‘ময়লা কাপড়টাও বদলে নিতে দিল না বুড়ো’
সেই অর্থে নায়িকার চরিত্রে তেমনভাবে তাঁকে দেখা না গেলেও প্রায় সব প্রথমসারির পরিচালকের ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুব্রতা চট্টোপাধ্যায় (Subrata Chatterjee)। তালিকায় রয়েছেন সত্যজিৎ রায়, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, অজয় করের মতো পরিচালকেরা। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নির্মল ধর। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ
নির্মল ধর: আপনি তো অনেকদিন হল অভিনয় করছেন। আপনার অভিজ্ঞতায় অভিনেত্রী হওয়ার প্রধান যোগ্যতা কী? অভিনয়ের ক্ষমতা না গ্ল্যামার নাকি যোগাযোগটাই বেশি প্রয়োজন?
সুব্রতা: অভিনেত্রী হওয়ার প্রধানতম যোগ্যতা নিঃসন্দেহে অভিনয়। আর সৌন্দর্যের গ্ল্যামার তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। শুধু সুন্দর চেহারা দিয়ে তো আর অভিনয় হতে পারে না। অভিনয় দিয়ে তবু কিছুটা গ্ল্যামার পুষিয়ে নেওয়া যায়। তবে গ্ল্যামার আর অভিনয়ক্ষমতা দুটো একসঙ্গে মিললে তো কথাই নেই। তাকে কেউই আটকাতে পারে না। যেমন আমাদের দাদা, উত্তমকুমারের (Uttam Kumar) কথা আর কী! যোগাযোগ বা সুযোগ যাই বলুন, এ ব্যাপারটা কিন্তু সেকেন্ডারি। সুযোগ করে দেওয়ার একটা চ্যানেল দরকার মানছি, কিন্তু এই যোগাযোগ কখনওই কাউকে বড় অভিনেত্রী করে দিতে পারে না।
প্রশ্ন: সৌন্দর্যের গ্ল্যামারে আপনার কিছুটা ঘাটতি থাকতে পারে। তবে অভিনয়ক্ষমতা এবং যোগাযোগ, এ দুটো জিনিসে তো আপনার ঘাটতি নেই। তবুও কেন আপনি এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও ভালো হিরোইনের রোল পেলেন না?
সুব্রতা: আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটাকে বোধহয় ভাগ্যই বলা যায়। যোগাযোগের অনেক চ্যানেল আমার আছে ঠিকই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী দাদা বা আমার স্বামী (তরুণকুমার) কখনও কারওর কাছে আমার জন্য বলেননি। এ জন্য আমার কোনও অভিযোগ বা অনুযোগ নেই। কারণ, দাদা বা স্বামী লোককে বলে একটা বা দুটো ছবিতে আমাকে সুযোগ করে দিতে পারেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তো আমাকেই এগোতে হবে। অনেকে বলেন শুনি, অমুক অভিনেতা ওই মেয়েটিকে তুলে দিচ্ছে। আমি এ ধরনের কথা একেবারে বিশ্বাস করি না। আমার বিশ্বাস কেউ কাউকে তুলতে পারে না। নামাতেও পারে না। যে যার ভাগ্যে ওঠে-নামে। এককালে তো উত্তমকুমারকে ফ্লপমাস্টার বলতেন ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই। আর এখন দেখুন তাঁর অবস্থা! সুতরাং একে ভাগ্য ছাড়া আর কী বলব?
আরও পড়ুন: অনন্য মায়াময় ফ্রেম তৈরি করে ‘ডিয়ার মা’
প্রশ্ন: ক’দিন আগে একটা গুজব শুনেছিলাম যে তরুণবাবু আর আপনার মধ্যে নাকি মানসিক মিলনের অভাব ঘটেছিল! আপনারা দু’জনে আলাদাও ছিলেন কিছুদিন! এই ঘটনায় যদি একটু আলোকপাত করেন।
সুব্রতা: (মৃদু হেসে) গুজবটা স্বাভাবিকভাবে আমার কানেও এসেছে, বুড়োরও (তরুণকুমার)। আপনি শুধু এটুকু শুনেছেন? আমার সঙ্গে কারওর নাম জড়িয়ে কিছু শোনেননি?
প্রশ্ন: হ্যাঁ, তাও শুনেছি। ইচ্ছে করেই নামটা গোপন রেখেছিলাম। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তো?
সুব্রতা: ঠিকই শুনেছেন। লোকরা যে কীভাবে এসব ছড়ায় বুঝতে পারি না। আমরা দু’জন যে আলাদা নেই তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এই তো, বুড়োর ঘরে বসেই কথা বলছি। যেদিন এসব কথা আমাদের কানে এল, বেশ এনজয় করেছিলাম ব্যাপারটা।
আরও পড়ুন: ‘এত নিষ্ঠুর, কৃপণ হবে ভাবিনি’
প্রশ্ন: ঘটনার মূল সূত্রটা কোথায়?
সুব্রতা: আমার দু’-একটা সোর্স আছে যেখান থেকে আমি ক্রিকেট খেলার কিছু টিকিট নিয়মিত পাই। একদিন হয়েছে কী, আমার জা বললেন, তিনি নাকি কার কাছে শুনেছেন আমি আর শুভেন্দু একদিন কোথায় ক্রিকেটের টিকিট আনতে গিয়েছিলাম। জায়ের কথায় আমি তেমন কান দিইনি, উড়িয়ে দিয়েছি। ক’দিন বাদে আবার ফোন এল। ফোনটা বুড়োই ধরেছিল। ফোনেই ওর এক বন্ধু বলল, আমাকে আর শুভেন্দুকে নাকি কোনও জায়গায় দেখেছে। আমাকে এসে বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, তুমি শুভেন্দুর সঙ্গে কোথাও গিয়েছিলে নাকি? কবে জিজ্ঞাসা করতেই ওর বন্ধুটি যে দিনটার কথা বলল, দুর্ভাগ্যক্রমে আমি আর বুড়ো সেদিন সারাদিন চুটিয়ে ঘুরেছিলাম। সেই কথা ওকে বলতেই সজোরে বুড়ো হেসে বলল, কার সঙ্গে যে কাকে এরা দেখে! ভাগ্যিস বুড়োর সঙ্গে আমি সেদিন ছিলাম, নইলে ওর বন্ধুর গুজবটা বুড়োর খারাপ লাগত। (মিষ্টি হেসে) এই তো সব ব্যাপার, কী বলব বলুন!
প্রশ্ন: তরুণবাবু ও আপনার মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং কীরকম? কখনও কোনও বিষয়ে আপনাদের মধ্যে মতবিরোধ ঘটেছে?
সুব্রতা: (বেশ গম্ভীর হয়ে) আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিশ্চয়ই আছে, নইলে একসঙ্গে আছি কী করে? তবে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারব না। আমি ভাগ্যকে ভয়ানক বিশ্বাস করি। আজ আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে বলে কাল যে থাকবেই, এ কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না। বোঝাবুঝি যতই থাক এতদিনের বিবাহিত জীবনে মতবিরোধ হবে না, কখনও তা হয় নাকি? বহুবার হয়েছে।
আরও পড়ুন: লোডশেডিং রেশনিং করার দাবি সত্যজিৎ, উত্তম, সৌমিত্রদের (পর্ব ১)
প্রশ্ন: কোনও একটা ঘটনার কথা বলুন না, শুনি
সুব্রতা: স্টারের নতুন নাটকের জন্য তখন আমি হিরোইনের রোলে পুরোদমে রিহার্সল দিচ্ছি। কী কারণে যেন আমি ওই চরিত্র করতে চাইছিলাম না। ভালো লাগছিল না। বুড়োকে বলতেই ও তো আমার ওপর খাপ্পা। বলল, ‘কী পেয়েছ কী? আজ বাদে কাল স্টেজে উঠতে হবে। আজ বলছ অভিনয় করব না!’ খুব ধমক দিল আমাকে। এদিকে আমি নাছোড়বান্দা। অভিনয় আমি করবই না। আমাকে ও অনেক বোঝাল। কিন্তু কে বোঝে কার কথা। শেষপর্যন্ত মুখে আর না পেরে জোর করে আমাকে স্টারে নিয়ে চলে গেল সেই রাত্রে। ময়লা কাপড়টাও বদলে নিতে দিল না বুড়ো। স্টারে আমাকে রেখে এসে বলেছিল, ‘কাল অভিনয় করে তবে বাড়ি ফিরবে।’
প্রশ্ন: বিচ্ছেদ সম্পর্কে আপনার কী মত? বিচ্ছেদ কখন দরকার?
সুব্রতা: (খুব সিরিয়াস হয়ে) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মানসিক বোঝাবুঝি না থাকলে বিচ্ছেদ অবশ্যই প্রয়োজন। সমাজে লোকনিন্দার ভয়ে দুটো জীবন তো নষ্ট করা যায় না, উচিতও নয়। একটা সংসার তো দু’জনের আনন্দ নিয়েই তৈরি। সেখানে একজন কষ্ট পেয়ে যাবে, তা তো হতে পারে না। লোকলজ্জার ভয়ে নিজেকে ফিল করার কোনও মানে তো আমি আমি খুঁজে পাই না। নিজের মনোমতো যদি কিছু করতেই না পারলাম, তাহলে বেঁচে থাকা কেন?
আরও পড়ুন: বিশেষ চরিত্রে পঙ্কজ ত্রিপাঠী
প্রশ্ন: সংসারকে সুখী ও সুন্দর করে তোলার দায়িত্ব কার বেশি, স্বামী না স্ত্রীর?
সুব্রতা: আমি তো মনে করি, দায়িত্বটা ফিফটি-ফিফটি হওয়া উচিত। সমাজ অবশ্য বলে স্ত্রীর দায়িত্ব বেশি। কিন্তু স্বামীর দায়িত্বটা কম হবে কেন? তাহলে তো স্ত্রীর ওপর বেশি চাপ দেওয়া হয়।
প্রশ্ন: অভিনেত্রী হলে নানা ঝামেলায় সংসারের প্রতি যথোচিত নজর দেওয়া যায় না, এটা কি সত্যি? আপনার ক্ষেত্রেও কি তা প্রযোজ্য?
সুব্রতা: আমি যখন অভিনেত্রী, নিশ্চয়ই এ সত্য আমার ক্ষেত্রেও খাটবে। তবে সংসারের প্রতি এই অনিচ্ছাকৃত দায়িত্ব এড়ানোর জন্য মেন্টালি আমি খুব ডিপ্রেসড হয়ে পড়ি। কিন্তু কী আর করব বলুন! অ্যাডজাস্ট তো করে নিতেই হয়।
প্রশ্ন: মজুত উদ্ধার আন্দোলন আজকের খাদ্য ও মূল্যবৃদ্ধি সমস্যার সমাধান করতে পারে কি?
সুব্রতা: (বিরক্তির সুরে) সত্যি বলছি ভাই, এসব পলিটিক্স-ফলিটিক্স আমি বুঝি না, বুঝতে চাইও না। তবে মানুষের মুখের খাবারটুকু নিয়ে যে নোংরা রাজনীতি চলছে, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। পেটপুরে যদি দুটো খেতেই না পেলাম, তবে কীসের এই পলিটিক্স। কোন আন্দোলন করলে কী হবে বা কীসে কী হতে পারে, তা আমি বলতে পারব না, জানিও না। শুধু এটুকু বলতে পারি, সরকারের এক্ষুনি পজ়িটিভ কিছু করা উচিত।
আরও পড়ুন: পরিবেশ-রাজনীতির এক মায়াবী ইস্তাহার
প্রশ্ন: আজকের এই অর্থনৈতিক দুরবস্থায় সংসারের প্রতি আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য কী? আপনি কী সেটুকু করতে পারছেন?
সুব্রতা: (বেশ বিজ্ঞের সুরে) আদর্শ স্ত্রী হয়তো আমি নই, তবে সংসারের প্রতি সব স্ত্রীরই সাধারণ কতগুলো কর্তব্য থাকে। যেমন সংসার চালানো, আর্থিক আয়ের সঙ্গে সমতা রেখে ব্যয়ের লিস্ট তৈরি করা, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা। সংসারের এতসব দায়িত্বের আমি আর কতটুকুই বা করতে পারি! বাবার সংসারকে একটু দেখতে হয়। নিজের এই সংসারেরও দায়িত্ব আছে, মেয়ের এডুকেশন আছে। উপরন্তু আমরা নাকি স্টার হয়েছি! তা সেই স্টার স্ট্যাটাস মেনটেন করতেও বাড়তি কিছু পয়সা বেরিয়ে যায়। কিন্তু আয়ের পরিমাণে তেমন হেরফের হয়নি। সুতরাং একেবারে কোনও ধকল সামলাচ্ছি না, তা বলব না।
প্রশ্ন: ছবির সংখ্যাও তো আপনার হাতে খুব বেশি নেই এখন। তবু স্টার থিয়েটার ছাড়লেন কেন?
সুব্রতা: আমার শরীরটা এখন একটু খারাপ যাচ্ছে (কথাটা সত্যি, কারণ এই সাক্ষাৎকারের জন্য যেদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে গিয়েছিলাম, সেদিন আমাকে সঙ্গে নিয়েই নার্সিং হোমে গিয়েছিলেন তিনি। আমি অবশ্য নার্সিংহোম পর্যন্ত যাইনি। তাঁর গায়ে সেদিন জ্বরও ছিল, দুর্বল লাগছিল দেখতে) বলতে পারেন তাই বিশ্রাম নিচ্ছি। তাছাড়া শিল্পীরও একটু স্মৃতি রোমন্থনের প্রয়োজন হয় কখনও-কখনও। তাই করছি এখন। অভিনয় ছাড়িনি, ছাড়বার ইচ্ছেও নেই।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন হিন্দি ছবি দর্শকের রুচি বিকৃত করছে। এ অভিযোগ আপনি মানেন?
সুব্রতা: না, মানি না। কারণ আমার বিশ্বাস দুটো বাজে নাচ দেখিয়ে বা দৃশ্য দেখিয়ে দর্শকের রুচি খারাপ করা যায় না। আর এখন তো অনেক ভালো-ভালো ছবি হচ্ছে হিন্দিতে। দর্শকের রুচির বিকৃতি ঘটছে এটাও সত্যি নয়। বরং ভালো ছবির দর্শক এখন অনেক বেড়েছে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাই হিন্দি ছবি সম্পর্কে এসব মিথ্যে অপবাদ দেয়। নিজেরা ভালো ছবি করতে পারব না, দোষ দেব অন্যের? এটা অন্যায়। খারাপ ব্যাপারটা নিয়ে চিৎকার না করে ভালো ছবি করার স্লোগান দেওয়া হোক।
প্রশ্ন: ভালো ছবি বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?
সুব্রতা: সহজ, সরল, সুন্দর করে জীবনের কথা যে ছবি বলবে, সেটাই ভালো ছবি। একটা ছবি দেখার পর কেন, কী হল, কোন দৃশ্যের সঙ্গে কার কী বক্তব্য, এসব চুলচেরা ভাবনা আমার আসে না। যাঁরা এ ধরনের ছবি করেন তাঁরা প্রতিভাবান নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমার কাছে ‘অনুভব’, ‘ফুলেশ্বরী’ বা ‘সানফ্লাওয়ার’ ছবির অ্যাপিল অনেক বেশি।
প্রশ্ন: অভিনয় তো অনেকদিন ধরে করছেন, বহু শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন। তরুণবাবু ছাড়া আর কারওর সঙ্গে হার্দিক সম্পর্ক হয়েছিল আপনার?
সুব্রতা: ছোটবেলায় তো অনেক কিছুই হয়। ওগুলো মনে না করাই ভালো। অভিনয় করতে এসে ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট একেবারে হয়নি বললে মিথ্যে বলা হবে। হয়েছে বেশ কয়েকবার। কাইন্ডলি আমাকে নাম বলতে অনুরোধ করবেন না। বলতে পারব না। এসব ঘটনা তো আমার মনে হয় সব শিল্পীর জীবনেই কমবেশি ঘটে থাকে।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, আশ্বিন ১৩৮১
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন