Features

ছবিতে গল্প থাকতেই হবে

মানুষের চিরাচরিত বিশ্বাসের মূল ধরে নাড়া দিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তৈরি হয়েছিল সিনমার নতুন ভাষা। ছবির গল্প নিয়ে প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন নির্মল ধরWBFJA-এর পাতায় রইল সেই প্রতিবেদনের পুনর্মুদ্রণ

সাহিত্য একটি স্বাধীন শিল্প মাধ্যম। ছবি, এমনকী স্টিল ফোটোগ্রাফিও আবার শিল্প। দুয়ে মিলে তৈরি হয়েছে সিনেমা বা চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র আজ বিশিষ্ট শিল্পগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে পরিচিত। সাহিত্যে যেমন গল্প, উপন্যাস, কবিতাকে নির্দিষ্ট একটা সংজ্ঞার বেড়াজালে আটকে রাখা যায় (এখন অবশ্য কেউই আর আটকে থাকতে চাইছে না), সিনেমাকে তেমন কোনও গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না। সাহিত্যের প্রধান তিনটি মাধ্যমেই তার অবাধ যাতায়াত। গল্প বা উপন্যাসের তো কথাই নেই, কবিতা নিয়েও একাধিক ছবি তৈরি হয়েছে।

উইলিয়াম শেক্সপিয়র থেকে শুরু করে আজকের বাজারে যে সব যৌন-উপন্যাস হট কেকের মতো বিক্রি হচ্ছে, তার উপর যেমন ছবি হচ্ছে, ক্লাসিক সাহিত্যও বাদ পড়ছে না। প্রযোজক ছবির জন্য কাহিনি নির্বাচনের আগেই দর্শকের কথা ভাবেন। আর সেই কারণেই ছবির জন্য একটা মজাদার গল্পের কথা মনে রাখতে হয় তাঁকে। তাই তিনি জনপ্রিয় লেখকের দ্বারস্থ হন। পরিচালক ছবি করেন, দর্শকের হাততালিও পাওয়া যায় অতি সহজেই।

আরও পড়ুন: একটু হলেও ব্যতিক্রমী

এতদিন চলে আসছিল এভাবেই। হয়তো বা চলত আরও বহুদিন। কিন্তু সর্বনাশা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সব ওলটপালট করে দিল। মানুষের চিরাচরিত বিশ্বাসের মূল ধরে নাড়া দিয়েছে এই যুদ্ধ। সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম কোনওটাই আর কোনও একটা জায়গায় স্থির থাকতে পারছে না। কারণ যাই হোক না কেন, চারদিকে আলোড়ন জেগেছিল যুদ্ধের পরে। সাহিত্য ও চিত্রকলা যেমন অন্য গতিতে বইতে শুরু করেছিল, ধর্মকে নিয়েও তেমন চুলচেরা বিচার শুরু হয়েছিল।

সিনেমাও তখন আর অলস হয়ে বসে থাকেনি। শুরু হয় সিনেমায় নবজাগরণ। ফ্রান্স আর ইতালিতে সিনেমাকে নিয়ে কাটাছেঁড়া, বিচার বিশ্লেষণ চলে প্রায় এক দশক ধরে। এতদিনের প্রচলিত নিয়মনীতি, ব্যাকরণের জাল ছিঁড়ে পরিচালকেরা সিনেমা আর্টকে এক নতুন প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এবং সেই দুরূহ কাজে তাঁরা সফলও হয়েছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাঁদের নিজস্ব চিন্তাকে পর্দার মূর্ত করে তুলতে সচেষ্ট হলেন। তাঁদের চিন্তার বাইরের যা কিছু সবই পরিত্যক্ত হল অপ্রয়োজনীয় বলে। নাটক-সংঘাতের প্রচলিত পথ হারিয়ে গেল জঞ্জালের আড়ালে। আসল ব্যাপার, চলচ্চিত্র আর পরনির্ভরশীল থাকতে রাজি হল না। পরিচালকেরাও সেই কথা ভেবে সিনেমাকে মুক্তি দিলেন।

আরও পড়ুন: পরিবেশ-রাজনীতির এক মায়াবী ইস্তাহার

সিনেমা যে তখন থেকে শুধুমাত্র স্বনির্ভর হল তা নয়, আকৃতি ও প্রকৃতিতে এক বিরাট পরিবর্তন এল। নিটোল গল্পের বেড়া ডিঙিয়ে কবিতার মতো মানুষের মানসিক চিন্তার গভীরে ডুব দিতে চাইল সিনেমা। আমরা পেলাম ‘বাইসাইকেল থিভস’, ‘লা দলচে ভিতা’র মতো ছবি। এসব ছবিতে গল্প যে একেবারেই অনুপস্থিত তা নয়। তবে গল্প ছাড়িয়ে চরিত্রের বিশ্লেষণই সেখানে মুখ্য। নিজের ভাষায় সিনেমা নিজেই আপন পথ বের করে নিল। অতীতে সিনেমাকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রধান শর্ত ছিল সর্বজনীন আবেদন। এখন তা পরিত্যক্ত। আজকের ছবিতে দর্শকের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার এক প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

তাই আজ গল্পের বাঁধানো পথ ছেড়ে সিনেমা পা বাড়িয়েছে নতুন জগতের মেঠো পথে। যেখানে জীবন আছে, নাটক নেই। সংকট আছে, পরিত্রাণের গলিগুজি নেই। বাস্তব আছে, উদ্ভট চিন্তা নেই। তবে গল্প যে একেবারে অনুপস্থিত তা বলা ঠিক নয়। প্রতিমা যেমন খড়ের কাঠামো ছাড়া গড়া যায় না, তেমনই বক্তব্য যাই হোক না কেন, একটা অবলম্বন অবশ্যই দরকার। কাঠামোকে ধরেই চরিত্র প্রাণ পায়। চরিত্রের বিভিন্ন অ্যাসপেক্ট লক্ষ্য করলে আমরা বাস্তবের ছোঁয়া পাই।

আরও পড়ুন: একসঙ্গে তিনটি ছবিতে উত্তমকুমার

সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) ‘নায়ক’ (Nayak) থেকে অগল্পাশ্রয়ী ছবি তৈরি করতে শুরু করেছেন। গল্প নেই, তবু ছবি। এমন ছবির সংখ্যা অবশ্য বাংলা দেশেই বেশি। মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ বা ‘ইন্টারভিউ’ বা সত্যজিৎবাবুর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সেই জাতের ছবি। গল্প নয়, দুঁদে সরকারি অফিসার ভুবন একদিনের ছুটি কাটানোর অভিজ্ঞতায় তার অনুভূতির পরিবর্তনই ‘ভুবন সোম’ ছবির মূল কথা। রঞ্জিত মল্লিক একমাত্র স্যুট না থাকার কারণে চাকরি পেলেন না, এ নিয়ে পরিচালক যতই হালকা ভঙ্গিতেই ছবি করুন না কেন, নায়কের মানসিক অস্থিরতাই ‘ইন্টারভিউ’ ছবির প্রধান বক্তব্য। আবার সিদ্ধার্থ তার আশপাশের হাজারো শত্রুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতায় পেরে না উঠলেও, তার শহরের প্রতি আকর্ষণই তাকে যথার্থ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ করে তোলে। অগল্পাশ্রয়ী ছবির উদাহরণ এগুলোই, তবে গল্পের ফিকে আবরণ একটা আছে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে গল্প ছাড়া ছবি হতে পারে না। এ কতদূর সত্য তা অবশ্যই বিচারের শুধু নয়, পাশাপাশি বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। চিত্রশিল্পী রং দিয়ে মূহূর্তের একটি বিভ্রান্ত চিন্তাকে ক্যানভাসে ধরে রাখেন। যদিও বহু ক্ষেত্রে দুর্বোধ্যতার আড়ালেই তাদের বাস, তবু সর্ব ব্যপ্তিতাও শিল্পের অন্যতম শর্ত।

Uttam Kumar

তাই জন্ম নিয়েছে ইঙ্গিতধর্মী ছবি, সিম্বলিক ফিল্ম আর পোয়েটিক ফিল্ম। শেষেরটা কবিতাধর্মী ছবি। ইঙ্গিতধর্মী কাহিনিচিত্র আমাদের দেশে তেমনভাবে তৈরি হয়নি, গুটিকয়েক ছোট ছবি ছাড়া। তবে কবিতাধর্মী ছবি একেবারেই অনুপস্থিত। ফরাসি পরিচালক রোবে গ্রিলের ‘লা ইম্মরতেল’ এই জাতের ছবি। ছবির কবিতাধর্ম বলতে বোঝায় ব্যক্তিগত ও বিমূর্ত অভিব্যক্তির মাধ্যমে চরিত্র বা ঘটনার পরিস্ফুটন। কিন্তু কবিতাধর্মী ছবি কোনও বিশেষ ঘটনা বা চরিত্র নয়। প্রতিটি ফ্রেমের মধ্য দিয়ে মনোজগত বিচিত্র ব্যবহারে এক কাব্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করে।

ফিল্মের কাব্যধারায় ইঙ্গিতময়তার তাৎপর্য অপরিসীম। তবে বাস্তব চরিত্র বা সমস্যার যে কোনও প্রয়োজন নেই তা বলা যায় না। ছবিতে কবিতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন বাস্তব চরিত্র ও ঘটনাগুলিকে স্রষ্টার মনন ও অনুভূতির প্রতীকে রূপান্তরকরণ। তাদের সত্তার আভাসটুকু থাকে মাত্র, বেশি স্বরূপ থাকলেই কিংবা অত্যধিক বর্ণনাত্মক বা বাস্তবনির্ভর হলেই লিরিকের শুদ্ধ নির্যাসটুকু হারিয়ে যায়। ফিল্মকাব্যের মূল শর্তই হচ্ছে আঙ্গিক ও বিষয়কে সামগ্রিকভাবে শিল্পীর কল্পনায় রূপান্তর করা।

আরও পড়ুন: “টাকা চেয়ে বসলেন বাবা”

সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ বা সাম্প্রতিক ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে ছবির কবিতাধর্মিতার প্রকাশ একাধিক দৃশ্যে পাওয়া যায়। ‘চারুলতা’র ঝড়ের মধ্য দিয়ে অমলের ‘হরে মুরারি মধুকৈটভারে’ আবৃত্তি করতে-করতে প্রবেশের দৃশ্য, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় শিশুর ঘোড়ায় চড়ে বারবার ঘোরা ও বলা, ‘মা আমি তিনবার ঘুরেছি আবার ঘুরব’ বা শেষ দৃশ্যে নেপালি শিশুটির চকোলেট খাওয়ার দৃশ্যে নেপালি লোকসঙ্গীতের সুর বাজানোর দৃশ্য এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র শেষ দৃশ্য যথার্থ ফিল্মকাব্যের উদাহরণ। মৃণালবাবুর ‘ভুবন সোম’, তপন সিংহের ‘অতিথি’ ও ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’র এরকম একাধিক ইঙ্গিতময় ও কাব্যধর্মী দৃশ্য আছে। অথচ এই প্রতিটি ছবিরই একটা গল্প আছে। তাই বলা যায় গল্প ছাড়া সাদাপর্দায় তা প্রকাশ করা গেলেও তা জনগ্রাহ্য ছবি হতে পারে না। চরিত্র বা ঘটনার বির্মূত চিত্রায়ণ মূল ছবির কোনও বিশেষ অংশে স্থান পেতে পারে বটে কিন্তু সম্পূর্ণভাবে স্থান পেতে পারে না।

অগল্পাশ্রয়ী ছবির কথা যত জোর দিয়েই বলা হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তা সোনার পাথরবাটির মতো অপ্রাপ্য। ছবি যত সুন্দর বা উদ্ভট, বড় বা ছোট হোক না কেন একটা গল্প থাকতেই হবে। এক মিনিট দৈর্ঘ্যের কয়েকখানা ছবি দেখেছি, সেখানেও গল্প আছে। কোনওটার গল্প আবার এত বড় যে বলতেই হয়তো একশো মিনিট লেগে যাবে। এদিকে ছবির সময়কাল মাত্র এক মিনিট। কাহিনিচিত্র হলে তো কথাই নেই।

প্রথম প্রকাশ: অমৃত, পৌষ ১৩৭৭


Edited by Balmiki Chatterjee
Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *