‘এত নিষ্ঠুর, কৃপণ হবে ভাবিনি’
উত্তমকুমারের প্রয়াণের পর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এই প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন নির্মল ধর। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই প্রতিবেদনের পুনর্মুদ্রণ
বিকাশ রায়: তিরিশ বছর আগে আলাপ, আলাপ থেকে পরিচয়, পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। ২৫-২৬ বছর ধরে বড়ভাই আর ছোটভাইয়ের সম্পর্ক। একসঙ্গে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করলাম। আমার পরিচালনায় উত্তম কাজ করল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ (Marutirtha Hinglaj), ‘রাজাসাজা’ এবং ‘কাজললতা’ ছবিতে। আমি ওঁর পরিচালনায় কাজ করলাম ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে। কাজে কাজেই এতদিনের সম্পর্কে কিছু গল্প তো আসবেই।
‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবির শুটিং করতে আমরা তখন দিঘায়। ততদিনে উত্তম বড় স্টার। মূল শহর থেকে আমাদের শুটিং স্পট সাত-আট মাইল দূরে, ওড়িশা বর্ডার পেরিয়ে। রোজ সকালে জোয়ারের সময় দিঘার বিচের ওপর দিয়ে আমরা গাড়িতে করে শুটিং স্পটে যেতাম। আবার সন্ধের ভাঁটার সময় ফিরে আসতাম। আমাদের খানদুয়েক লরি ছিল, খানদুয়েক ভ্যানও। বড় স্কেলের আউটডোর, তাই প্রচুর কর্মী, শিল্পী ও কলাকুশলী ছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ জন।
আরও পড়ুন: মৃণাল সেনের ছবি থেকে বাদ পড়লেন অমিতাভ বচ্চন
হঠাৎ একদিন একটা গুঞ্জন কানে এল। যাঁরা ছোট পার্ট করছেন তাঁদের কাছ থেকে গুঞ্জনটা উঠল। রোজ তাঁরা লরি করে যান আর বড় আর্টিস্টরা ভ্যানে যায়। আসলে ভেতর থেকে গোলমালটা পাকিয়েছিলেন একজন বড় আর্টিস্টই। আমি সব শুনলাম। উত্তমও শুনল। আমি ভাবছি, এইসব চাপা অসন্তোষ কাজের ক্ষতি করে, সুতরাং কীভাবে ব্যাপারটা ঠান্ডা করব।
তবে আমাকে কিছু করতে হল না। পরদিন সকালে আমি শুটিং স্পটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। উত্তমের কাজটা একটু দেরিতে ছিল, ওর পরে আসবার কথা। ওই যে বড় আর্টিস্ট গোলমাল পাকিয়েছিলেন, উত্তম তাঁকে আর তাঁর সহযোগী দু’-চারজনকে বলল, ‘চলো ভাই, আজকে আমরা হেঁটে যাই।’
আমরা আগে বেরিয়ে পড়েছিলাম। তার কিছুক্ষণ পরে উত্তম তাঁদের সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। আট মাইল হাঁটা তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! উত্তম ঠিক শুটিং স্পটে পৌঁছে গেল। বাকি সবাই বালির উপর পড়ে রইলেন। তাঁরা শিক্ষা পেলেন। আর কোনওদিন গোলমাল করেননি। উত্তম পরদিন থেকে লরিতেই আসা-যাওয়া করত।
গল্পটা বললাম এইজন্য যে, প্রোডাকশনের ব্যাপারে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা করবার যে স্বতঃস্ফূর্ত অ্যাটিটিউড উত্তমের ছিল, সেটা বোঝাবার জন্য।
গল্প অনেক আছে, সব তো আর বলা যায় না। তবে সেদিন ওর শোকসভায় আমি একটা কথা বলেছিলাম সেটাই আবার বলি। আমরা দু’জন প্রায় সমসাময়িক, বয়সে আমি ওর চেয়ে অনেক বড়, দশ বছরেরও বেশি। আমরা প্রায় একই সময় অভিনয় করতে ফিল্মে আসি। আমার খুব নাম হল, যশ হল, লোকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগল, ওই যে বিকাশ রায় (Bikash Roy)। আমি খুব খুশি হলাম। উত্তম কোথায় পিছনে ছিল, খেয়ালও করিনি। কিন্তু ওর একাগ্রতা, নিষ্ঠা এবং অধ্যাবসায় দিয়ে ধীরে-ধীরে আমার কাছে এগিয়ে এল। তারপর আমি কিছু বোঝবার আগেই ও আমাকে ছেড়ে এগিয়ে গেল। যখন বুঝতে পারলাম তখন সে অনেক দূরে। অনেক দূরে একটা জ্যোতিষ্ক। আমি অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে ক্ষোভ হল নিশ্চয়ই। সান্ত্বনা পেলাম এই ভেবে আমি তো দশ বছরের বড়। শেষ রেসে আমি ওকে হারিয়ে দেবই।
কিন্তু এত নিষ্ঠুর, এত কৃপণ উত্তম হতে পারবে, আমি ভাবিনি। এবারও উত্তম আমাকে হারিয়ে দিয়ে রাজার মতো চলে গেল। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, সংখ্যা অজ্ঞাত
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন