Reviews

হালচাল ঠিকঠাক হ্যায়

ছবি: মেরে অপনে

পরিচালনা: গুলজ়ার

অভিনয়ে: মীনাকুমারি, বিনোদ খন্না, শত্রুঘ্ন সিংহ, ড্যানি ডেনজ়ংপা, দীনেশ ঠাকুর, সুমিতা সান্যাল, দেবেন বর্মা, কেষ্ট মুখোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৮ মিনিট

‘মেরে অপনে’ গুলজ়ার পরিচালিত প্রথম ছবি। মুক্তির পরেই হিন্দি ছবির জগতে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল এই চলচ্চিত্র। তথাকথিত ফর্মুলা থেকে একবারেই ভিন্নধর্মী ছিল এ ছবি। সেই সময় ছবিটির রিভিউ করেছিলেন নান্দীকারWBFJA-এর পাতায় রইল সেই সমালোচনার পুনর্মুদ্রণ 

এক একটি বিষয়বস্তু আছে যা একান্তভাবেই স্থান ও কাল নির্ভর। রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধ প্রত্যক্ষভাবে বিরাজ করে কমিউনিস্ট দেশগুলি ছাড়া এখানে প্রতিটি রাজ্যে, যেখান কোনও না কোনও ধরনের শাসন ব্যবস্থা কায়েম আছে। আমাদের ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। কাজেই ভারত ইউনিয়নে অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি রাজ্যেও রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলশাসক যেমন কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, মার্কসবাদি কমিউনিস্ট পার্টি, জনসংঘ, ফরওয়ার্ড  ব্লক ও আরও একাধিক পার্টি। এবং সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক মতবিরোধ।

এই রাজনৈতিক মতবিরোধকে উপলক্ষ করে এবং রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বেকার যুবকেরা যেভাবে সমাজবিরোধীদের সঙ্গে মিশে পাইপগান থেকে শুরু করে বোমা পর্যন্ত ব্যবহার করে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মেতে উঠেছিল, অন্য কোনও রাজ্যভুক্ত জনগণ তা কল্পনাও করতে পারে না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে কলকাতা সম্পর্কে অন্য কোনও লোকের মনে এক অজ্ঞাত বিভীষিকার চিত্র জেগে ওঠে। কেউ কলকাতা থেকে এসেছে শুনলেই তাকে নানারকম উদ্ভট এবং সময়-সময় অবান্তর প্রশ্ন দ্বারা বিব্রত করা হয়। বাঙালি যুবকমাত্রই যেন অস্পৃশ্য।

আরও পড়ুন: মৃত্যুর সাত বছরে উত্তমকথা

ইন্দ্র মিত্র রচিত কাহিনি অবলম্বনে বছর তিনেক আগে তপন সিংহ ‘আপনজন’ (Aponjon) চিত্রটি প্রস্তুত করেছিলেন। সে কাহিনির বক্তব্য আজকের দিনে কলকাতাবাসী এবং কিছুটা পরিধি বিস্তার করে পশ্চিমবঙ্গবাসীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, ঠিক সেই পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া অন্য কোনও রাজ্যবাসীর মনে সৃষ্টি করতে পারে বলে আমরা ভাবতেই পারি না। শুধু তাই নয়, ওই কাহিনিকে বাস্তব রূপ দেওয়া বাঙালি পরিচালক তপনবাবুর শহরের দক্ষিণপ্রান্তস্থিত গঞ্জে বসে যতখানি সহজসাধ্য হয়েছে, ততখানি কিছুতেই একজন অবাঙালি চলচ্চিত্রকারের পক্ষে শহর থেকে অন্তত তেরশো মাইল দূরবর্তী বোম্বাই (মুম্বই) শহরে বাস করে সম্ভব নয়।

স্থান-কাল-পাত্রঘটিত এই দুস্তর বাধা সত্ত্বেও গুলজ়ারের রঙিন ছবি ‘মেরে অপনে’ (Mere Apne) তার বক্তব্যকে প্রায় বাস্তবভাবে তুলে ধরতে পেরেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কাহিনির মর্ম চিত্রনাট্যকার-পরিচালক গুলজ়ার সুষ্ঠুভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন এবং যাতে তিনি এই বাস্তব অবস্থান থেকে কোনওক্রমেই বিচ্যুত না হন, তার জন্য সম্ভবত ‘আপনজন’ অনুসরণ করেছেন। অনেককে এমনও কথাও বলতে শুনলাম যে ‘মেরে অপনে’ হলো ‘আপনজন’-এর কার্বন কপি। না, তা ঠিক নয়। তাই যদি হতো, তাহলে দু’দলের শেষ মারামারির দৃশ্যে শ্যামরূপী বিনোদ ও ছেনোবেশী শত্রুঘ্ন, বোম্বাইকৃত হিন্দি ফিল্মগুলিতে বহুদৃষ্ট হিরো-ভিলেনের লড়াইয়ের ঢংয়ে পরস্পরের সঙ্গে জাপানি জুডো প্যাটার্নের দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হতো না। পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে বোমা, স্টেনগান, পাইপগান, রিভলবার নিয়ে দু’দলে লড়াই চলে, সেখানে জুডোর স্থান কোথায়? আর বোমা নামক বস্তুটি নাড়াচাড়া, বহন বা ব্যবহার করতে হয় অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে। সামান্য অসতর্ক হলেই মৃত্যু অনিবার্য। একশ্রেণির সমাজবিরোধীর কাছে বোমা প্রায় ডালভাতের সামিল হয়ে গিয়েছে, এই কথা বোঝাবার জন্যই তপনবাবু ‘আপনজন’-এ মাস্তানদের গান গাইতে-গাইতে বোমা লোফালুফি করা দেখিয়েছেন, যদিও বাস্তবে তা অসম্ভব। কিন্তু হিন্দি ছবির একটি দৃশ্যে দেখানো হলো, পথের ওপর বোমা গড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে! এটা যে কতখানি বিপজ্জনক কাজ, তা জানলে এই দৃশ্য গ্রহণ করা থেকে পরিচালক বিরত থাকতেন।

আরও পড়ুন: সৌমিত্র-উত্তম একসঙ্গে (পর্ব ১)

সকলেরই জানা, জনৈক গ্রাম্য প্রাচীনার চোখে বর্তমান শহরের হৃদয়হীন জীবনযাত্রা যে দুর্বোধ্যতার সৃষ্টি করে, তারই চিত্রায়ণ আছে ‘আপনজন’ বা ‘মেরে অপনে’তে। হিন্দি ছবিতে সেই প্রাচীনার নাম দেওয়া হয়েছে আনন্দী। এই ভূমিকায় মীনাকুমারী (Meena Kumari) বৃদ্ধার অপরূপ রূপসজ্জায় সজ্জিত হয়ে মিষ্ট, শান্ত বাচনভঙ্গী ও প্রয়োজনীয় অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমে চরিত্রটিকে মাধুর্যময় ও জীবন্ত করে তুলেছেন। তাঁর সুদীর্ঘ অভিনেত্রী জীবনে এই ভূমিকাভিনয় একটি স্মরণীয় বর্তিকা।

ছবিতে দুই দলপতি শ্যাম ও ছেনোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বিনোদ ও শত্রুঘ্ন। এঁরা দু’জনেই চরিত্র দু’টির বাস্তব রূপায়ণে সাধ্যমত শক্তি ব্যয় করেছেন। যে দম্পতির আপনজন রূপে আনন্দীর শহরে আগমন, সেই অরুণ ও লতার ভূমিকায় দেবেন ও সুমিতা চরিত্রোচিত সুঅভিনয় করেছেন। শ্যামের একদা-প্রণয়িনী বেশে যোগিতা বালি একটি শুভ্র তারুণ্যের প্রতীক। দুই নির্বাচন প্রার্থীরূপে অসিত সেন ও মেহমুদ উপভোগ্যতার সৃষ্টি করেছেন, যদিও তপনবাবুর ছবিতে রবি ঘোষ ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুলনায় তা অত্যন্ত নিষ্প্রভ।

দুই মস্তান দলভুক্ত রঘু, বিল্লু, সরযূরা প্রায় সকলেই সুযোগমতো অভিনয় নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। আনন্দীর কৈশোর অবস্থার রূপদানে আমিনা করিম ও তার স্বামী নিরঞ্জনবেশী অভিনেতার অভিনয়ও বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

ছবির কলাকৌশলের বিভিন্ন বিভাগের কাজ উচ্চপ্রশংসার যোগ্য। স্বয়ং গুলজ়ার রচিত গানগুলিতে সুরযোজনায় এবং আবহসঙ্গীত রচনায় সলিল চৌধুরী অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে ‘হালচাল ঠিকঠাক হ্যায়’ গানটিতে বর্তমান সময়ে শিক্ষিত বেকার যুবকদের দুর্দশার কথা তির্যকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

‘মেরে অপনে’ কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সদ্য বিগত অশান্ত দিনগুলির একটি বাস্তব চিত্ররূপে অনস্বীকার্যভাবে সার্থক।

প্রথম প্রকাশ: অমৃত, মাঘ ১৩৭৮ 


Edited and Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *