পরিবেশ-রাজনীতির এক মায়াবী ইস্তাহার
ছবি: পরিক্রমা
পরিচালনা: গৌতম ঘোষ
অভিনয়ে: মার্কো লিওনার্দি, চিত্রাঙ্গদা সিং, আরিয়ান বড়কুল, ক্রিস্টিনা দোনাদিও, অরিজিৎ দত্ত
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট
WBFJA রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
প্রায় দশ বছর পর ছবি পরিচালনায় ফিরলেন গৌতম ঘোষ। একাধিকবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে তাঁর ‘পরিক্রমা’। কেমন হলো সেই ছবি? দেখে এলেন শান্তনু চক্রবর্তী
নন্দনে ‘পরিক্রমা’ (Parikrama) দেখতে ঢোকার ছোট্ট লাইনটার অধিকাংশ দর্শকই সম্ভবত আগের শো ‘গৃহপ্রবেশ’ বা দু’নম্বর প্রেক্ষাগৃহে চলতে থাকা ‘পক্ষীরাজের ডিম’ দেখবে বলে এসেছিলেন। দুটো ছবিই হাউজ়ফুল থাকায় ‘পরিক্রমা’র টিকিট কেটেছেন। শনিবারের বিকেল, সন্ধেটা যাতে একেবারে বেকার না যায়, তার জন্য। বাঙালি পরিচালকের ছবি হলেও এ ছবির ভাষা যে বাংলা নয়, সেটাও বোধহয় বেশিরভাগ দর্শকের জানা ছিল না! বাংলা ছবির পাশে দাঁড়াতে আসা এই সব দর্শকের হতাশা ও বিরক্তি, ছবি চলাকালীন নানারকম উসখুস, গুনগুন, সশব্দে হাই তোলা, এমনকী সরস মন্তব্যও বেরিয়ে আসছিল।
তাই গোড়াতেই একটা কথা স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার। গৌতমের এই ত্রিভাষিক (ইংরেজি-হিন্দি-ইতালিয়ান) স্বপ্ন-প্রকল্পটি অন্তত কলকাতার দর্শকের প্রিয় হওয়ার বিশেষ সম্ভাবনা নেই। এই শহরে ফি বছর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের একটা মোচ্ছব বসলেও বিশ্ব সিনেমার মানচিত্রে কলকাতা বা বাংলা সিনেমাকে দূরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকী নুতন ধারার সর্বভারতীয় সিনেমার এলাকাতেও এখনকার বাংলা ছবির পরিচালকেরা তেমন পাত্তা পান না। সেখানে গৌতম ঘোষ (Goutam Ghose) আমাদের সিনেমাবোধের অন্তর্নিহিত আকাশটা আরও একটু বাড়িয়ে দিলেন, যেমনটা আমরা শেষ দেখেছি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিতে।
‘পরিক্রমা’র কেন্দ্রীয় চরিত্র অ্যালেক্স (মার্কো) একজন তথ্যচিত্রকার। ইতালির এক মৃত, হারিয়ে যাওয়া নদী নিয়ে সে এর আগে ছবি করেছে। এবার ভারতের এক পরিবেশকর্মী, অ্যাক্টিভিস্ট লেখক রূপার (চিত্রাঙ্গদা) নর্মদা নিয়ে লেখা একটা বইয়ের ভিত্তিতে অ্যালেক্স ছবি করতে চায়। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, তীর্থযাত্রীদের নর্মদা (Narmada) পরিক্রমার যে প্রাচীন প্রথা-পরম্পরা আছে, সেটা নিয়েই ছবি হবে। মানে বোঝাই যাচ্ছে ইনেক্রডেবল ইন্ডিয়া মার্কা একটা ভ্রমণ বৃত্তান্ত গোছের কিছু হতে চলেছে। ‘পরিক্রমা’ও যেন তখনও পর্যন্ত এক্সটিক ইন্ডিয়া বিক্রির সাজানো-গোছানো ছক বলেই মনে হচ্ছিল।
কিন্তু নর্মদার উৎস অমরকণ্টকে অ্যালেক্স ও তার ইউনিটের সঙ্গে লালা (আরিয়ান) নামের এক বছর বারো-তেরোর কিশোরের আলাপ হয়। এরপর থেকে অ্যালেক্সের ছবিটা আর কিছুতেই আগের মতো থাকে না। কারণ, লালা এক ডুবাগ্রামের বাসিন্দা, নর্মদা বাঁধ প্রকল্পে, উন্নয়নের জলস্রোতে যে হাজার-হাজার গ্রাম, তার প্রতিবেশী অরণ্য ও বন্যপ্রাণ আজ সবসুদ্ধ জলসমাধিতে গিয়েছে। এখান থেকেই গৌতমের মূল ছবিটাও হয়ে ওঠে পরিবেশ রাজনীতির এক মায়াবী সৌন্দর্যময় ইস্তাহার। জল, আর সেই জল ছুঁয়ে থাকা প্রকৃতি আজ মানুষের জীবনের মোটিফ।
গৌতম ও ঈশান ঘোষের ক্যামেরা এখানে জল নিয়ে এক অলৌকিক খেলা খেলেছে। এমনকী তাঁর ক্যামেরার সেই আশ্চর্য লীলাময় বলিষ্ঠতা চিত্রনাট্যের কিছু মেকি দেখানেপনাকেও ঢেকে দিতে পেরেছে।
তবে যে গৌতম তাঁর ছবিতে ফিল্ম উইদিন এ ফিল্মের প্লট নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন, সেই ছবি নির্মাণের প্রক্রিয়া তাঁকেও এক লম্বা, দুস্তর পথ পরিক্রমা করতে হয়েছে। ভারত-ইতালির যৌথ প্রযোজনায় এই স্বপ্নপ্রকল্প বারবার বাধা পেয়েছে, থমকে গিয়েছে। ছবি তৈরির সময় ও খরচ, দুটোই বেড়েছে। তাই ছবির বিষয়ের পাশাপাশি শুটিংয়ের পরিক্রমা শেষ করাও ইউনিটের কাছে একটা মস্তবড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ছবির বাণিজ্যিক মুক্তি আপাতত সেই পরিক্রমার ক্লাইম্যাক্স!
গৌতমের নিজের শহরের দর্শক এখনও পর্যন্ত ছবিটা সম্পর্কে যতটা উদাসীন, আশা করা যায় আন্তর্জাতিক বাজারে ‘পরিক্রমা’ ততটা উপেক্ষিত হবে না। কারণ, এ ছবির প্রতিটা ফ্রেমেই গৌতম এই ডুব-সমাজ, তার আক্রান্ত প্রকৃতি আর বিপন্ন মানবতার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা বুনে দিতে চেয়েছেন। ভূমধ্যসাগরীয় নেপ্লসের অফুরান সৌন্দর্য থেকে নর্মদার ধ্যানমগ্ন স্রোতে সেই বার্তা বহমান থেকেছে।
পর্দায় গৌতমের সেই কমিটমেন্টের দায় মূলত বহন করেছেন মার্কো। ‘হাংরি অটম’ বা ‘কালাহাণ্ডি’র মতো তথ্যচিত্র নির্মাতা গৌতমকে মার্কো কতটা চেনেন জানি না। কিন্তু অ্যালেক্সের চরিত্রায়ণে, ক্ষমতা ও প্রশাসনের মুখোমুখি দাঁড়ানো, একইসঙ্গে রাগী ও অসহায় সেই তথ্যচিত্র নির্মাতার ডিএনএ হয়তো রয়ে গিয়েছে। সেই আগুনের আঁচটুকু একবারই টের পাওয়া যায় যখন নর্মদার যাত্রাপথে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ওঙ্কারেশ্বর ড্যাম দেখে অ্যালেক্স নিরুপায়, নিষ্ফল ক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রকৃতি এবং মানবসম্পদের এই অসম্ভব অপচয় তার সহ্য হয় না। আবার যখন বাঁধ প্রকল্পের বিশাল জলাধারের পাতালপুরে সেঁধিয়ে যাওয়া ডুবুরি-ক্যামেরায় ধরা পড়ে ভাঙাচোরা বসতি, জনপদের কঙ্কাল, আর মনিটরে দেখতে-দেখতে অ্যালেক্স যখন অস্ফুটে বলে ওঠে অ্যাটলান্টিস, তখন কেমন যেন যাদুবাস্তবতার মতো মনে হয়। ইউরোপের প্রাচীন লোকগাথায় পড়া সমুদ্রের নীচে হারানো শহর ও সভ্যতার সঙ্গে কোথাও যেন লালাদের ডুবে যাওয়া গ্রামের টাটকা স্মৃতিগুলো একাকার হয়ে যায়। কেমন গা-ছমছম করে!
তুলনায় রূপার চরিত্রে চিত্রাঙ্গদা বা পরিচালক নিজেও তেমন দিশা দিতে চাইলেন না। বরং ছবি শেষ হওয়ার পরেও যে চরিত্রটা আমাদের সঙ্গে থেকে যায় সেটা আরিয়ান অভিনীত লালা, বিশেষ করে বিস্ময় আর বেদনা মাখানো তার চোখদুটো। সেই চোখদুটো যেন আমাদের একরাশ প্রশ্ন আর লজ্জার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। বরং জবাবহীন আমাদেরই চোখ নামিয়ে নিতে হয়।
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন