Features

‘‘মাধু, কেমন আছ’ আদায় করে নিয়েছিলাম’

মাধবী মুখোপাধ্যায়: সম্ভবত ১৯৬৪ সালের কথা। উত্তমকুমারের সঙ্গে আমার প্রথম ছবি হীরেন নাগের ‘থানা থেকে আসছি’ (Thana Theke Aschhi)। উত্তমকুমারের সঙ্গে এই ছবিতে কাজ করবার আগে সেভাবে আলাপ হয়নি। সদা হাসিখুশি মানুটিকে স্টুডিয়োতে দূর থেকে দেখতাম। কথা বলা বা আলাপের সুযোগ হয়নি।

সুযোগ এল হীরেনবাবুর ছবিতে কাজ করার সুবাদে। তবে এই ছবিতে তাঁর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করিনি। ছবিটা ছিল একটা বিদেশি নাটকের বিন্যাস। উত্তমকুমার (Uttam Kumar) ছিলেন এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্রে।

একদিন দক্ষিণ কলকাতার রাধা স্টুডিয়োতে হীরেনবাবু আমাকে ডাকলেন। সেদিন উত্তমবাবুরও শুটিং ছিল। সেটা অবশ্য অন্য ছবির। তাঁর কথামতো আমি সেখানে গেলাম। পরিচালক আমাকে উত্তমবাবুর মেকআপ রুমে নিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ‘ম্যাডাম, নমস্কার’ বলে বসতে বললেন।

প্রথম সাক্ষাতে উনি আমাকে যেভাবে স্বাগত জানালেন, তাতে আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। লজ্জাও পেলাম। তারপর ওঁকে বললাম, ‘আপনাকে একটা কথা বলব, ক্ষমা করে দেবেন?’ উনি বললেন, ‘নিঃসঙ্কোচে বলুন।’ আমি বললাম, ‘আমরা তো বাংলায় বসবাস করি, এখানে কেন ‘ম্যাডাম’ শব্দটা ব্যবহার করব? আপনি আমাকে কখনও ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকবেন না। আপনি বড়মাপের মানুষ। আমরা আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আমরা যদি চেয়ারে বসে থাকি, আপনি যদি আসেন, তাহলে আপনাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা-সম্মান জানাব।’

আরও পড়ুন: অনন্য মায়াময় ফ্রেম তৈরি করে ‘ডিয়ার মা’

উত্তমবাবু আমার মুখে এ কথা শুনে স্মিত হেসে বললেন, ‘যেসব মেয়ে বা মহিলারা আমার কাছে আসেন, তাঁদের দেখে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাই।’

আমি বললাম, ‘এটা আমাদের দেশীয় কায়দা নয়, বিদেশিদের জন্য প্রযোজ্য। আপনি অভিনয়ের যে স্থানে রয়েছেন, সেখানে আপনার উঠে দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের উচিত আপনার পায়ের সামনে বসার।’

আমার কথা শেষ হতে না হতেই উনি বলে উঠলেন, ‘ছিঃ-ছিঃ কী যে বলেন, কক্ষণও এমন কথা বলবেন না।’

উত্তমবাবু প্রথম দেখাতেই আমার মন জয় করে নিলেন। তবে এতকিছু বলার পরেও পরবর্তীকালে তিনি আমাকে ম্যাডাম বলার অভ্যাসটি ছাড়তে পারেননি। ওভাবেই ডাকতেন। তেমনই আমিও আলাপ-পরিচয়ের প্রথমদিন থেকেই উত্তমকুমারকে ‘উত্তমবাবু’ বলেই ডাকতাম। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ‘থানা থেকে আসছি’ ছবিতে তাঁর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার না করলেও মাঝেমধ্যে অল্পবিস্তর কথাবার্তা হতো। এবং সেই এক ভঙ্গিমায় হাতজোড় করে বলতেন, ‘এই যে ম্যাডাম কেমন আছেন?’ এই সম্বোধন থেকে ‘কেমন আছ’ আমি আদায় করে নিয়েছিলাম। তারপর থেকে উত্তমবাবু ‘মাধু, কেমন আছ’ বলতেন।

আরও পড়ুন: বিশেষ চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠী

উত্তমবাবুর সঙ্গে আমার দ্বিতীয় ছবি অগ্রগামীর ‘শঙ্খবেলা’। ছবিটি ১৯৬৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল। এই ছবিতে কাজ করতে গিয়ে অনেক মজার ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

‘শঙ্খবেলা’য় উত্তমকুমার সুপারহিরো, আমি হিরোইন। এই ছবিতে কাজ করার সময় যতবার একটু সঙ্কোচবোধ করে মনে করছি উত্তমবাবু হিরো, আমি সামান্য একজন হিরোইন, উনি ততবার আমার সঙ্গে এত সুন্দর ব্যবহার করছেন যে আমি তাতে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিলাম।

‘কে প্রথম কাছে এসেছি/কে প্রথম চেয়ে দেখেছি’ গানের দৃশ্যটি টেক করার কথা আজও মনের কোঠায় ভাস্বর হয়ে আছে। শিহরিত হই। যখন ক্লোজ শট টেক করা হচ্ছে, তখন উত্তমবাবু আর আমি। আর লং শটে কিন্তু উত্তমবাবু নেই। সেখানে তাঁর জায়গায় একজন সাহেব। আমাদের একটা প্রবাদ আছে: যিনি যতবড় চিটার, তিনি ততবড় ফিল্মমেকার! পরিচালক সরোজ দে ভালো চিট করতে পারতেন, তাই তিনি বড়মাপের পরিচালক ছিলেন। অন্তত আমার কাছে।

আরও পড়ুন: ভয়ের ছবিতে তনুশ্রী, দেবরাজ

কণ্ঠশিল্পী উত্তমবাবু সম্পর্কে আরেকটু কথা উল্লেখ করতেই হয়। আমি যখন জাতীয় পুরস্কার পেলাম, সেইসময় উত্তমবাবু আমাকে সংবর্ধনা দেওয়ার উদ্যোগে নিয়েছিলেন। তিনি অভিনেতৃ সঙ্ঘের সভাপতি ছিলেন। এই সংগঠনের ব্যানারে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় অরোরার অফিসে। সবথেকে আশ্চর্যের কথা, শুটিং জ়োনে দেখেছি, উনি কখনও নবাগত কিংবা অপরিচিত শিল্পীদের অন্য চোখে দেখতেন না। সক্কলকে শিল্পী হিসেবে সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহ করতেন। ‘বনপলাশীর পদাবলী’তে কাজ করতে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে আছে।

উত্তমবাবু একবার অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর তাঁকে সম্মাননা জানানো হয়। সেদিন ওঁকে গান গাইবার জন্য অনুরোধ করা হয়। উনি তখন ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’ গানটি গেয়েছিলেন। অসাধারণ ছিল তাঁর কণ্ঠ। উত্তমবাবু কণ্ঠে বহুবার নানা ধরনের গান শুনেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। এলাহাবাদে ‘শঙ্খবেলা’র কাজ করতে গিয়ে এক ঘরোয়া পার্টিতে তাঁর কণ্ঠে একাধিক গান শোনার স্মৃতি আজও উজ্জ্বল। ওখানে এক মহিলা ডাক্তার তাঁর বাড়িতে আমাদের পুরো ইউনিটকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পার্টিতে সেই ডাক্তার নিজেও গান গেয়েছিলেন। গান গেয়েছিলেন উত্তমবাবুও। সবই রবি ঠাকুরের গান। সেদিন উত্তমবাবু দারুণ মুডে ছিলেন। ওই মহিলার অনুরোধে একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন। সবাই তো দারুণ খুশি। অবশেষে তিনি থামলেন। মানে, তাঁকে থামাতে হল। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। পরদিন সকাল থেকে শুটিং। সময়ের মধ্যে সকলকে হাজির হতে হবে তো!

আরও পড়ুন: হালচাল ঠিকঠাক হ্যায়

একইভাবে উত্তমবাবুর সঙ্গে একের পর এক কাজ করেছি। উনি একটা সংসদ করেছিলেন। তার নাম সকলেই জানেন। শিল্পী সংসদ। এই সংসদে আমিও ছিলাম।  উনি চলে যাওয়ার পরও ছিলাম। এখনও আছি, থাকব। অজিত লাহিড়ির ‘গড় নসিমপুর’, অগ্রগামীর ‘ছদ্মবেশী’, মানু সেনের ‘বিরাজ বৌ’, যাত্রিকের ‘ছিন্নপত্র’, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘অগ্নীশ্বর’-এর মতো ছবিতে উত্তমবাবু সঙ্গে কাজ করেছি। অনন্য সব অভিজ্ঞতা। উত্তমবাবুর বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার অভিনয়-জীবনের সঙ্গে। কোনটা আগে বলব, কোনটা পরে, খেই হারিয়ে ফেলছি।

‘ছদ্মবেশী’র কথা খুব মনে পড়ে। এটারও আউটডোর হয়েছিল এলাহাবাদে। এই মুহূর্তে হোটেলের নাম মনে পড়ছে না। বহু পুরনো এবং বড় হোটেল। সেই হোটেলের একটা ঘরে আমি আর অনুভাদি (গুপ্ত) থাকতাম। পাশের ঘরেই ঘরে থাকতেন উত্তমবাবু আর বেণুদি। আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেখানে বিকাশদাও (রায়) ছিলেন। এত বড় ইউনিট, তাই অন্য হোটেলেও অনেককে থাকতে হয়েছিল। যেমন জহরদা (রায়) ছিলেন। এরকম ছড়ানো-ছিটানো ব্যবস্থায় আমাদের কাজ করতে হয়েছিল।

একদিন প্যাকআপের পর হোটেলের ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ জহরদা এসে বললেন, ‘মাধু একটা পান খাওয়া তো।’ আমি পান সাজাচ্ছি। আর তখন জহরদা এদিক-ওদিক ঘুরে-ঘুরে কী সব দেখছেন। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন একটা পর্দা। সরিয়ে দেখলেন একটা দরজা। বললেন, ‘পর্দার আড়ালে দরজা দেখছি।’ জহরদা খুব রসিক মানুষ ছিলেন। পর্দা সরিয়ে দেখলেন দরজার মাঝে ছোট্ট একটা ফুটো। ওই ফুটোতে চোখ রেখে দেখতে পেলেন পাশের ঘরেই রয়েছেন উত্তমবাবু এবং বেণুদি। জহরদা তখন চিৎকার করে বললেন,  ‘অ্যাই উতু, ঘরে কী করছিস?’

Uttam Kumar

আমি সঙ্গে-সঙ্গে জহরদাকে হাত ধরে টেনে বললাম, ‘কী করছেন? ওরকম করবেন না। উত্তমবাবু, বেণুদি কী ভাববেন বলুন তো?’ তা জহরদা বারণ শোনার লোক নন। ওঁদের ডেকেই যাচ্ছেন। তখন আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে জোর করে হাত ধরে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে এসে মুখে পান গুঁজে দিলাম। উনি থামলেন। তারপর তো বিষয়টা আমরা জেনে গেলাম।

এসব জেনে যাওয়ার পর একদিন আমরা এক ফন্দি আঁটলাম। সেই হোটেলের ছাদে গিয়ে উত্তমবাবু আর বেণুদির ঘরের স্কাই উইন্ডো আবিষ্কার করলাম। ছাদেই নয়নতারা ফুলের গাছ ছিল। আমরা সেই গাছ থেকে প্রচুর ফুল পাড়লাম। তারপর সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলাম। দেখার পর বললাম, ‘সুপ্রিয়া দেবী, আপনার পতিসেবায় সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর আপনাকে পুষ্পবৃষ্টি করল।’ এই বলে স্কাই উইন্ডো থেকে ফুলগুলো ছড়িয়ে দিলাম। এই কাজটা আমি আর অনুভাদি করেছিলাম। সাক্ষী ছিলেন জহরদা, বিকাশদা। আমাদের এই কাণ্ড দেখে উত্তমবাবু আর বেণুদি বললেন, ‘এই দুটো ভারী বদমায়েশ। ওদের নিয়ে আর পারা যায় না। আমাদের পিছু ছাড়তে চায় না।’

অনুলিখন: অশোক সেন

পরের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন


Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *