Reviews

অনন্য মায়াময় ফ্রেম তৈরি করে ‘ডিয়ার মা’

ছবি: ডিয়ার মা

পরিচালনা: অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী

অভিনয়ে: জয়া আহসান, চন্দন রায় সান্যাল, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, অনুভা ফতেপুরা, নন্দিকা দাস, অহনা, পদ্মাপ্রিয়া জানকিরমণ, সায়ন মুন্সি, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, সোনালি গুপ্ত

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট

WBFJA রেটিং ★★★★★★★★☆☆

বহু বছর পর বাংলা ছবি পরিচালনায় ফিরলেন অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী (Aniruddha Roy Chowdhury)। কেমন হল তাঁর নতুন ছবি? দেখে এলেন স্বাতী চট্টোপাধ্যায়

‘আমার জন্য সইলে তুমি অনেক ব্যথা/বুঝিয়ে দিলে মা হওয়া নয় মুখের কথা!’

সত্যিই বোধহয় মা হওয়া খুব সহজ নয়। বৃন্দা তাই মা হতেই চায়নি। কারণ আমাদের চেনা সামাজিক পরিকাঠামোয় সন্তানের জন্য যাবতীয় ত্যাগস্বীকারের বেশিরভাগটাই করতে হয় মায়েদের। মা রাত জাগবে, মা খাইয়ে দেবে, মা ঘুম পাড়াবে আর দরকার হলে মা চাকরি ছাড়বে। এর অন্যথা হলে মায়ের দিকে আঙুল ওঠে। বৃন্দা (জয়া) ব্যস্ত চাকুরে, তায় অফিসে নতুন ভূমিকায় মহাব্যস্ত। তার স্বামী অর্কও (চন্দন) ব্যস্ত মানুষ কিন্তু সে চায় বাবা হতে। দুজনের মধ্যে দুরন্ত প্রেম থাকা সত্ত্বেও এই জায়গায় কিছুতেই তাদের মতের মিল হয় না। বৃন্দা বুঝতে পারে না কেন সব মেয়েকেই মা হতে হবে। আর অর্ক বোঝে না কেন শুধু বৃন্দার জেদটাই চলবে।

অবশেষে মাঝামাঝিতে রফা হয়। অনাথ আশ্রম থেকে বাড়িতে আসে ছোট্ট ঝিমলি। সে বাবার প্রাণ, বাবা অন্তপ্রাণও বটে। বৃন্দা যেন এই বাবা-মেয়ের পৃথিবী থেকে কিছুটা দূরে বাস করে। সে নিজেও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সে ঠিক ভালো মা হওয়ার যোগ্য নয়। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা তার আসে না। এরই মধ্যে অর্কর আচমকা মৃত্যু যেন ঘাড় ধরে বৃন্দাকে অনেকগুলো কঠিন সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। দত্তকের নিয়ম মেনে ততদিনে ঝিমলি (অহনা) জেনে গেছে তার আসল মা অন্য কেউ। বৃন্দা প্রাণপণে আগলে রাখে ঝিমলিকে। তার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটা প্রয়োজন মেটায় সে মেয়ের। কিন্তু শুধু দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণে কি একটা গোটা শৈশব কৈশোর পার করা যায়? কীভাবে যেন একদিন বারো বছরের ঝিমলি (নন্দিকা) খোঁজ পেয়ে যায় অহনা নায়রের (পদ্মাপ্রিয়া)। তার আসল মা। তারপর একদিন সে নিখোঁজ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: মৃণাল সেনের ছবি থেকে বাদ পড়লেন অমিতাভ বচ্চন

ছবির শুরু হয় ঝিমলির নিখোঁজ হওয়া দিয়ে। থানার আইসি মিঃ নন্দীর (শাশ্বত) মুখোমুখি বৃন্দা ও তার স্যর সোমেশ (ধৃতিমান)। বাড়ি এবং অফিস সামলে ভীষণ ব্যস্ত নন্দী যেন শুনেও শোনে না বৃন্দার অভিযোগ। কোথায় গেল ঝিমলি, সত্যিই কি বৃন্দা জানে না? নাকি সে জেনেও বলবে না। অফিসার নন্দী কি আদৌ পারবেন ঝিমলিকে খুঁজে এনে দিতে?

বাংলা ছবির নিয়মিত পরিচালক নন তিনি। ঘনঘন ছবি করেন না অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী। কিন্তু তাঁর সমস্ত কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষে-মানুষে আত্মিক সম্পর্কের এক গভীর চিত্র ধরা পড়ে। এ ছবি তার ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং বর্তমান সমাজের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলে যায়।

আরও পড়ুন: “এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে”

যেমন গাড়ির স্টিয়ারিং বহুদিন হল মেয়েদের হাতে চলে গেছে তেমনই ব্যাকসিটে বসে সদ্যোজাতকে সামলানোর ভারটাও একজন পুরুষ এবার নিতেই পারেন। তাতে তার গৌরব এতটুকু কমে না। আবার সারাক্ষণ বাচ্চার সঙ্গে লেপটে না থেকেও মা হয়ে ওঠা যায়। গোটা ছবিটাই বৃন্দার এই মা হয়ে ওঠার গল্প। হ্যাঁ,  মেয়েরা মায়ের জাত বটে, কিন্তু তার মানেই তো সব মেয়ে ভালো মা হয়ে ওঠে না। দিনের শেষে একজন দায়িত্বশীল ও অন্তর্মুখী মানুষ কীভাবে ক্রমশ নিজের ইগো, জেদ কিংবা আত্মসচেতনতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে সত্যি সত্যি মা হয়ে ওঠে, কিংবা অন্য মানুষ হয়ে ওঠে সেই জার্নিকে খুব যত্নে তুলে এনেছেন পরিচালক। মা মানেই আবেগপ্রবণ, ভিতু, আদুরে এক আশ্রয় এমনটা তো নাও হতে পারে। মা মানে ছাতা, মা মানে নির্ভরতা। কিন্তু তবু মা যেন ঠিক কাছের নয়, সেই অভাববোধই হয়তো ঝিমলিকে নিয়ে গিয়েছিল তার আসল মায়ের কাছে। তবু অপরাধবোধ ছিল তারও। যে-মামমামকে সে ভালোবাসতে চেয়েও ভালোবাসতে পারে না তার জন্যেও কান্না এসেছিল ঝিমলির চোখে, দমবন্ধ লাগছিল তার দিনের পর দিন। এও যে ভালোবাসারই নামান্তর!

ছোট্ট অহনা আর একটু বড় নন্দিকা এই ছবির প্রাণ। দুজনেই অনবদ্য, দুজনেই অসাধারণ। জয়ার মতো করে বৃন্দা হয়ে উঠতে বোধহয় আর কেউ পারত না। তেমনই সহজ সাবলীল চন্দনও। তাঁর মতো স্বাভাবিক অভিনেতা কেন এত কম কাজ করেন জানা নেই। শাশ্বত বড় বেশি কাঠখোট্টা এক পুলিশের ভূমিকায় মন ভালো করা অভিনয় করলেন। একইসঙ্গে বিরক্তি, মজা এবং শেষে গলার কাছে ব্যথার অনুভূতি বোধহয় একমাত্র শাশ্বতই দিতে পারেন।

Uttam Kumar

আর একজন যাঁকে ছাড়া বোধহয় এত মায়ার ফ্রেম গড়ে উঠত না। নির্মলার ভূমিকায় অনুভা। গৃহসহায়িকারাও যখন পরিবারের সঙ্গে মিশে যান তখন সত্যি বড় মায়াময় সব মুহূর্তের জন্ম হয়। অনুভা মনে রাখার মতো অভিনয় করলেন এ ছবিতে। খুব ঝকঝকে এক চরিত্রে ধৃতিমান আলাদা একটা ভালোলাগা রেখে গেলেন। এছাড়া পদ্মাপ্রিয়া স্বল্প উপস্থিতিতে বেশ ভালো। অনেকদিন পর পর্দায় সায়নকে দেখতে বেশ লাগল। অম্লানের ভূমিকায় সুশান্ত ভট্টাচার্য মানানসই। মাহির ভূমিকায় ছোট্ট অদ্বিতীয়া মিত্র সুন্দর অভিনয় করেছেন।

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য ও অনিরুদ্ধর চিত্রনাট্য ভারী হৃদয়গ্রাহী। বিক্রম ঘোষের সুরে গানগুলো শুনতে ভালো লাগে। তবে বাংলা ছবিতে হিন্দি গানের ব্যবহারের কারণ স্পষ্ট নয়। ছবি শেষে টাইটেল কার্ডে মায়েদের লেখা চিঠির সম্ভার দর্শককে আবেগপ্রবণ করবে। তবে আবেগ থাকলেও ছবিতে একটা অনুসন্ধানের সুরও সমানতালে চলতে থাকে। সে খোঁজ যেমন হারিয়ে যাওয়া ঝিমলির তেমনই আরও অনেককিছুর, যা ছবি না দেখলে বোঝা যাবে না। সেই স্বাদ পেতে প্রেক্ষাগৃহে গেলে চোখ এবং মন ভিজবেই এ কথা হলফ করে বলা যায়।


Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *