‘এখনকার ছবি শুক্রবারে আবিষ্কার, সোমবারে পরিষ্কার’
‘আপনজন’ দিয়ে আত্মপ্রকাশের পরে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘ধন্যি মেয়ে’ ও আরও অজস্র ছবিতে বাঙালির চিরচেনা অভিনেতা তিনি। আজকের প্রজন্ম তাঁকে জেনেছে ‘কহানি’ দেখে। উত্তম-সৌমিত্রের তুলনা কিংবা দিলীপকুমার প্রসঙ্গ থেকে আজকের বাংলা ছবির অবস্থা, সবকিছু নিয়ে খোলোখুলি কথা বলেছিলেন কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় (Kalyan Chatterjee)। শুনেছিলেন স্বাতী চট্টোপাধ্যায়। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ
স্বাতী চট্টোপাধ্যায়: সেই ষাটের দশক থেকে ছবিতে কাজ করছেন। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির কী-কী পরিবর্তন দেখলেন?
কল্যাণ: বাংলা ছবিতে পেশাদারিত্ব চিরকালই কম। তবু আগে যে যাঁর কাজটা নিজে করতেন। আজকাল একে অন্যের কাজে নাক গলায়। প্রযোজক নিজেই চিত্রনাট্য লিখছেন, গানের ক্ষেত্রেও তিনিই নাক গলাচ্ছেন। আগে তো প্রযোজক ফ্লোরেই আসতেন না। এখন বুঝুন না বুঝুন, সব ব্যাপারে তাঁদের মতামত দেওয়াটাই নিয়ম।
প্রশ্ন: সাদাকালো ছবি না হালের ওয়েব সিরিজ়, কোন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে আপনি বেশি স্বচ্ছন্দ?
কল্যাণ: অবশ্যই আগে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম। তখন একটা দিন সবাইকে ডেকে চিত্রনাট্য পড়ানো হতো। তপনদা (সিংহ) এটা করতেন। আরও অনেকেই করতেন। পুরো ব্যাপারটা খুব নিয়মমাফিক হতো। এখন অনেকের মধ্যেই সেই কনফিডেন্স দেখি না। এখন তো ঘটনাভিত্তিক ছবি বেশি হচ্ছে। ফলে মাঝেমধ্যে চিত্রনাট্যও বদলায়। কিন্তু তখন অনেক আগে তৈরি চিত্রনাট্য আমরা হাতে পেতাম। পরিচালক আমাদের সঙ্গে ছবি নিয়ে আলোচনা করতেন। এডিটিংয়ের দিন থেকে ছবি রিলিজ়ের তারিখ, সবই আমাদের জানানো হতো। এখন তো পুরো ব্যাপারটাই অনেক জটিল হয়ে গিয়েছে। একটা প্রেক্ষাগৃহে একইসঙ্গে ছ’টা ছবি চলছে। তাই সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আমাদেরও পাল্টাতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: শরৎ কাহিনির নব রূপায়ণ
প্রশ্ন: আপনার প্রথম ছবি তো ‘আপনজন’। কীভাবে সুযোগ পেয়েছিলেন?
কল্যাণ: আমি পুণা ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করি ১৯৬৭ সালে। ‘আপনজন’ নয়, প্রথম কাজ করি একটি অসমীয়া ছবিতে। দেবকী বসুর ছেলে দেবকুমার বসু ছিলেন পরিচালক। নিপন গোস্বামী, অসমীয়া ছবির অভিনেতা ও আমার বন্ধু, আমাকে অভিনয়ে নিয়ে আসে। এরপরে বাংলায় প্রথম ছবি ‘আপনজন’। আমি তো দিল্লির ছেলে। বাবা ওখানে চাকরি করতেন, আমার পড়াশোনাও দিল্লিতে। তার আগে গোয়ালিয়রে ও দুন স্কুলে পড়েছি। অভিনেতা না হলে আমি এয়ারফোর্সে যেতাম। কিন্তু অভিনয়ে চলে এলাম। তখন তো মুম্বইয়ে তিন নায়ক। দেব আনন্দ, দিলীপকুমার আর রাজে কপূরের যুগ। আমি অনুপ্রাণিত হই দিলীপকুমারকে দেখে।
প্রশ্ন: উত্তমকুমারের সঙ্গে অনেক ছবিতে কাজ করেছেন আপনি। কাছ থেকে দেখে কেমন লাগত তাঁকে?
কল্যাণ: উত্তমকুমার সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। সবাই সব জানেন। তবে ওঁকে আমি অন্যভাবে চিনতাম। অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আমার নিজের ছোটকাকা। সেই সূত্রে উত্তমকুমার আগে থেকেই আমাকে চিনতেন। তাই একটা আলাদা স্নেহ ছিলই। উত্তমকুমার খুব ভালোবাসতেন ছোটকাকাকে। আর ওঁকেই একমাত্র উনি ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। বাকি সকলকে ‘তুমি’ বলতেন।
আরও পড়ুন: হালচাল ঠিকঠাক হ্যায়
প্রশ্ন: বাঙালির চিরকালের প্রিয় তর্কের বিষয় উত্তম বনাম সৌমিত্র। আপনি কোন পক্ষে?
কল্যাণ: অবশ্যই উত্তমকুমার। উনি সবকিছু পারতেন। সৌমিত্রদার একটা পেশাদারি ইমেজ ছিল। কমেডি ভালো পারতেন না। নাচও পারতেন না। যদিও তখন নাচের যুগ আসেনি, তবু উত্তমদা প্রয়োজনে সেটাও করেছেন। গানে লিপ দেওয়ার ব্যাপারে আমি আর কী বলব! সকলেই জানে উত্তমদা কেমন ছিলেন। সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর উত্তম মিশে যেতেন। আলাদা করা যেত না। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে দুজনেই অনেক ভালো চরিত্র পেয়েছেন, উত্তমদা অসাধারণ অভিনয় করে গেছেন সেই সব রোলে। আর এখন সৌমিত্রদাও ভালো চরিত্র পেয়ে দারুণ অভিনয় করছেন।
প্রশ্ন: তপনবাবুর সঙ্গে তো আপনি প্রচুর ছবি করেছেন। ওঁর সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
কল্যাণ: আমি সবসময় বলি আমার শিক্ষাগুরু ঋত্বিক ঘটক। পুণাতে যখন ফিল্ম স্টাডিজ় পড়ছি তখন উনি ওখানে ভাইস-প্রিন্সিপাল ও আমার প্রোফেসর ছিলেন। অভিনয় জীবনে আমার কর্মগুরু ছিলেন তপনদা। প্রায় বারো-চোদ্দটা ছবি ও টেলিফিল্মে তপনদার সঙ্গে কাজ করেছি। বড়-বড় স্টারদের সঙ্গেও কাজ করেছি ওঁর সূত্রেই। ওঁর সঙ্গে কাজ করা মানে পুরোটাই শেখা।
প্রশ্ন: স্টারের প্রসঙ্গেই আসা যাক তাহলে। দিলীপকুমার তো আপনার প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ‘সাগিনা মাহাতো’তে আপনি কাজ করেছেন। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?
আরও পড়ুন: নতুন লুকে অপরাজিতা, কলকাতায় শুরু শুটিং
কল্যাণ: এককথায় দুর্দান্ত। আমাকে অনিলের ভাইপো বলে খুব স্নেহ করতেন উনি। কার্শিয়ংয়ে একসঙ্গে শ্যুটিং করেছি অনেকদিন। দিলীপকুমার খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন। আমি মাঝে-মাঝে ওঁকে কপি করতাম। সেই দেখে আমাকে বলতেন, ‘শালা, তুম মেরা নকল মারতা হ্যায়?’ একদিন একটা দামী কথা বলেছিলেন আমাকে। তখন তিনধারিয়া লুপে শ্যুটিং করছি আমরা। আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলছি দাদা হয়ে, বা তোমার কাকার বন্ধু হয়ে, কথাটা মনে রেখো। সবসময় তাঁদের সঙ্গেই মিশবে যাঁরা তোমার কাজকে আরও উন্নত করবে, আর যাঁরা তোমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।’ তখন এই কথাগুলোর মানে না বুঝলেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম। এখন তো উনি খুবই অসুস্থ, শুনলে খুব খারাপ লাগে।
প্রশ্ন: সেই সময় আপনি যে সব ছবিতে অভিনয় করেছেন, তা সে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হোক বা ‘আপনজন’ কিংবা ‘এখনই’, আপনার অভিনীত চরিত্রগুলো মোটামুটি একই ধাঁচের হতো। পড়াশোনা করেও চাকরি না পেয়ে অন্যভাবে বাঁচার চেষ্টা করা এক বিদ্রোহী যুবক। আপনি নিজের জীবনে কি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কখনও?
কল্যাণ: এটা ঠিক যে আমার একটা অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ইমেজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই সময়। তবে আমি জীবনেও চাকরি করিনি। দরকার পড়েনি। তখন একের পর এক ছবি করছি। আমার প্যাশন বা প্রোফেশন যাই বলো, সবই ছিল ওই অভিনয়। অল্প কিছু নাটকেও অভিনয় করেছি। শ্যামানন্দ জালানের পরিচালনায় বাদল সরকারের নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এ নাম ভূমিকায় অভিনয় করতাম আমি। হিন্দিতে হয়েছিল নাটকটা। ইংরেজি নাটকও করেছি, তবে সেও অল্পই। সময় ছিল না তখন।
আরও পড়ুন: ছ’মাসের শিশুর মুখটা উত্তমকুমারের
প্রশ্ন: ‘কহানি’র প্রসঙ্গে আসি। আপনাকে এই প্রজন্মের অনেকেই চেনেন ‘কহানি’র অভিনেতা হিসেবে। কীভাবে পেলেন ওই চরিত্রটা?
কল্যাণ: আমার সঙ্গে সুজয়ের আগে আলাপ ছিল না। ওর একটা বাড়ি আছে হরিশ মুখার্জি রোডে। সেখানে আমাকে একদিন ডেকেছিল। শাশ্বতও (চট্টোপাধ্যায়) ওখানে ছিল সেদিন। আমাকে দুটো লাইন ব্রিফ দিয়ছিল সুজয়। তারপর বলল, ‘তোমাকে এটা করতেই হবে।’ এইভাবেই হয়ে গেল। ছবিটা যে কেমন হয়েছিল সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নওয়াজ়উদ্দিন সিদ্দিকী তো ওই ছবির পরেই বিখ্যাত হয়ে গেল। তার আগে তো ও সেভাবে সুযোগই পায়নি।
প্রশ্ন: আপনার নিজের করা চরিত্রগুলোর মধ্যে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন ছিল কোনটা?
কল্যাণ: সুজিত গুহর প্রথম ছবি, রামকৃষ্ণকে নিয়ে। সেখানে আমি গদাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ছবিটা সুপারহিট হয়েছিল। আমার খুব কঠিন লেগেছিল এই চরিত্রটা। একটা টাইপের চরিত্র করে এসেছি আমি, সেই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বা ‘আপনজন’-এর ওরকম ইমেজের পরে সম্পূর্ণ আলাদা একটা চরিত্রে ঢোকা নিয়ে আমার মনে সংশয় ছিল। বাকি কোনও চরিত্র তেমন কঠিন লাগেনি কখনও। কিছুদিন আগে একটা ছবিতে রামকৃষ্ণের চরিত্রে কাজ করলাম। বিশ্বনাথ (বসু) নরেন হয়েছিল। এই ধরণের কাজগুলো আমার বেশ কঠিন লেগেছে। বাকি কোনও ছবি করতে গিয়ে কখনও মনে হয়নি যে এটা পারব না বা ওটা কঠিন।
প্রশ্ন: সদ্য ‘শেষের গল্প’ করলেন। আগামী দিনে আর কোন কাজ করছেন? টেলিভিশনে কিছু করছেন কি?
কল্যাণ: কিছুদিন আগে অভীক মুখোপাধ্যায়ের একটা ছবি করলাম। তবে টেলিভিশনে আর কাজ করব না। ওখানে কোনও মোটিভেশন নেই। দিনের পর দিন একই গল্প টেনে নিয়ে যায়। একঘেয়ে লাগে। শেষ ধারাবাহিক করেছি ‘সিঁদুরখেলা’। তারপর আর ইচ্ছে করেনি করতে।
প্রশ্ন: বর্তমানে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর কাজ হচ্ছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন ছবি আসছে। কিন্তু খুব কম ছবিই মনে দাগ কাটতে পারছে। এটা কেন হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
কল্যাণ: হ্যাঁ, অজস্র ছবি, অথচ একটাও ভালো নয়। কারণ শুধু টাকা দিয়ে ছবি হয় না। এখন ইন্ডাস্ট্রিতে টাকার জোগান আছে, কিন্তু ছবিটা কীভাবে করতে হবে সেটাই কেউ জানে না। আমি এই ছবিগুলোকে বলি শুক্রবারে আবিষ্কার, সোমবারে পরিষ্কার। একটা গল্পকে ভালো ভাবে প্রেজ়েন্ট করতে পারার ক্ষমতা লাগে। নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত এদের কাজ অনেক পরিণত। আরও কয়েকজন আছেন। অঞ্জন যেমন জানে কোন বিষয়টা নিয়ে ও ভালো ছবি করতে পারবে। পরিস্কার চিন্তাভাবনা নিয়ে কাজ করলে ছবিটাও ভালো হবে, আগে যে ব্যাপারটা ছিল। প্রত্যেকে নিজের জায়গাটা জানত—আমি এই ধরণের ছবি করতে পারি—সেটাই করব। এখান ওখান থেকে নকল করে, অন্য ভাষার ছবি থেকে টুকে বা যে কোনও বিষয়ে ছবি করে ফেললাম, এই পাকামিটা ছিল না বলেই তখন ভালো ছবি হতো।
প্রথম প্রকাশ: রেডিওবাংলানেট, আগস্ট ২০১৯
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন