‘সমাজের কীট বলেই ভাবত আমাদের’
তিনি ছিলেন বাংলা ছবির অন্যতম সুপারস্টার। শুধু অভিনয় নয়, তাঁর গানেও মুগ্ধ ছিল বাঙালি দর্শক। আজ থেকে অর্ধশতক আগে কানন দেবীর (Kanan Devi) এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নির্মল ধর। আজ, অভিনেত্রীর প্রয়াণ দিবসে WBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ
নির্মল ধর: প্রথম যখন ছবি করতে এলেন, তখন আপনাকে পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে কী ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?
কানন দেবী: তখন আমার বয়স কত হবে, এই আট কী নয়! বোধহয় খুব ছোট ছিলাম বলেই খুব বেশি বাধা আসেনি। তাছাড়া আর্থিক কারণও ছিল কিছু। পরিবারের কথা যদি বলো, তাহলে ফুল কনসেন্টেই এ-লাইনে এসেছি। আর ফ্যামিলি বলতে তো একমাত্র মা ছিলেন। বাবা মারা গিয়েছিলেন আগেই। আর যদি সমাজের কথা বলো তাহলে বলব তখন তো এমনিতেই সামাজিক রীতিনীতি রক্ষণশীল ছিল। তার ওপর আবার বায়োস্কোপের লাইন! অচ্ছুৎ, একঘরে করে রাখার মতোই ব্যবহার ছিল আমাদের সঙ্গে। আমরাও যে মানুষ, এটা অনেকেই ভাবত না। নাক সিটকানো, ভুরু কোঁচকানোর মধ্য দিয়ে তারা সমাজের কীট বলেই বুঝি ভাবত আমাদের! তবে পরবর্তী কালে সাধারণের কাছ থেকে যে সম্মান, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি এবং এখনও পাচ্ছি, তার জন্য আমি নিশ্চয়ই খুশি ও কৃতজ্ঞ। তবে তখন যে কোনও সম্মান পাইনি শুধুমাত্র ঘৃণা কুড়িয়েছি, এটাও ঠিক নয়। সম্মান তখনও পেয়েছি। এ ব্যাপারে আর একটা কথা বলব, জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য নিজের যোগ্যতা যেমন থাকা দরকার, তেমনই কিছু মাত্রায় প্রচারের প্রয়োজন ছিল। আমরা কিন্তু পাবলিসিটি খুব একটা পাইনি। তখন এত সিনেমা পত্রিকাও ছিল না, সাপ্তাহিক বা দৈনিকে সিনেমার খবরও খুব একটা ছাপা হত না। প্রতিটি স্টুডিয়োর নিজস্ব পাবলিসিটি অফিসার থাকতেন। তিনিই যেটুকু করার করতেন। তবে সেখানেও অতিরিক্ত কিছু দিতে হত, নাহলে প্রচার হয়তো বিপক্ষে যেত। আমার বেলায়ও ওরকম হয়েছে দু’একবার। সকাল সন্ধে দু’জনে একই জায়গায় বসে কাজ করেছি, কথা বলেছি, হেসেছি আবার তিনিই পেছনে গিয়ে বেনামে বা স্বনামে অপপ্রচার চালিয়েছেন। কারণ, আমি তাঁকে আলাদাভাবে এন্টারটেন করিনি, মিষ্টি করে দুটো কথা বলিনি, এই জন্য। তা যাইহোক, সম্মান তিরিশজনের কাছ থেকে না পেলেও বাকি সত্তরজনের থেকে তো পেয়েছি।
প্রশ্ন: তখনকার পরিচালকদের থেকে অভিনয় করার ব্যাপারে কী ধরনের সহযোগিতা পেতেন?
কানন দেবী: জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নির্বাক ‘জয়দেব’ ছবি দিয়ে আমার অভিনয়ের শুরু। সাধারণত প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে যে একটা কনশাসনেসের ব্যাপার থাকে, তা আমার ছিল না। বোধহয় খুব ছোট ছিলাম বলেই। প্রথম অভিনয় করছি, সে কারণে জ্যোতিষবাবু ও পরবর্তী কালে অন্যান্য যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁরাও প্রত্যেকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করেছেন। আর তখন পরিচালকই ছিলেন সেই ইউনিটের অল-ইন-অল। তাঁর নির্দেশ কিছুমাত্র অমান্য করার সাধ্য কারওরই ছিল না। সেই সকাল থেকেই স্টুডিয়োতে গিয়ে বসে থাকতাম। সেজেগুজে ফ্লোরে অপেক্ষা করতে হত, কখন ডাক পড়বে। আর এখন তো শুনি আর্টিস্টদের কথা অনুযায়ী পরিচালককে চলতে হয়। সারাদিনে হয়তো পাঁচটা শট টেক হল! আরও একটা ব্যাপার, তখন গ্ল্যামারের ওপর এত নজর ছিল না। প্রযোজক বা দর্শক, কারওর না। কাজেই অভিনয়ের ধারার ওপরেই জোরটা পড়ত বেশি। আমরা অভিনয় করেছি পরিচালকের নির্দেশে। তাঁরা যেভাবে বলেছেন সেভাবেই করেছি। তার ফল তো খুব একটা খারাপ হয়নি। আর এটাও তো ঠিক, প্রথম যখন অভিনয় করতে এসেছি, তখন পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া চলবই বা কী করে!
প্রশ্ন: তখন তো চলচ্চিত্র আঙ্গিকের দিক থেকে আজকের মতো এত উন্নত হয়নি। অভিনয় করতে গিয়ে আপনার এ ব্যাপারে কোনও অসুবিধা হত কি? হলে কীরকম হত?
কানন দেবী: অসুবিধা তো নিশ্চয়ই হত। তবে এখন আঙ্গিকের এত উন্নতি হয়েছে বলেই তখনকার অসুবিধাগুলো এত বড় হয়ে চোখে লাগছে। তখন ওই ধরনের অবস্থাতেই কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল। অসুবিধা হলেও কিছু করার ছিল না। ক্যামেরা তখন প্রায় মুভই করত না। এক জায়গায় ক্যামেরা রেখেই একটানা হয়তো কোনও গান বা একটা গোটা দৃশ্য তোলা হত। ‘কণ্ঠহার’ ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল। আমি বিছানার ধারে স্বামীর পাশে বসে গান গাইছি। আমার সামনে কোনাকুনি অর্কেস্ট্রা পার্টি বসে, কারণ তখনও প্লেব্যাক আসেনি। দৃশ্যের মধ্যেই নিজেকে গান গাইতে হত। আমার ডানদিকে ক্যামেরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সামনে পরিচালক। ওই গান গাওয়ার দৃশ্যটিতে আমাকে কতগুলো কাজ করতে হচ্ছে ভেবে দেখো। সুর-তাল ঠিক রেখে গান গাইছি, অভিনয়ের মুড আনছি, পরিচালকের হাতের ইশারায় মাঝে মাঝে ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছি। তাও আবার যেভাবে হোক তাকালে চলবে না। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ঠিক রেখে কোন ফ্রেমে মুখটা ঠিক আসবে, এসব চিন্তাভাবনা করে মুখ ঘোরাতে হচ্ছে। তাহলেই বুঝে দেখো একটা সিন করতে গিয়ে আমাকে একসঙ্গে কতদিকে নজর রাখতে হচ্ছে। আর আজকের দিনে তো অনেক সুবিধা। একটা গানের দৃশ্যের হয়তো গোটা কুড়ি শটে টেক হচ্ছে। কাজেই অভিনয় করার পদ্ধতি খুব একটা না পাল্টালেও আঙ্গিক অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ভীষণ হেল্প করে।
প্রশ্ন: আর কী অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন?
কানন দেবী: আরও ছিল। ক্যামেরা তখন এগনো পেছনো ছাড়া প্যানিং করত না। তখন পাওয়ারফুল লেন্স ছিল না। ক্রেন ছিল না। ছিল না জ়ুম লেন্স। তারপর ধরো আউটডোর শুটিং। দিনের আলোয় রিফ্লেক্টর দিয়ে যখন আলোগুলো চোখে ফেলত, বড্ড অসুবিধে হত। রীতিমতো শক্ত ছিল তখন সিনেমায় অভিনয় করা। আউটডোরের কাজে আজকাল তো সব ডাবিং হয়। অনেক সুবিধা এতে। ক্যামেরার বিভিন্ন ধরনের লেন্স তখন আমেরিকা বা ইউরোপে পাওয়া যেত। আমাদের দেশে আসেনি। আমিই তো প্রথম আমেরিকা থেকে ১৯৪৮ সালে কোটেড লেন্স এনে বোধহয় ‘অনন্যা’ ছবিতে ব্যবহার করেছিলাম। তারপর ধরো প্লেব্যাকের ব্যাপার। এরকম অসুবিধা বহু ছবিতে বহুবার হয়েছে, কত আর বলব!
আরও পড়ুন: “এত নিষ্ঠুর, কৃপণ হবে ভাবিনি”
প্রশ্ন: আপনার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে কোন চরিত্রটি আপনাকে বিশেষভাবে অভিভূত করেছে এবং কেন?
কানন দেবী: এর উত্তর দেওয়া বড় কঠিন। আত্মতুষ্টি এসেছে বহু ছবিতেই। আমি অবশ্য সাধারণত একটা ডেপথ আছে, এ ধরনের চরিত্রই বেশি পছন্দ করতাম। ট্রাজেডি ঠিক নয়, তবে চরিত্রের গভীরতা থাকলে সেগুলোই আমার ভালো লাগত। যেমন ধরো, ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে অনুরাধা, ‘কৃষ্ণলীলা’য় রাধা, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’র নামভূমিকায়। আমি নিজে করেও যেমন আনন্দ পেয়েছি, দর্শকও খুব প্রশংসা করেছে। এ ব্যাপারে একটা মুশকিল কী জানো, অভিনয় করার সময় যথাসাধ্য মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করি। অনেক চরিত্রেই অভিনয় করতে বেশ ভালো লাগে, একাত্ম হয়ে যাই। পরে আবার হয়তো অন্য কোনও আরও সুন্দর চরিত্র পেয়ে তাকেই আবার ভালোবাসি। কাজেই নির্দিষ্টভাবে কোনও ছবির বা চরিত্রের নাম করা সম্ভব নয়। উচিতও নয়। তারপর ধরো আমার শেষ ছবি ‘ইন্দ্ৰনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদাদি’তে অন্নদাদির চরিত্রে কাজ করে খুব ভালো লেগেছে।
প্রশ্ন: ‘শেষ উত্তর’ ছবির চরিত্রটি কেমন লেগেছে?
কানন দেবী: না, ওটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। যে ধরনের চরিত্র আমি পছন্দ করি ওটা ঠিক সে ধরনের ছিল না। বেশ লাইট বা হালকা ছিল।
প্রশ্ন: চলচ্চিত্রকে আপনি কী হিসেবে মানতে প্রস্তুত, প্রমোদমাধ্যম না শিল্পমাধ্যম?
কানন দেবী: আমাদের সময় তো ফিল্মকে পুরোপুরিভাবে প্রমোদমাধ্যম হিসাবেই ধরা হত। আর্টের ব্যাপারটা তখনও পরিচালকদের খুব একটা ভাবিত করেনি। এখন তা করছে। ছবির বিষয়বস্তু, সংলাপ, ঘটনাবলী সবকিছুই মেলোড্রামার পথ ছেড়ে রিয়্যালিটির দিকে এসেছে এবং এটা নিঃসন্দেহে সুলক্ষণ। তাই বলে ‘শিল্প শিল্পর জন্যই’ এ ধুয়ো তুলে যদি কেউ বাংলা দেশের মতো সংকটময় ব্যবসার ক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে বসেন, তবে তা স্বাভাবিক কারণেই অসম্ভব। শিল্প তো মানুষের জন্যই তৈরি। সুতরাং যে শিল্প মানুষকে কিছু দিতে পারে না, তার আবার মূল্য কী? আমার তো মনে হয়, চলচ্চিত্রকে জনশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম করা উচিত। পুরোপরিভাবে প্রমোদমাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেও ছবি দিয়ে কি কিছু শেখানো যায় না? নিশ্চয়ই যায়, আর সেটা হওয়া দরকার। তবে এটাও দেখা দরকার, দর্শককে এন্টারটেন করতে গিয়ে উগ্র বা অশ্লীল ধরনের কোনও দৃশ্যের মাধ্যমে ছবির মূল বক্তব্যকে যেন ঢাকা না দেওয়া হয়। সারাদিনের ক্লান্তির পর সাধারণ দর্শক যখন প্রেক্ষাগৃহে যান তখন তিনি অবশ্যই এন্টারটেনড হতে চাইবেন। সুতরাং প্রমোদের মধ্যে দিয়েই আর্টের চর্চা, শিক্ষামূলক বক্তব্যের অনুপ্রবেশ করানো উচিত। তবে যদি কেউ শুধুমাত্র আর্টের চর্চাই করতে চান, তাহলে তাকে ব্যবসায়িক দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে রাখতে হবে। এসব কাজ এমজিএম বা টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স করতে পারে। ওদের বছরে পঞ্চাশ-ষাটখানা ছবির প্রোডাকশন হয়। কাজেই দু’একটি ছবিতে যদি ওদের কয়েক হাজার ডলার ক্ষতি হয়, তাতেও ওদের গায়ে লাগবে না। আমার মতে ছবি প্রমোদমাধ্যম হোক, সঙ্গে সঙ্গে শিল্পচর্চাও করুক।
প্রশ্ন: বর্তমানে চলচ্চিত্রে অভিনয় সম্পর্কে আপনার কী মত? অভিনদের ধারার কি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়? যদি হয়ে থাকে, সেই পরিবর্তন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
কানন দেবী: পরিবর্তন তো হয়েইছে। আগেকার অভিনয়ে যে থিয়েট্রিক্যাল টাচ ছিল, তা আজকাল আর দেখাই যায় না। তাছাড়া ছবির মূল গুণগত ব্যাপারগুলোরও তো পরিবর্তন হয়েছে। সুতরাং অ্যাক্টিংয়ের ব্যাপারেও পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। এ পরিবর্তন আমার ভালোই লাগে। খারাপ লাগার কথাও নয় কারণ অবনতি তো হয়নি। উন্নতিই হয়েছে। তবে ওই যে আগেই বললাম, অভিনয়ের যে পরিবর্তন তা বেশিমাত্রায় আঙ্গিকগত। আঙ্গিকই তো আজকাল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কত সুবিধা করে দিয়েছে। এক একটা শটের টেক চার পাঁচবারের কম নেওয়াই হয় না। যদিও বা একটা শট ‘ওকে’ হল, অভিনেতা বা অভিনেত্রী পরিচালককে আবার নিজের মনোমতো টেক করতে অনুরোধ করেন। আমাদের সময়ে এসব ছিল না। একটা শটের জন্য একটা বা বড়জোর দুটো টেক। পরিচালক কখন ‘ও কে’ বলবেন সেই আশায় বসে থাকতাম। হয়তো অভিনয় করে নিজের স্যাটিসফেকশন এল না, কিন্তু তা বলার সাহস ছিল না। পরিচালক ‘ও কে’ বলেছেন, ব্যাস আর কোনও কথা নয়। তিনিই তো সর্বেসর্বা। তা যাইহোক, এখনকার ছবি মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই দেখি। অভিনয়ে বাস্তবের গা ঘেঁষে চলার যে রীতি, তা আমার খুবই ভালো লাগে।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, সংখ্যা অজ্ঞাত
Composed by Somnath Laha
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন