছবি ‘মালঞ্চ’-এর সেটে সে দিন উপস্থিত ছিলেন স্বপনকুমার ঘোষ। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই প্রতিবেদনের পুনর্মুদ্রণ
টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়া অন্ধকার। কারণ লোডশেডিং। আলো জলছে শুধু নীরজার ঘরে। পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর রঙিন ছবি ‘মালঞ্চ’-এর শুটিং করছেন নির্বিঘ্নে। তিনি কাজ করছেন জেনারেটর নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘মালঞ্চ’-এর নায়িকা নীরজা এখন একটি ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে আছে। তাঁর পরনেও ধবধবে সাদা শাড়ি, কালো পার। ঘরের চারদিকে আলো রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শুধু জোরালো আলো এসে পড়েছে বিছানায়।
ধবধবে সাদা বালিশে খানিকটা ভর করে উঠে বসার চেষ্টা করছে নীরজা। তার চোখ দু’টি জ্বলছে। ক্যামেরার ফোকাস সেদিকেই। বিশ্বের সবকিছু একদিকে। আর অন্য দিকে কেবল সে রয়েছে, এই ঘরের কোণে, ভাঙা প্রাণ নিয়ে। পুরুষমানুষ দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে। মেয়েরা যুগে-যুগে দুঃখ কেবল সহ্যই করে। চোখের জল আর ধৈর্য। এছাড়া তো কিছু সম্বল নেই তাদের। আজ কেবল মনে পড়ছে সেই দিনের ছবি। বেশিদিনের কথা নয়, তবু মনে হয় যেন একটা তেপান্তেরর মাঠ পেরিয়ে যুগান্তরের ইতিহাস। সেই সোনার রঙে রঙিন দিনগুলোকে ছিঁড়ে ফিরিয়ে আনতে চায় কোনও দস্যুর কাছ থেকে। বিদ্রোহী মন কাউকে সামনে পায় না কেন? ভালোমানুষের মতো মাথা হেট করে ভাগ্যকে মেনে নেওরা মেয়ের নয় নীরজা। তার ভালোবাসার ছিল প্রচণ্ড জেদ। সেই ভালোবাসার বিরুদ্ধে বিধাতার হস্তক্ষেপ তার কল্পনার আতীত। ওর মনের মধ্যে যে রস ছিল নিছক মিষ্ট আজ কেন তা হয়ে গেল কটু! যেমন আজকাল দুর্বল শরীরটা ওর অপরিচিত, তেমই স্বভাবটাও যেন ওর চেনা নয়। সে স্বভাবে কোনও দাক্ষিণ্য নেই। নীরজার আজকাল মনটা বাদুড়ের চঞ্চুক্ষত ফলের মতো, ভদ্র প্রয়োজনের অযোগ্য।
আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
দুপুরের ঘণ্টা বাজল! মালিরা গেল চলে। গোটা বাগান নির্জন। নীরজা তাকিয়ে রইল, যেখানে দুরাশার মরীচিকাও আভাস দেয় না। যেখানে ছায়াহীন রৌদ্রে শূন্যতার পরে শূন্যতার অনুবৃত্তি।
অক্ষম শরীর নিয়ে নীরজার নিজের ওপর অবিশ্বাস জন্মেছে। রাগে সে কাঁপছে। কোথা থেকে তার দেহে এল অস্বাভাবিক জোর। সে প্রায় উঠে বসল। চোখের তারা প্রসারিত হয়ে জ্বলতে লাগল। কণ্ঠস্বর তীক্ষা হলো: ‘চলে যা, তুই এখান থেকে চলে যা। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না।’
আরও পড়ুন: ফের বাংলার সুরে শান্তনু মৈত্র
কাট! শট শেষ। নীরজার চরিত্রাভিনেত্রী মাধবী চক্রবর্তী খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। ফ্লোরে উপস্থিত সকলে চুপ। কেউ কোনও কথা বলছে না। অথচ শুটিং প্যাকআপ ঘোষণা করেছেন পূর্ণেন্দু।
প্রথমে মাধবী বেরিয়ে এলেন ফ্লোর থেকে। কারও সঙ্গে কথা বললেন না। সোজা চলে গেলেন নিজের মেকআপ রুমের দিকে। ধীরে-ধীরে সকলে বেরিয়ে এলেন ফ্লোর থেকে। একদম শেষে বেরোলেন পরিচালক।
পূর্ণেন্দুর সঙ্গে কথা হলো। জানা গেল, ইনডোর শুটিংয়ের পর্ব প্রায় শেষ। চলতি পর্যায়ের কাজ ছবির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ছবির প্রত্যেক শিল্পী অংশ নিচ্ছেন। নীরজার স্বামীর ভূমিকায় রূপদান করছেন নবাগত ধ্রুব মিত্র। সরলার ভূমিকায় রয়েছেন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়। হলা মালি মালির চরিত্রে অভিনয় করছেন রবি ঘোষ। রমেনের ভূমিকায় রয়েছেন সন্তু মুখোপাধ্যায়। কাজের লোকের চরিত্রে রয়েছেন দিপালী চক্রবর্তী। ছবির চিত্রগ্রহণ করছেন পান্তু নাগ, সম্পাদনায় অরবিন্দ ভট্টাচার্য।
প্রথম প্রকাশ: আনন্দলোক, সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

			



