‘এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে’
বাঙালি অভিনেতা মুম্বইয়ে গিয়ে হিন্দি ছবিতে অভিনয় করছেন, এ সেই ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের আমল থেকে চলে আসছে। তবে কোনও বাঙালি অভিনেত্রী মালয়ালম, তেলুগু, কন্নড় ছবিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, এমন ঘটনা আজও বিরল। সেটাই করেছিলেন নন্দিতা বসু (Nanditha Bose)। তাঁর দীর্ঘ সাক্ষৎকার নিয়েছিলেন নির্মল ধর। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ
নির্মল ধর: শুরু থেকেই শুরু করা যাক। বাংলা ছবিতে কাজ করতে-করতে হঠাৎ মাদ্রাজ চলে গেলেন কেন?
নন্দিতা: ঠিক হঠাৎ করে যাইনি। আমার স্বামীর সরকারি চাকরি তো, উনি বদলি হয়ে গেলেন মাদ্রাজে। আমাকেও তাই যেতে হল।
প্রশ্ন: ওখানে গিয়ে ছবিও তো অনেক করেছেন শুনেছি। এ ব্যাপারটা ঘটল কী করে?
নন্দিতা: এটাকে আপনি যোগাযোগ বলতে পারেন। কলকাতার এক বিনোদন পত্রিকায় একজন দক্ষিণ ভারতীয় প্রযোজক নতুন নায়িকার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। এখান থেকেই ওই কাগজের সুব্রহ্মণ্যম নামক মাদ্রাজ প্রতিনিধিকে আমার নাম জানানো হয়েছিল। সেইমতো তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রথমে তো আমি অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। মালয়ালম ছবিতে আমি অভিনয় করব কী করে? মালয়ালম ভাষার ‘ম’ও আমি জানি না! প্রযোজক ভদ্রলোক বললেন তাঁর নাকি আমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ওঁর চোখে আমার অ্যাপিয়ারেন্সে নাকি দারুণ বাঙালিয়ানার ছাপ আছে! ছবির চরিত্রটাও এমন একটা চেহারা দাবি করে। সুতরাং তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না। ভাষার অসুবিধার কথা বলতেই উনি বললেন, ও ব্যাপারে আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না, আমরা ডাবিং করে নেব। আপনি শুধু সংলাপগুলো মোটামুটিভাবে উচ্চারণ করে অভিনয় করবেন। এরকম একটা অ্যাসিওরেন্স পেয়ে আমি রাজি হয়ে যাই। এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলতে চাই। মালয়ালম চিত্রজগতের সবথেকে জনপ্রিয় অভিনেত্রী, যিনি ছ’বার উর্বশী পুরস্কার পেয়েছেন, সেই সারদাই এখনও ডাবিং করে কাজ করেন। তিনি অন্ধ্রের মেয়ে। যাইহোক, এতগুলো ছবির পর ভাষা কিছুটা রপ্ত করে নিয়েছি।
প্রশ্ন: সাউথে আপনার প্রথম ছবি কী?
নন্দিতা: ‘পানিতি রাত ভেড়ু’ (অসমাপ্ত বাড়ি)। পরিচালক ছিলেন সেতু মাধবন। এ ছবিটি কেরল রাজ্য সরকারের পুরস্কার পেয়েছে। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছে।
প্রশ্ন: ‘পানিতি রাত ভেড়ু’ দিয়েই তাহলে আপনার অভিনয়-সাফল্যের শুরু বলা যায়?
নন্দিতা: তা বলতে পারেন। তবে গতবছর ‘স্বপ্নম’ ছবিখানা আমাকে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার এনে দিয়েছে। এটাও আমার কেরিয়ারের একখানা উল্লেখযোগ্য ছবি।
আরও পড়ুন: মৃণাল সেনের ছবি থেকে বাদ পড়লেন অমিতাভ বচ্চন
প্রশ্ন: এ পর্যন্ত দক্ষিণে ক’খানা ছবি করেছেন? নামগুলো যদি বলেন
নন্দিতা: খান দশেক ছবি করেছি, হাতে আছে এখনও প্রায় চার-পাঁচটি ছবি। নামগুলো কিন্তু খুব খটমটে শোনাবে। ‘ধর্মোদ্ধম’, ‘পুন্দে নারুইল’, ‘এন্ডে ভারদম’, ‘বন্দঙ্গন বন্ধলঙ্গল’, ‘চঞ্চলা’, আরও আছে অনেক। ‘চেড়া’ আর আগে যে দুটো ছবির নাম করলাম—’পানিতি রাত ভেডু’ ও ‘স্বপ্নম’— এগুলো সবই মালয়ালম। তামিল আর তেলুগু ছবি দুটো হচ্ছে ‘দাহম’ ও ‘আলুবি সীতারাম বাজু’।
প্রশ্ন: হিন্দিতে কোনও কাজ করলেন না কেন?
নন্দিতা: হিন্দিতে করেছি তো! ‘অ্যায়সা ভি হোতা হ্যায়’ নামে একটা ছবি করেছি। আরও কয়েকটা নিয়ে কথাবার্তা চলছে।
প্রশ্ন: এতগুলো মালয়ালম ছবিতে অভিনয় করলেন। ছবি ও চরিত্রগুলো আপনার কেমন লেগেছে?
নন্দিতা: মালয়ালম ছবি সম্পর্কে একটা কথা বলি। বাংলা ছবির সঙ্গে ওদের এক জায়গায় মিল আছে। রিয়্যালিটিকে নিয়ে ওঁরা ছবি করেন। সামাজিক ও বাস্তবজীবন ওদের বেশিরভাগ ছবির বিষয়বস্তু। ফলে হয় কী, ছবির চরিত্রগুলোও জীবন্ত হয়, ন্যাচারাল হয়। অভিনয়ধারাতেও বাংলার সঙ্গে খুব মিল আছে। যে-কারণে আমার তেমন অসুবিধে হয় না। ছবিগুলো এত বেশিই বাস্তব হয় যে সংলাপও খুব কম থাকে, অভিনয় দিয়েই বোঝাতে হয় সবটা। সেজন্যই বোধহয় মালয়ালম ছবিতে কাজ করতে ভালো লাগছে। ডাবিং করলেও চরিত্রগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং, উদ্ভট নয়।
আরও পড়ুন: লোডশেডিং রেশনিং করার দাবি সত্যজিৎ, উত্তম, সৌমিত্রদের (পর্ব ১)
প্রশ্ন: মাদ্রাজ ছেড়ে আবার কলকাতায় এলেন কাজ করতে, কী ব্যাপার?
নন্দিতা: এটাও যোগাযোগের ফল বলতে পারেন। গতবছর মেয়ের স্কুলের ছুটিতে একদিন শুটিং দেখতে এসেছিলাম টালিগঞ্জে। শুনলাম পরিচালক দিলীপ মুখোপাধ্যায় (যাত্রিক) ‘নগর দর্পণে’র জন্য নাকি আমাকে খুঁজছেন। আমাকে দেখতে পেয়েই পাকড়াও করলেন। আমারও প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল বাংলা ছবিতে কাজ করার। মাতৃভাষায় ছবি করতে কার না ইচ্ছে করে বলুন! আমিও সুযোগের অপব্যবহার করিনি। তারপর ‘নগর দর্পণে’ শেষ হতে না হতেই দিলীপবাবুর পরবর্তী ছবি ‘মোমবাতি’র জন্যও আমাকে বললেন। এখন তো ‘রং নাম্বার’-এর সেটে বসে কথাই বলছি। বলা বাহুল্য এ ছবির নায়িকাও আমি।
প্রশ্ন: কলকাতার থেকে দক্ষিণে আপনার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। কাজও করেছেন বেশি। দক্ষিণে আপনি কী ধরনের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন?
নন্দিতা: প্রতিযোগিতা কোথায় নেই? সব জায়গাতেই তো কম্পিটিশন। মালয়ালম ছবিতে নায়িকা বলতে আছেন জয়া ভারতী, সারদা, আর আমি। সুতরাং কম্পিটিশন আমাদের তিনজনের মধ্যেই। তবে কোনও নোংরামি নেই, এটুকু বলতে পারি।
প্রশ্ন: আপনাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কীরকম?
নন্দিতা: একসঙ্গে কাজ করতে গেলে রিলেশন খারাপ হলে চলে কি? রিলেশন ভালোই। জয়ার সঙ্গে আমি ছবিও করেছি। সারদার সঙ্গে এখনও সুযোগ আসেনি। অনেকে বলেন, সারদার সঙ্গে ফিচারে নাকি আমার খুব মিল আছে। একবার স্টুডিয়োতে সারদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। খুবই ফর্মাল ছিল ব্যাপারটা। তবে জয়া অত্যন্ত উচ্ছল, মেজাজি মহিলা।
প্রশ্ন: ওখানে জনপ্রিয়তার বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়েছে কখনও?
নন্দিতা: বিড়ম্বনা ব্যাপারটা সত্যি বলতে কী ওখানে নেই। ফ্যানরা আমাদের ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। চোখের দেখা দেখার জন্য আকুলিবিকুলি করেন। কিন্তু অধৈর্য হয়ে পড়েন না কখনও। একবার ত্রিবান্দ্রমে গিয়েছিলাম একটা দোকানের উদ্বোধন করতে। তখন ওখানে আমার দু’খানা ছবি চলছে। যেই দর্শক জানতে পারল আমি ওই দোকানে আছি, অমনি দলে-দলে এসে হাজির। আমাকে তাঁরা দেখতে চান। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। আমাকে না দেখে তাঁরা যাবেন না। ভিজেও অপেক্ষা করছেন। সুতরাং আমাকে দেখা দিতেই হল। ব্যালকনিতে এসে সবাইকে নমস্কার জানাতে তাঁরা সবাই চলে গেলেন। কোথাও কখনও কটু মন্তব্য শুনিনি। এটাই ভালো লাগে।
আরও পড়ুন: নর্মদাকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছি: গৌতম ঘোষ
প্রশ্ন: কলকাতা না মাদ্রাজ, কোন শহরটা আপনার ভালো লাগছে, আর কেনই বা লাগছে?
নন্দিতা: ভালোমন্দ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে মানসিক অবস্থার ওপর। আমার তো দুটো শহরই ভালো লাগে। প্রথম যখন মাদ্রাজে গিয়েছিলাম, বেশিরভাগ সময় একাই থাকতাম। বাড়িটাও একেবারে সমুদ্রের ধারে। আস্তে-আস্তে সয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা। আমার তো মনে হয় সবার ক্ষেত্রেই এরকম ঘটে। তবে কলকাতায় সব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব রয়েছে। মনটা অনেকসময় এখানেই পড়ে থাকে।
প্রশ্ন: কয়েক বছর বাদে তো কলকাতায় এলেন। কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে কি?
নন্দিতা: পরিবর্তন তো হয়েইছে। আপনারা তো কলকাতায় সবসময় থাকেন তাই পরিবর্তন হয়তো আপনার চোখে লাগছে না। আমার চোখে তো বেশি করে লাগছে। জীবন এখানে আরও জটিল হয়েছে, যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছে। সমস্যাও বেড়েছে প্রচুর।
প্রশ্ন: অভিনয় করছেন বলেই শুধু নয়, দক্ষিণের বাসিন্দা হিসাবে ওখানকার মানুষের বিশেষ কোন গুণ আপনার মন কেড়েছে?
নন্দিতা: ওদের ধর্মবিশ্বাস আর নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর আন্তরিক নিষ্ঠা। দক্ষিণ ভারতীয়দের ধর্মবিশ্বাসকে অনেকে গোঁড়ামির পর্যায়ও ফেলতে পারেন। কোনও জায়গায় মন্দির বা দেবতা মাহাত্ম্যের কথা শুনলেই ওরা প্রণাম করতে শুরু করে। আমরা বাঙালিরা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে ক্ষণিকের জন্যেও অন্তত ভাবি। ওদের সে সব নেই। এরকম বিশ্বাস থাকা আমার তো মনে হয় খারাপ নয়। আর নিজেদের সংস্কৃতিকে যে কতখানি ওরা ভালোবাসে তা ওদের ছবি দেখলে কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। পোশাক, ভাষা, গানবাজনা, সবদিক থেকে নিজেদের বৈশিষ্ট্য আর ঐতিহ্যকে ওরা তুলে ধরে। দুঃখের কথা, আমরা বাঙালিরা আজ বোধহয় সেই নিষ্ঠার অভাবে পিছনে পড়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: দক্ষিণ ভারতীয়দের রান্নায় তো টক আর ঝালের পরিমাণ বেশি। অসুবিধে হয় না খেতে? ওদের কোন খাবার আপনার সবথেকে পছন্দের?
নন্দিতা: রসম চাটনি দিয়ে দোসা খেতে তো খারাপ লাগে না। ভালোই তো! তবে বাড়িতে কি আর সবসময় সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার খাই? সেখানে মাছভাতই খাই। শুটিংয়ের সময় মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে খাবার আসে। বাইরে শুটিং করতে গেলে ইউনিটের সকলকে একসঙ্গে বসে খেতে হয়। এবং খাবারও সবার এক। এটা ওখানকার নিয়ম। কারওর জন্য আলাদা খাবার বিশেষ কোনও হোটেল থেকে আসে না। তখন সকলের সঙ্গে বসেই খাই। অসুবিধে কী?
প্রশ্ন: আপনার স্বামী তো সরকারি অফিসার। আপনার অভিনয় করার ব্যাপারে তাঁর দান বা সহযোগিতা কতটুকু?
নন্দিতা: কতটুকু! তিনি ঘোর সংসারি মানুষ হলেও আমার অভিনয় করাকে কখনওই খাটো চোখে দেখেন না। বরং আমাকে ইনস্পায়ার করেন। মালয়ালম ছবিতে কাজ করার ব্যাপারে তিনিই আমাকে সবথেকে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন। বাংলা ছবিতে কাজ করি, এটা তিনি সবসময়ই চান।
প্রশ্ন: বিবাহিত জীবনের আনন্দ, অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলতে চান কি?
নন্দিতা: না, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনওই কিছু আলোচনা করিনি আমি। করতে চাইও না। অভিনয় করছি, করব। এটাই প্রথম ও শেষ কথা।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, আশ্বিন ১৩৮১
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন