লোডশেডিং রেশনিং করার দাবি সত্যজিৎ, উত্তম, সৌমিত্রদের (পর্ব ২)
প্রায় প্রতিদিনই প্রতিটি ছবির বাড়তি দিন শুটিং করতে হচ্ছিল সেই সময়। বিদ্যুৎ ঘাটতির কবলে পড়েছিল বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করেছিল স্টুডিয়ো পাড়ার এক প্রতিনিধি দল। প্রতিবেদন লিখেছিলেন স্বপনকুমার ঘোষ। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই প্রতিবেদনের শেষ পর্ব
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিকল্প ব্যবস্থা কী হতে পারে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মালঞ্চ’ অবলম্বনে একই নামের ছবি পরিচালনা করছেন পূর্ণেন্দু পত্রী। তিনি শুটিং করছেন নিশ্চিন্তে। না, তাঁর সেটে আলোর প্রতীক্ষায় কেউ প্রহর গুনছেন না। ঘামে শিল্পীদের মেকআপের প্রলেপ ধুয়ে যাচ্ছে না। কলাকুশলীদের দৈনিক রুজি রোজগারে টান পড়ছে না। পূর্ণেন্দু জেনারেটর চালিয়ে কাজ করেছেন। সকাল ১০টা থেকে প্রতিদিন জেনারেটর চালু হচ্ছে। শুটিং শুরু হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে জেনারেটর ছাড়া কোনও উপায় দেখছেন না তিনি। জানালেন, “আমি চলতি পর্যায়ের শুটিং বাজেটে জেনারেটরের প্রভিশন রেখেছিলাম। হিসেব করে দেখেছি এতে সুবিধা হয়। পরিকল্পনামতো কাজ করা যায়। আর আমার মতো পরিচালক যাঁরা কম বাজেটে ছবি তৈরি করেন, তাঁদের সরকারি আলোর জন্য অপেক্ষা করতে হলে কাজ করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে উঠবে। আমি চলতি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আবার বলতে বাধ্য হচ্ছি, জেনারেটর ছাড়া কোনও উপায় নেই। আমার সেই টাকা নেই যে প্রয়োজন মতো দশ দিনের শিডিউল পনেরো দিন পর্যন্ত বাড়াতে পারব। এছাড়া শিল্পীদের ডেটের ব্যাপার আছে। ফ্লোরও খালি পেতে হবে। কলাকুশলীদেরও ডেট পেতে হবে। জেনারেটর নিয়ে কাজ করতে যদি বাজেট একটু বাড়েও, আখেরে লাভ আছে। তবে প্রচণ্ড স্ট্রাগল করে কাজ করতে হচ্ছে, এতে সন্দেহ নেই।”
এক নাগাড়ে বেশিক্ষণ জেনারেটর চালানো যাচ্ছে না। ময়লা জমে যাচ্ছে মেশিনে। ময়লা পরিষ্কার করবার জন্য সময় দিতে হচ্ছে। সেই সময়টুকুও যে সরকারি আলোর ওপর নির্ভর করা যায়, এমন উপায় নেই।
“আজ যেমন আলো সময় বুঝে এল,” বললেন পূর্ণেন্দু, “আমরা সকলে যখন লাঞ্চ করছি। জেনারেটর না থাকলে সবাইকে খাবার ফেলে দৌড়তে হতো। তাই গোটা শিডিউল জেনারেটরের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। গতকাল তিনঘণ্টা আগে শুটিং শেষ করেছি। আজ ঠিক সময়ে শুটিং শেষ করতে চলেছি। এতে বরং লাভ হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে তাঁদের যাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আলো আসবে বলে অপক্ষা করে বসে আছেন।”
আরও পড়ুন: “উত্তমদাই প্রথমে খবরটা দেখালেন”
ঠিক যেমন নিউ থিয়েটার্সের দিলীপ সরকারের স্টুডিয়োতে। গিয়ে দেখলাম ‘প্রেয়সী’ ছবির নায়িকা আরতি ভট্টাচার্য মেকআপ রুমের বাইরে চেয়ার পেতে বসে আছেন। ঘামে মুখের মেকআপের প্রলেপ সামলাতে ব্যস্ত। একটা খবরের কাগজ হাতপাখা হিসেবে ব্যবহার করছেন। নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কোথায়? তাঁকে ক্যান্টিনের সামনে গাছের ছায়ার নীচে পাওয়া গেল। দেখেই বুঝলাম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। জামার সবক’টি বোতাম খোলা, সম্পূর্ণ ঘামে ভেজা।
এমন সময় উত্তমকুমার হন্তদন্ত হয়ে সেখানে এলেন। নিভৃতে উত্তম-সৌমিত্রের কথা হলো কিছুক্ষণ। দু’জনেই উত্তেজিত। সম্ভবত লোডশেডিং নিয়েই কথা হলো। কখন তাঁরা জ্যোতিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, তাও বোধহয় ঠিক করলেন।
একটু দূরে দেখলাম ‘প্রেয়সী’র পরিচালক শ্রীকান্ত গুহঠাকুরতা বিষণ্ণমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখা হলো ‘সন্ধি’ ছবির পরিচালক অমল দত্তের সঙ্গেও। তিনি বললেন, “গত পাঁচদিনে লোডশেডিংয়ে সবথেকে বেশি অ্যাফেকটেড হয়েছি আমরা। অনেক কষ্টে আটদিনে শিডিউল শেষ করেছি। বিয়েবাড়ির সেট ছিল। পাঁচদিনের ফুলের জন্য যে টাকা বরাদ্দ ছিল তার দ্বিগুণ লেগেছে। প্রতিদিন সেটে তিন হাজার টাকার ফল লেগেছে। এইবার হিসেব করুন ফুলের জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। তার ওপর প্রচুর জুনিয়র আর্টিস্ট ছিলেন। তাঁদের পার ডে পেমেন্ট। সেটাও বেড়েছে। দিন বেড়েছে বলে স্টুডিয়োকেও বেশি টাকা দিতে হয়েছে। এভাবে বাড়তে থাকলে ছবির বাজেট কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে অনুমান করুন। আমরা ছবি তৈরি করব কী করে? একে তো বাংলা ছবির এই অবস্থা। তার ওপর লোডশেডিংয়ের বাড়তি বোঝা। সমস্যার আশু সমাধান না হলে ধীরে-ধীরে প্রযোজকের সংখ্যা কমবে।”
আরও পড়ুন: পরিবেশ-রাজনীতির এক মায়াবী ইস্তাহার
সরকারের থেকে আশ্বাস পাওয়া গেল কি?
মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবুর সঙ্গে দেখা করেন সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray), উত্তমকুমার (Uttam Kumar), সৌমিত্র, ভূপেন হাজারিকা ও ওড়িয়া ছবির প্রযোজক-অভিনেতা ধীরু বিসোয়াল। পূর্বভারতের চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বনাশা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিধি দল তাঁদের আবেদন রাখেন মুখ্যমন্ত্রী সমীপে।
সত্যজিৎ: টালিগঞ্জ স্টুডিয়োপাড়ায় আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সপ্তাহে চারদিন অর্থাৎ সোম, মঙ্গল, বুধ ও শুক্রবার, বারো ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ চাইছি।
মুখ্যমন্ত্রী: আমি আপাতত সপ্তাহে তিনদিনের জন্য ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কিন্তু কবে থেকে কোন-কোন দিন ১২ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ দিতে পারব এখনই তা বলতে পারছি না। পরে জানিয়ে দিচ্ছি।
সত্যজিৎ: জেনারেটর বসানোর কথাও ভেবে দেখা যেতে পারে।
মুখ্যমন্ত্রী: ভেবে দেখব।
ভূপেন: আসামের আঠারোটা ছবির কাজ এখানে হবে বলে ঠিক হয়ে আছে। এই অবস্থা চললে প্রযোজকেরা বম্বে (মুম্বই) বা মাদ্রাজ (চেন্নাই) চলে যাবে। এছাড়া উপায় কি?
মুখ্যমন্ত্রী: আমরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করছি।
(সমাপ্ত)
প্রথম প্রকাশ: আনন্দলোক, সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন