Features

‘এক্সরে আইজ় নামেই পরিচিত হয়ে গেলাম’

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

মাধবী মুখোপাধ্যায়: ‘ছদ্মবেশী’ নিয়ে আরেকদিনের ঘটনা মনে পড়ছে। সেদিন প্যাকআপ হয়ে গিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে হোটেলের ঘরে বসে আছি। এমন সময় বেণুদি এসে বললেন, ‘জানিস মাধু, একটা মেয়ে এসে উতুকে খুব জ্বালাচ্ছে। তোদের রক্ষা করতে হবে।’ আমি বললাম, তুমি চিন্তা করো না। আমরা দু’জন আছি, সব ব্যবস্থা করে দেব। তারপর যখন দেখতাম উত্তমবাবুর ঘরে কেউ এসেছেন, বা যাওয়ার জন্য উঁকি দিচ্ছেন, তখনই আমি আর আনুভাদি এক একজনকে ঘরের ভেতর পাঠিয়ে দিতাম। তারা বলত, ‘দাদা খেয়েছেন?’ কেউ বলতেন, ‘উত্তমদা খেয়েছ? এখন কি খাবে? স্ক্রিপ্টটা তাহলে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ এরকম সব কথা। এই কথা শুনে অনেকে ভাবতেন বোধহয় উত্তমকুমারের লাঞ্চ হয়নি। অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন।

ওইদিনেরই আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। উত্তমবাবু লাঞ্চ সেরে শট দিতে গিয়েছেন। আমাদের দু’জনের মুখোমুখি। আমাদের দু’জনকে দেখে মুচকি হাসলেন। ওই হাসি দেখেই আমার মনে হল, কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দাদা কোনও অসুবিধা হয়নি তো? সব ঠিকঠাক আছে?’

পরিচালক শট নিলেন। দেখা গেল তিন-চারটে শট পরপর এনজি হল। ব্যাপারখানা কী? সরোজদার মুখটাও কেমন যেন দেখাচ্ছিল। এমন তো হওয়ার কথা নয়। আমি আর অনুভাদি দু’জন চুপ করে বসে আছি। তখন ছবির পরিচালক খোকাদাকে (বিভূতি লাহা) ডেকে উত্তমবাবু বললেন, ‘এই দুটোকে বার করে দিন তো। ওরা থাকলে আমি শট দেব না।’ খোকাদা এই কথা শুনে উত্তমবাবুকে বললেন, ‘আমি দু’কান মুলছি, পরের ছবিতে ওদের নেব না।’ উনি লোক দেখানো রাগ করে বললেন, ‘তোমরা দু’জন ফ্লোর থেকে বেরিয়ে যাও।’ আমরা দু’জন হাসিমুখে বেরিয়ে গেলাম। তারপর এক শটে সবকিছু ওকে। এই হল উত্তমবাবু।

আরও পড়ুন: ‘টাকা চেয়ে বসলেন বাবা’

সেই পুষ্পবৃষ্টির ঘটনার পর থেকে উত্তমবাবু আমাকে সামনে দেখলে বলতেন, ‘এই যে এক্স-রে আইজ়, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? একটু সাবধানে থেকো। সবদিকে তাকানোর দরকার নেই। তোমার এক্স-রেতে দেখছি আমাদের সবকিছু ধরা পড়ছে।’

তারপর থেকে ওঁর কাছে আমি এক্স-রে আইজ় নামেই পরিচিত হয়ে গেলাম।

এই ঘটনার পর আমি সবসময় হাতের কাছে একটা পান রাখতাম। পাছে যদি উত্তমবাবুর মুখোমুখি হই তাহলে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে পানটা মুখে পুরে দিয়ে রেহাই পাব।

আর যাই হোক না কেন, উত্তমকুমার বাবুই ছিলেন। তাঁর কথাবার্তা, চালচলন, ব্যবহার, আচার-আচরণ ছিল বাবুর মতোই। সকলকে খুব ভালোবাসতেন। টিমওয়ার্ক ভালো বুঝতেন। গুছিয়ে কাজ করতে পারতেন। মনটা ছিলেন খুব উদার। ছিলেন দয়ালু। নীরবে অনেক শিল্পী ও কলাকুশলীদের সাহায্য করতেন।

আরও পড়ুন: মৃণাল সেনের ছবি থেকে বাদ পড়লেন অমিতাভ বচ্চন

একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি, কোন ছবির সেটে সেটা ঘটেছিল তা আজ আর মনে নেই। একদিন উত্তমবাবু আর আমি শট দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। এমন সময় দেখলাম, উনি কী যেন লক্ষ করছেন। শট শেষ হয়ে যাওয়ার পর একজন মেকআপ ম্যানের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁ রে, তুই মুখটা এমন ব্যাজার করে আছিস কেন? কীসের চিন্তা?’ সেই মেকআপ ম্যান বললেন, ‘দাদা, মেয়ের বিয়ে। খুব চিন্তায় আছি।’ এ কথা শুনে উত্তমবাবু বললেন, ‘মেয়ের বিয়ে বলে শুকনো মুখ করে বসে আছিস? কত টাকা লাগবে?’

এ কথা শুনে মেকআপ ম্যান বললেন, বিয়ের সব প্রস্তুতি নিয়েছি। কিন্তু পণের ₹৫,০০০ জোগাড় করতে পারিনি। উত্তমবাবু বললেন, ‘ওসব নিয়ে ভাবিস না। মন দিয়ে কাজ কর। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আরও পড়ুন: ‘এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে’

উত্তমবাবু অন্য একজনের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিলেন। বিয়ের ঠিক কিছুদিন আগে উত্তমবাবু স্বয়ং সেই মেকআপ ম্যানের বাড়িতে হাজির হয়ে তাঁর হাতে সেই টাকা তুলে দিয়েছিলেন।

পরিচালক হিসেবে উত্তমকুমারকে পেয়েছিলাম ‘বনপলাশীর পদাবলী’ (Bon Palashir Padabali) ছবিতে। ১৯৭৩ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। ছবির কাজ যখন শেষ হল, তখন সবাই বলল, টানা চারঘণ্টা ধরে মানুষ এই ছবি দেখবে না। সময়সীমা কমিয়ে দুই-আড়াই ঘণ্টার মধ্যে আনা হোক। সকলেই রাজি হল, পরিচালক ছাড়া।

কিন্তু কেন?

উত্তমবাবু বললেন, ‘ছবি চারঘণ্টারই থাকবে। আমি কোনও শিল্পীকে অসম্মান করতে চাই না।’

তাঁর কথাই রইল। সেই চারঘণ্টার ছবি সুপারহিট হল।

উত্তমবাবু খেতে খুবই ভালবাসতেন। তবে সব ধরনের রান্না উনি পছন্দ করতেন না। আমার হাতের রান্না কোনওদিন খাননি। বেণুদির হাতের রান্না উত্তমবাবু খেতে পছন্দ করতেন। আমিও বেণুদির হাতের রান্না খেয়েছি। বেণুদি রান্না করে আনলে আমিও ভাগ বসাতাম। আর উত্তমবাবু-বেণুদির শুটিং মানেই নানা পদের লাঞ্চ।

আরও পড়ুন:  ‘এক ফিল্ম হিরোর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি’

উত্তমবাবুর দু’বাড়িতেই লক্ষ্মীপুজো হতো। উনি নিজে খেতে ভালোবাসতেন এবং খাওয়াতেও। নিজেই পরিবেশন করে অতিথি আপ্যায়ন করতেন। আমি নিমন্ত্রিত থাকতাম। কিন্তু কোনওদিন যাইনি। আমার মন বলেছে যাওয়া উচিত নয়। কারণ, ওই দুই বাড়ির সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক। তাছাড়া আমার বাড়িতেও আমি ছোট্ট করে পুজো করি। সেজন্য কারও বাড়ি যাওয়া পছন্দ করি না। একাই থাকতে ভালোবাসি। আমার অবসরের সঙ্গী বই। যে-কোনও ধরনের বই হলেই হল। তাতেই আমার সময় কেটে যায়। শখ বলতে ওইটুকু। আর অবশ্যই পান। সে অভ্যাস আজও ছাড়তে পারিনি।

এবার আমার বিয়ের কথা বলি। আমার বিয়েতে উত্তমবাবু বরকর্তা ছিলেন, এ কথা সকলেই জানেন। বিয়েতে একটা ঘটনা ঘটেছিল। কথা ছিল, উত্তমবাবু সঙ্গে করে বর (নির্মলকুমার) নিয়ে আসবেন। এদিকে লগ্ন চলে যাচ্ছে। কিন্তু বর আসছে না। আমার বাপেরবাড়ির লোকজন খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কী হবে! ওদিকে স্বয়ং বরও চিন্তিত। কখন উত্তমদা আসবেন! হঠাৎ নীচ থেকে চিৎকার শোনা গেল, ‘নেমে আয় নিমু, গাড়ি রেডি।’ তারপর উত্তমবাবু নির্মলকুমারকে সঙ্গে নিয়ে বরকর্তা সেজে বিয়ের আসরে হাজির। থাক সে কথা। সেসব তো আমার জীবনে ইতিহাস হয়ে রয়েছে।

Uttam Kumar

সে দিন ছিল ২৪ জুলাই, ১৯৮০। বৃহস্পতিবার। আমি সেই সময় কাশী বিশ্বনাথে মঞ্চে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘না’ থিয়েটারে অভিনয় করছিলাম। থিয়েটার সেরে বড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসব, এমন সময় লালবাজার থেকে ল্যান্ডলাইনে একটা ফোন এল। ওপার থেকে একজন বললেন, ‘আমি লালবাজার থেকে বলছি। আপনি কি মাধবী মুখোপাধ্যায়? আপনার বাড়িতে নাকি সমাজবিরোধীরা ঝামেলা করছে? বলুন, আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

এমন প্রশ্ন শুনে আমি বললাম, ‘না তো। দিব্যি আছি। এইমাত্র নাটক করে বাড়ি ফিরে খেতে বসেছি।’

তারপর প্রসঙ্গ এড়িয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘জানেন আজকে শুটিং করতে গিয়ে উত্তমকুমার মারা গিয়েছেন?’ এ কথা শুনে রেগে গিয়ে বললাম, ‘মশাই, ফোনটা রাখুন!’ বলে আমি রিসিভারটা ধড়াস করে রেখে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। ভাবলাম, আমার বাড়িতে যেমন হামলার খবরটা মিথ্যে, উত্তমবাবুর মৃত্যুর খবরটাও নিশ্চয়ই মিথ্যে। তবু মন মানতে চায় না। আচমকা এ খবর শুনে খাওয়াদাওয়া মাথায় উঠল। সাতপাঁচ ভাবছি এমন সময় ফের ফোনটা বেজে উঠল। ফোন করলেন পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের দাদা অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যাযয়। ফোন করে বললেন, ‘জানিস মাধু, একটা খারাপ খবর আছে। উত্তম আর নেই।’ বলেই কেঁদে ফেললেন। তখন আমি বিশ্বাস করলাম উত্তমবাবু সত্যই মারা গিছেন।

সেদিন তো আর যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। পরদিন গিয়েছিলাম। সেদিন শুধু কলকাতা নয়, সারা বাংলার পাশাপাশি মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিও চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সকলের মুখে একটাই কথা ‘উত্তম তোমায় ভুলছি না, ভুলব না।’ তাঁর মৃত্যুর এতবছর পর আজও আমরা উত্তমবাবুকে ভুলিনি।

টিভিতে যখন উত্তমবাবুর ছবি দেখানো হয় তখন শত ব্যস্ততার মধ্যেও সেই ছবি দেখার চেষ্টা করি। বিশেষ করে তাঁর সঙ্গে যে ছবিগুলিতে অভিনয় করেছি, সেগুলো দেখি আর পুরনো স্মৃতি ভিড় করে আসে। ভেসে ওঠে ‘ছদ্মবেশী’র কথা। নীরবে অশ্রুপাত করি। আর ভাবি কে আর এখন বলবে ‘এক্স-রে আইজ়’। তখন চোখের জ্যোতি ছিল প্রখর। এখন ঝাপসা দেখি। চশমা ভরসা। সেই ঝপসা চোখেই উত্তমবাবুকে দেখি।

অনুলিখন: অশোক সেন

(সমাপ্ত)


Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *