Features

”বাঞ্ছারামের বাগান’ না করা মস্তবড় ভুল ছিল’

নায়ক যেমন আটকে থাকেন তাঁর গ্ল্যামারের খাঁচায়, তেমন ইমেজের গরাদেও। উত্তম বারবার চেয়েছেন ‘উত্তমকুমার’-এর মিষ্টি-মিষ্টি রোল ভেঙে বেরিয়ে আসতে। তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন স্বপনকুমার ঘোষWBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ ও ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ    

তাঁর মৃত্যুর ঠিক তিনদিন আগে আমি উত্তমকুমারের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেটাই ছিল তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার। মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে সেই সাক্ষাৎকারের একটা অংশ ছাপা হয়েছিল তৎকালীন সানডে পত্রিকায়। সেখানে উত্তমকুমার আমাকে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, একঘেয়ে চকোলেট হিরোর রোল করতে-করতে তিনি ক্লান্ত এবং বিরক্ত। চকোলেট হিরোর চক্রব্যূহ থেকে বেরনোর প্রচণ্ড একটা তাগিদ তাঁকে তখন তাড়িয়ে নিয়ে চলেছিল। যে কারণে তিনি পীযূষ বসুর ‘বাঘবন্দী খেলা’ (Baghbondi Khela) ছবিতে অন্যরকম ভিলেন করেছিলেন, ‘যদুবংশ’-এর গনাদা চরিত্রটি গ্রহণ করেছিলেন বা ‘চৌরঙ্গী’র স্যাটা বোস। ‘দুই পৃথিবী’তে ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদা। মাঝে-মাঝেই উত্তমকুমার ওই চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি কেবল ছকে বাঁধা রোম্যান্টিক নায়ক নন, একজন অত্যন্ত বড়মাপের চরিত্রাভিনেতা। ‘নায়ক’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’ বাদ দিয়েই বলছি। কারণ ওই ছবি দুটো ছিল সত্যজিৎ রায়ের। শেষ যে ছবিতে অভিনয় করতে-করতে সেট থেকে হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন, সেটাও ছিল ব্যতিক্রমী চরিত্র। ছবির নাম ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ (Ogo Bodhu Sundari)

পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরী বেঁচে নেই। কিন্তু আমার স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল তাঁর বাড়িতে একটা রবিবারের সকাল। তখন পার্থপ্রতিম ‘যদুবংশ’ ছবির প্রস্তুতিপর্বে। তিনি প্রথমে গনাদার ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কাগজে সেই খবরটা বেরিয়েওছিল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে পার্থপ্রতিম হঠাৎ কী ভেবে বললেন, “না, সৌমিত্র নয়, আমার গনাদা হতে পারেন শুধু উত্তমকুমার।” সেখানে সেদিন আরও অনেকের সঙ্গে অভিনেতা রবি ঘোষও ছিলেন। রবিদা সঙ্গে-সঙ্গে গলা মেলালেন, “পার্থ, তুই দুর্দান্ত ভেবেছিস। কিন্তু রোম্যান্টিক নায়কের খোলস ছেড়ে এরকম রোল উত্তমকুমার কি করবেন? কথা বলে দেখ!’

পার্থপ্রতিম প্রবল আবেগে এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন, “আমি ঠিক রাজি করিয়ে নেব।”

আরও পড়ুন: ‘সমাজের কীট বলেই ভাবত আমাদের’

আমি জানি, রোলটা শোনার পর উত্তমকুমার ঠিক পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, “হ্যাঁ করব। কিন্তু কাগজে যে পড়েছি পুলু (সৌমিত্র) করছে।”

পার্থপ্রতিম তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেন, সৌমিত্রর সঙ্গে তাঁর সরাসরি কোনও কথা হয়নি। উড়ো খবর ছাপা হয়েছে। আরও উল্লেখ্য, উত্তমকুমার গনাদার চরিত্রে প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছিলেন। চরিত্রটা এতটাই তাঁর মনে ধরেছিল। এবং এটাকে তিনি তাঁর কেরিয়ারের একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেও গ্রহণ করেছিলেন।

সে সময় টালিগঞ্জে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো উত্তমকুমার ও সৌমিত্রর দুটো শিবির। উত্তমকুমার গনাদা করছেন খবরটা চাউর হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সৌমিত্র-শিবির বাঁকা হাসি হেসে বলেছিল, গনাদার চরিত্রে উত্তমকুমার ভয়ঙ্কর এক মিসকাস্টিং! যাইহোক, ‘যদুবংশ’ রিলিজ় করল। প্রত্যেকটা খবরের কাগজে উত্তমকুমারের অভিনয়ের তুমুল প্রশংসা। যাঁরা ‘যদুবংশ’ দেখেছেন তাঁদের নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে না উত্তমকুমারের অভিনয় ঠিক কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল। বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয়েছিল, কেন উত্তমকুমার হলিউডে জন্মালেন না। ছোট একটা দৃশ্য, যেখানে অপর্ণা সেন উত্তমকুমারকে বলছেন, গনাদা, তুমি কেন একটু…লোভী হলে না! উত্তমকুমারের ক্লোজ়আপ। তাঁর মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে দুটো চোখ, তাঁর মুখ নিঃশব্দে বুঝিয়ে দিল তিনি কত বড়মাপের অভিনেতা। সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়েছিল ‘গডফাদার’-এ মার্লন ব্র্যান্ডোর ক্লোজ়আপ!

আরও পড়ুন: অনন্য মায়াময় ফ্রেম তৈরি করে ‘ডিয়ার মা’

আমি তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারটি টেপ করেছিলাম আজকের টেকনিশিয়ন্স-১ স্টুডিয়োর মেকআপ ঘরে। সেই ফ্লোরটা এখন নেই। মেট্রো রেলের অধিকারে চলে গিয়েছে জমিটা। তার পাশেই মেকআপ ঘর। লোডশেডিং। তখন স্টুডিয়োর জেনারেটর ছিল না, মেকআপ বাস ছিল না। ছোট্ট একটা জেনারেটর। গ্রীষ্মকালের শেষ, মেকআপ ঘরের আলো জ্বলছে, পাখা চলছে।

উত্তমকুমার আমাকে মেকআপ ঘরে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “তুই পুজোসংখ্যার ইন্টারভিউয়ের কথা বলেছিলি। আজ সময় আছে, নিয়ে নে। শুটিং কখন হবে বলা মুশকিল।”

মেকআপ ঘরের বাইরে পরিচালক ইন্দর সেন একটা চেয়ারে বসেছিলেন। চিন্তিত। নতুন ছবি ‘হার মানিনি’র ফার্স্ট লট। উত্তমকুমারের মাত্র তিনদিন ডেট পেয়েছেন।

আরও পড়ুন: ‘এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে’

টেপ চালু করতেই উত্তম বললেন, “চাঁদু (ইন্দর) খুব ভালো ডিরেক্টর। মৃণাল সেনের সঙ্গে আনেকদিন কাজ করেছে। ওর ‘প্রথম কদম ফুল’, ‘পিকনিক’ আমি দেখেছি। চাঁদুর সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছি। কিন্তু কী বলব, গল্প ওই এক, থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। আর ভালো লাগছে না এরকম সব চরিত্র করতে। তবে এখন একটা ভালো রোল পেয়েছি সলিল দত্তের ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে। একদম অন্যরকম রোল। সলিলের ‘স্ত্রী’-তেও অন্যরকম একটা রোল পেয়েছিলাম। চকোলেট হিরো কেরিয়ারের শুরু থেকে করছি। এক নাগাড়ে এতদিন ধরে একইরকম রোল পাচ্ছি। না করেও তো উপায় নেই। প্রফেশনে থাকতে হবে। দুঃখের এটাই, বেশিরভাগ পরিচালক আমার চকোলেট হিরোর ইমেজ ভাঙার ঝুঁকি নেননি। যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা কিন্তু ঠকেননি। কেরিয়ারের তিনকাল গিয়েছে। আর এককাল বাকি। এখন আমি কেন চকোলেট হিরো সাজব? আমি তো পরিচালকদের বলি, নতুনদের সুযোগ দিন। এই তো ভিক্টর আমার সঙ্গে ‘দুই পৃথিবী’তে কাজ করল। বেশ ভালো। ওকে দিয়ে রোম্যান্টিক হিরো নিশ্চয়ই হয়। ওইসব রোলে আমাকে বাদ দাও না বাপু। আমি আর পারছি না। পীযূষের ‘বাঘবন্দী খেলা’তে আমি যখন একটা অন্য শেডের ভিলেন করতে গেলাম, তখন গেল-গেল রব উঠল। পীযূষ তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়েনি বলেই দর্শক আমাকে একেবারে অন্যরকম একটা চরিত্রে পেল।”

উত্তমকুমার তাঁর কেরিয়ারের শুরুর দিক থেকেই রোম্যান্টিক নায়কের ইমেজ ভেঙে বেরোতে চেয়েছেন। চিত্ত বসুর ‘মায়ামৃগ’ ছবির কথা মনে আছে? দক্ষিণ কলকাতার একটা ফ্ল্যাটবাড়ির চরিত্র, বাউন্ডুলে মহেন্দ্র, এককথায় ক্যামিও রোল। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া একটি গানে তিনি লিপ দিয়েছিলেন। বাড়ির ছাদে পায়রা ওড়াতে-ওড়াতে। গানটা সুপারহিট হয়েছিল উত্তমের অভিব্যক্তির জন্য।

আরও পড়ুন: ‘এক ফিল্ম হিরোর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি’

রোম্যান্টিক নায়কের ইমেজ ভেঙে বেরোবার তাগিদ ছিল তাঁর মধ্যে। যে কারণে তপন সিংহের ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ (Banchharamer Bagaan) ছবিতে জমিদারের চরিত্র করতে রাজি হয়েছিলেন। করতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পারেননি, তাঁর চারপাশের লোকজনের জন্য। তাঁরা উত্তমকুমারের কাছে এই যুক্তি পেশ করেছিলেন যে, মনোজ মিত্র ‘বাঞ্ছারাম’ ছবির ক্রিমটাই খেয়ে যাবেন। জমিদার সেকেন্ড লিড, তেমন কিছু করার নেই।

উত্তমকুমার এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কী, সুপ্রিয়া দেবী তাঁকে এই রোলটা করতে দেননি। প্রযোজককে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের শরীর এই রোল বইতে পারবে না। ভয়ঙ্কর খাটুনির কাজ। সই করেছিলেন উত্তমকুমার। শেষ পর্যন্ত না করার জন্য ঘটনাটা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সেই চরিত্রে দীপঙ্কর দে (Dipankar De) অভিনয় করেন এবং রাতারাতি বড়দরের শিল্পী হয়ে ওঠেন।

Uttam Kumar

শেষ সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে এসে উত্তম স্বীকার করেন, “এটা আমার মস্তবড় ভুল হয়েছিল। করলে আমার কেরিয়ারে রোলটা মাইলস্টোন হয়ে থাকতে পারত। আমি বুঝতে পারছি এখন আমাকে একদম সরে আসতে হবে রোম্যান্টিক নায়কের ভূমিকা থেকে। আমার চোখ খুলে দিয়েছে ‘যদুবংশ’, ‘নায়ক’, ‘চিড়িয়াখানা’র মতো ছবিগুলো। এখন নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করা উচিত। মৃণালদার সঙ্গে একটা ছবিতে আমি কাজ করেছি বহুদিন আগে, ‘রাত ভোর’। আবার কাজ করতে চাই। আজকের মৃণালদার সঙ্গে। আমি তো ওঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ আর ‘ভুবন সোম’ দেখে মুগ্ধ। মানিকদাও বলেছেন আমাকে নিয়ে আবার ছবি করবেন। আমি বলেছি, আমাকে ‘জলসাঘর’-এর ছবি বিশ্বাসের মতো একটা চরিত্র দিন না।”

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যখন ‘তাহাদের কথা’ করছেন, মিঠুন চক্রবর্তীকে কাস্ট করার সময় বলেছিলেন, উত্তমকুমার যদি বেঁচে থাকতেন! গৌতম ঘোষ সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফে’ প্ল্যান করেছিল উত্তমকুমারকে নিয়ে। সম্ভবত উত্তমের সঙ্গে কথাও বলেছিল। পরে ‘শ্রীমতী কাফে’ নিয়ে কথা বলতে-বলতে গৌতম আমাকে বলেছিল, “নাহ, উত্তমকুমার ছাড়া ছবিটার কথা আমি ভাবতেই পারি না। তাই ছবির পরিকল্পনা থেকে ‘শ্রীমতী কাফে’ বাদ। ভাবতেও পারব না বোধহয় কোনওদিন।”

রমাপদ চৌধুরীর জটিল মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘অ্যালবামের কয়েকটি ছবি’ নিয়ে উত্তমকুমার নিজেই একটা ছবি করার কথা ভেবেছিলেন। আমিই তাঁকে উপন্যাসটা এনে দিয়েছিলাম। পরে বলেছিলেন, “তেমন কাউকে দিয়ে স্ক্রিপ্টটা লেখাতে হবে। প্রধান চরিত্রে অভিনয় ছাড়া ছবিটা ডিরেক্ট‌ও করব ভাবছি।”

প্রথম প্রকাশ: আনন্দলোক, ২১ জুলাই ১৯৮১


Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *