‘উত্তমদাই প্রথমে খবরটা দেখালেন’
তাঁর প্রথম ছবি সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (Pratidwandi)। এরপর ‘পিকনিক’, ‘দুষ্টু মিষ্টি’র মতো একাধিক সফল ছবিতে কাজ করেছেন জয়শ্রী রায় (Jayasree Roy)। অভিনয় করেছেন উত্তমকুমারের সঙ্গেও। তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নির্মল ধর। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ
নির্মল ধর: অটোগ্রাফ দিতে আপনার কেমন লাগে?
জয়শ্রী: সত্যি কথা বলব?
প্রশ্ন: নিশ্চয়ই!
জয়শ্রী: অটোগ্রাফ-টটোগ্রাফ দিতে আমার মোটেই ভালো লাগে না।
প্রশ্ন: তাহলে দেন কেন?
জয়শ্রী: সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের সম্পর্কে ফ্যানদের একটা সুন্দর ধারণা আছে। বলতে গেলে ফ্যানদের এই ভালোবাসাই তো আমাদের অ্যাসেট। সুতরাং তাদের বিমুখ করা তো চলে না। অভিনয় করব, জনপ্রিয় হতে চাইব, আবার ফ্যানদেরও চটাব, এটা কি করে হয়! সুতরাং ইচ্ছের বিরুদ্ধেও অটোগ্রাফ দিচ্ছি, দেবও।
প্রশ্ন: তার মানে নিজের ইচ্ছে দমন করে অন্যের সঙ্গে আপোসে আপনি অরাজি নন?
জয়শ্রী: অটোগ্রাফ দেওয়া আর অপোস করার ব্যাপারটা কিন্তু এক নয়। ধরুন কোনও সাংসারিক ঘটনা, যেখানে কারও সঙ্গে আমার মতভেদ হচ্ছে, সেখানে অপরপক্ষ যদি ঠিকঠাক কারণ দেখিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারে, সেখানে নিশ্চয়ই আমি আপোসে রাজি। তবে বিনা কারণে আমি কখনও রাজি হই না। জোর করে আমার মত আদায় করা আমি একদম পছন্দ করি না।
প্রশ্ন: রাগ, জেদ না দৃঢ়তা, আপনার কোনটা বেশি?
জয়শ্রী: তিনটেই আমার সমান। আগেই তো বললাম জেদ এবং দৃঢ়তা আমার অকারণে নয়। রাগটা আমার সাংঘাতিক সবকিছুতেই। আসল ব্যাপারটা কি জানেন? আমি ছোটবেলা থেকে এমন পরিবেশে মানুষ হয়েছি, যেখানে আদর-আবদার ছাড়া আমার ভাগ্যে আর কিছু জোটেনি। এও ঠিক, স্বাভাবিক জীবনের কোনও আঁচই লাগতে দেয়নি বাবা-মা। জানি আমার এই বদগুণগুলো অনেক অসুবিধার কারণ। কিন্তু কী করব বলুন, আই কান্ট হেলপ ইট।
প্রশ্ন: আপনি কাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসেন?
জয়শ্রী: বেশি ভালোবাসাটা কিন্তু একজনকেই হয় না। বিশেষ করে আমার মতো পারিবারিক মানুষের পক্ষে। কারণ আমার স্বামী আছে, মেয়ে আছে, বাবা-মা তো আছেনই। প্রত্যেককেই আমি সমান ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসার অ্যাটিটিউডটা আলাদা। মেয়েকে যেভাবে, যে দৃষ্টিতে ভালোবাসি স্বামীর প্রতি আমার ভালোবাসার অ্যাটিটিউড নিশ্চয়ই তা নয়। বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও তাই।
প্রশ্ন: আউটডোরে গেলে বাড়ির কাকে আপনি সবথেকে বেশি মিস করেন?
জয়শ্রী: মৌয়ের (মেয়ে) জন্যই বেশি মন কেমন করে। তবে বেশিরভাগ সময়ই প্রবীর (স্বামী) ও মৌ আমার সঙ্গে যায়। এই তো ক’দিন আগে রামপুরহাট গিয়েছিলাম ‘দুষ্টু মিষ্টি’ ছবির কাজে। প্রথমবার একা গেলাম। ওদের জন্য মনটা খারাপ লাগলেও, ভাবি যে আমার সঙ্গে ওদের নিয়ে গেলে ওদেরই কাজ নষ্ট হবে। অবশ্য অনেক সময় না নিয়েও পারি না।
প্রশ্ন: শুনেছি আপনি প্রেম করে বিয়ে করেছেন। প্রবীরবাবুর সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?
জয়শ্রী: সে এক মজার ব্যাপার জানেন। (গালে টোল ফেলে হাসলেন কিছুক্ষণ, কীভাবে শুরু করবেন বোধহয় সেটাই ভাবলেন) বয়স তখন খুব অল্প। মেয়েলি কৌতূহল নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ছেলেদের নিয়ে আলোচনা করি, আড্ডা দিই। হঠাৎ এক বন্ধুর দাদার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে কথা উঠল। ব্যাপারটায় আমি তেমন আমল দিইনি। একদিন হঠৎ সেই বন্ধুর দাদার ফোন পেলাম। আমি তো অবাক! তাকে আমি চিনিই না। মিথ্যে গুজবের সমাধানের পর আমি ভদ্রলোককে নেমন্তন্ন করলাম। তিনি এলেন। পাল্টা নেমন্তন্ন আমিও পেলাম। আমিও গেলাম। বেশিদিন না, মাত্র দু’মাস যাতায়াত করতে-করতে কখন যে গুজবটা সত্যি হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। তারপরেই বিয়ে। পড়াশুনো ডকে উঠে গেল। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষাটাই আর দেওয়া হলো না।
প্রশ্ন: আপনাদের বিয়েতে কোনও আপত্তি এসেছিল?
জয়শ্রী: না, সেরকম কোনও ব্যাপার ঘটেনি। প্রথমত প্রবীররা ব্রাহ্ম। ওদের কোনও সংস্কার নেই। আর আমাদের বাড়ির আবহাওয়া একেবারে অন্যরকম। বাবা-মায়ের আমার ওপর এতটাই কনফিডেন্স ছিল যে তাঁরা আমার কোনও কাজেই খুব একটা বাধা দেননি, বিয়ের ব্যাপারে তো নয়ই।
প্রশ্ন: মেয়েরা চায় সিকিউরিটি। প্রেম কি সে পথ ধরে চলে?
জয়শ্রী: দুটো করা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা, যদিও আপনি জুড়ে দিয়েছেন। সিকিউরিটি আজকাল কে না চায়! আজকের এই হাজার সমস্যার মাঝে সিকিউরিটিই তো বাঁচার সবথেকে বড় হাতিয়ার। শুধু প্রেম দিয়ে পেট ভরবে না। কাজেই সিকিউরিটি খোঁজা খুব একটা অনুচিত নয় বলেই আমি মনে করি। কিন্তু প্রেম সেই সিকিউরিটির কথা ভেবেই চলে, এটা সত্যি নয়। ট্রু লাভ কোনওকিছু মেনে চলে না, ভেবে এগোয়ও না।
প্রশ্ন: আপনার নিজের ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল?
জয়শ্রী: নিশ্চয়ই ট্রু লাভ। সিকিউরিটির কথা তখন আমি ভাবিনি। ওটা আমার আপনা থেকেই এসে গিয়েছিল। প্রবীরদের বাড়ির অবস্থা খুবই ভালো।
আরও পড়ুন: জুলাইয়ের দুই জুয়েল
প্রশ্ন: কখনও নিঃসঙ্গ মনে হয়?
জয়শ্রী: লোনলিনেসের কথা বলছেন? (ভুরু কুঁচকে ভেবে) তাহলে একটু মুখ খুলেই বলি। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি প্রায় একা হয়েই মানুষ। অথচ বাবা-মা, বোন সবাই ছিলেন। আমি খুব দুর্বলও ছিলাম। প্রায়ই স্কুলে যেতে পারতাম না, বাড়িতে বসেই পড়াশুনা করতাম। বাবা ছিলেন সাংবাদিক, ভয়ানক ব্যস্ত থাকতেন। পারিবারিক ব্যবসাপত্র দেখাশুনা করতেন আমার মা। দিদা-দাদুর কাছে আমার সময়টা বেশি কেটেছে। সম্ভবত দুর্বল ছিলাম বলেই কেউ আমাকে বিরক্ত করত না। নিজের মনে ছবি আঁকতাম, পড়তাম। ছোটবেলা থেকে এই একা থাকার ব্যাপারটা আমার চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে তাকে এখন আর আলাদা করা সম্ভব নয়। জানেন, আমি ভয়ানক হইচই করতে ভালোবাসি। আউটডোরে যে ইউনিটের সঙ্গে যাই না কেন, সবার সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিতে আমার খুব একটা সময় লাগে না। কিন্তু এত হইচই, হুল্লোড়ের মধ্যেও আমার ভেতরটা কেমন যেন একা হয়ে যায়। ঠিক বোঝাতে পারব না।
প্রশ্ন: আপনার এই ব্যবহারে স্বামীর রিঅ্যাকশন কীরকম?
জয়শ্রী: স্বাভাবিকভাবেই যা হয়ে থাকে, প্রথমটায় ভুল বোঝাবুঝি, তারপর সব ঠিক। আসল কথা হলো প্রবীর ভয়ানক কনসিডারেট এবং অ্যাকোমোডেটিংও। আমার ফিলিংস ও বুঝতে পেরেছে সহজেই।
প্রশ্ন: নিজের কাজের সমালোচনা আপনি সহ্য করতে পারেন?
জয়শ্রী: অভিনয়ের কথা বলছেন তো?
প্রশ্ন: অভিনয় বা পারিবারিক কাজ, দুটোই
জয়শ্রী: আগে অভিনয় সম্পর্কেই বলি। সমালোচনা অর্থে মন্দভালোর আলোচনা তো? আমাকে নিয়ে তেমন কোনও সমালোচনা আমার চোখে পড়েনি। ফ্যানমেল বা খবরের কাগজ শুধু প্রশংসাই করেছে। একমাত্র বাবা আর প্রবীর আমার কাজের সমালোচনা করেন। এবং বলা বাহুল্য, তাঁদের আলোচনা আমার খারাপ দিকগুলো নিয়েই। তাতে আমার উপকারই হয়, ক্ষতি কি? কাজ খারাপ করলে তো সমালোচনা হবেই। এটা সহ্য না করার কী আছে! আর পারিবারিক ব্যাপারে আমরা দু’জনে মিলেই সব কাজ করি। ভুলচুকের শেয়ার আমাদের দু’জনেরই।
আরও পড়ুন: সৌমিত্র-উত্তম একসঙ্গে (পর্ব ১)
প্রশ্ন: বহু পুরোনো প্রশ্ন হলেও আপনার মতটা জানা দরকার। ছবিতে সেক্স বা নিউডিটি সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
জয়শ্রী: সেক্স তো লাইফেরই একটা অঙ্গ। খাওয়া-পরা-কথা বলার মতো সেক্সুয়াল অ্যাক্টও লাইফের অংশ। এ নিয়ে আলোচনার কী আছে! তবে আমাদের দেশের ছবিতে, বিশেষ করে হিন্দি চলচ্চিত্রে, এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাকে নিয়ে যে নোংরা ব্যবসা চলছে, সেটা খুবই ইরিটেটিং। সেক্স লাইফ ডেপিকশনে তারা নর্মালসির ধারেকাছও নয় বরং উল্টোটাই দেখায়। এটা বন্ধ করা দরকার।
প্রশ্ন: ফিল্ম লাইনের গুজবে আপনি বিশ্বাস করেন?
জয়শ্রী: কোনও গুজবেই আমি বিশ্বাস করি না। কারণ সত্যি ঘটনা আর গুজবের মধ্যে দূরত্ব টালি থেকে টালার চাইতেও বেশি। তাছাড়া এই ফিল্ম লাইনের আজগুবি গুজবে কান দিলে তো কবেই বাইরে চলে যেতে হতো!
প্রশ্ন: কেন, আপনাকে নিয়ে তেমন কিছু হয়েছে নাকি?
জয়শ্রী: তেমন কিছু না হলেও, সামান্য কিছু তো হয়েছিল বটেই। দাদার (উত্তমকুমার) সঙ্গে নাম জড়িয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু খবর কাগজে বেরিয়েছিল। আমি ব্যাপারটা জানতাম না, কাগজটাও পড়িনি। স্টুডিয়োয় যেতে উত্তমদাই আমাকে প্রথম খবরটা দেখালেন। রসিকতার সুরে বললেন, ‘আমার ৫০ বছর বয়স হতে চলল, এখনও এমন সব খবর বেরোচ্ছে। কী বলব বলো! যাই হোক, তোমার বাড়ির লোকেরা কিছু ভাববেন না তো?’ বাড়ির লোক ভাববেনটা কী? তারা আমাকে খুব ভালো করেই চেনে। এ ঘটনায় প্রথমে আমার নিজেরই একটু খারাপ লেগেছিল। তারপর বুঝেছি এ লাইনে থাকতে গেলে এরকম আজগুবি গুজবে কান দিলে চলবে না। তবে এমন ঘটনার পর আমার পেছনে যে ফিসফিস আলোচনা হয়েছিল, ইট স্ট্রেসড মি আ লট। বম্বেতে (মুম্বই) দেখবেন এ সব নেই। ওখানে যা হয় সব সামনাসামনি।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, শ্রাবণ ১৩৮১
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন