‘কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করে না, কি রে খেয়েছিস?’
মৃণাল সেন থেকে অঞ্জন চৌধুরী, একসময় তিনি দাপিয়ে কাজ করেছেন টালিগঞ্জে। তারপর হঠাৎ করেই চলে যান অন্তরালে। ২০১৮ সালে রণদীপ সরকারের ছবি ‘নূপুর’-এ কামব্যাক করেছিলেন দেবিকা মুখোপাধ্যায় (Devika Mukherjee)। সেই সময় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন প্রবুদ্ধ নিয়োগী। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ
প্রশ্ন: অনেকদিন পর বড়পর্দায় ফিরলেন
দেবিকা: ফিরলাম মানে? আমি তো যাইনি কোথাও (হেসে)। ছিলাম সবসময়।
প্রশ্ন: কিন্তু ছবি তো করেননি
দেবিকা: না, তা করিনি।
প্রশ্ন: সেটার কারণ কী? ছবির অফার আসেনি, নাকি চিত্রনাট্য পছন্দ হয়নি?
দেবিকা: অফার যে আসেনি, তা নয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার চিত্রনাট্য পছন্দ হয়নি। তাছাড়া আমি কোনওদিনই কারওর কাছে গিয়ে—আমাকে কাজ দিন—এরকম দাবি করিনি। সেটা আমি পারি না। আমার জনসংযোগ ভালো নয়। যেসব পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁরা সবাই আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। তাঁরা মনে করেছেন এই চরিত্রটার জন্য দেবিকাই সবথেকে উপযুক্ত। তাই ডেকেছেন আমাকে।
আরও পড়ুন: আরতির থেকে বিদায় নিতে এলেন সৌমিত্র
প্রশ্ন: বাংলায় তো আপনি প্রথমসারির সব পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন
দেবিকা: একদম। তপন সিংহ, মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অঞ্জন চৌধুরী, আরও অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি। মুম্বইয়ে অমল পালেকরের ছবিতে অভিনয় করেছি। দারুণ সব অভিজ্ঞতা।
প্রশ্ন: তপন সিংহ ও অঞ্জন চৌধুরী তো দুই বিপরীত ঘরানার পরিচালক। এদের কাজের মধ্যে মিল বা অমিল কোথায়?
দেবিকা: দেখো, আমরা যারা অভিনয় করি, তারা একতাল মাটির মতো। পরিচালক যেভাবে গড়ে নেবেন, আমরা সেইভাবেই অভিনয় করব। যাঁর ছবিতেই অভিনয় করি না কেন, তিনি যেমন চাইছেন, আমাকে ঠিক তেমনটাই করতে হবে। সেটা করতে পারব, এই ভরসা থেকেই তো সেই পরিচালক আমাকে নিয়েছেন, তাই না? অঞ্জনদা সংলাপ-নির্ভর ছবি করতেন, সংলাপের মধ্য দিয়ে গল্পটা বলতেন। তপনবাবুর ছবি খুব লিরিকাল হতো। একটা সুন্দর ফ্লো থাকত ন্যারেটিভে। দুজনেই শিল্পীদের সেরাটা বার করে নিতে পারতেন। এবং সবথেকে বড় কথা, এইসব পরিচালক শিল্পীদের মর্যাদা দিতেন, সম্মান করতে জানতেন। তাঁরা জানতেন কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে। এটাও যে কোনও পরিচালকের একটা বড় গুণ হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: সেই মর্যাদার জায়গাটার অভাব বোধ করেন কি এখন?
দেবিকা: হ্যাঁ। কোথাও যেন একটা অদৃশ্য বিভাজন তৈরি হয়ে গিয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে। কিছু অভিনেতা/অভিনেত্রীকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, এই কাজটা একে দিয়ে হবে না। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পীকেই সব ছবিতে দেখা যাচ্ছে। এবং একটা পর্যায়ের পর দর্শকের বিরক্ত লাগছে সেই একই মুখ, একই ধরনের অভিনয় বারবার দেখতে।
আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
প্রশ্ন: আশি বা নব্বইয়ের দশকের থেকে এখন তো অনেক বেশি ছবি তৈরি হয়। এদিকে আবার প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা দিন-দিন কমছে। এতই যদি ছবি তৈরি হয়, তাহলে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কমছে কেন?
দেবিকা: একটাই কারণ, গল্প। আজকাল ছবিতে গল্প থাকে না। আগে লোকে দলবেঁধে প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখতে যেতেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা গল্প দেখতে পাবেন বলে। এক একটা ছবি পাঁচ-ছ’মাস চলতই। প্রযোজকরা জানতেন, এর মাঝে ছবি তৈরি করে কোনও লাভ নেই, কারণ হলই পাবেন না। তাঁরা সময় নিয়ে এমন গল্প নিয়ে ছবি করতেন, যাতে লোকে সেটা দেখে। আর এখন তো দু’সপ্তাহের বেশি কোনও ছবি চলেই না। পনেরো দিনের মধ্যে টেলিভিশন প্রিমিয়র হয়ে যায়। তাহলে যে ছবিটা একটু অপেক্ষা করলেই টিভিতে দেখতে পাব, সেটা দেখার জন্য আমি পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে, গাড়ির তেল পুড়িয়ে সিনেমা হলে যাব কেন? ছবির রিপিট ভ্যালু কমে গিয়েছে, শেলফ লাইফ কমে গিয়েছে। একটা ছবি একবার দেখার পর দ্বিতীয়বার দেখতে ইচ্ছে করে না। ছবি যদি নাই চলে, তাহলে প্রেক্ষাগৃহ রেখে লাভ কী? এই কারণেই একের পর এক হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: ইদানিং সবাই একই ধরনের ছবি বানাচ্ছেন বলে আপনার মনে হয়?
দেবিকা: না, সেটা একবারও বলছি না। কিছু পরিচালকের ছবি নিশ্চয়ই চলছে এবং প্রযোজক, হলমালিক সেখান থেকে লাভও করছেন। তবে এটাও বোঝা দরকার, শুধু গল্প বলতে পারলেই হবে না। আমি গল্পটা কীভাবে আমার দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করছি, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র দু’-একজন পরিচালকের ছবি চললেই তো হবে না। অনেক বেশি সংখ্যক পরিচালকের ছবি চলতে হবে। ছবি দেখিয়েই তো প্রেক্ষাগৃহগুলো ব্যবসা করবে। হতাশার মতো শোনালেও, বেশিরভাগ পরিচালকেরই এখন গল্প বলার মুনশিয়ানা নেই।
প্রশ্ন: মু্ম্বইতে কাজ করার কোনও অফার পাননি?
দেবিকা: পেয়েছিলাম বেশ কয়েকটা। করিনি।
আরও পড়ুন: ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে আর ভাবছেন না সত্যজিৎ
প্রশ্ন: কেন? মুম্বইতে কাজ করলে তো অনেক বেশি দর্শকের কাছে পোঁছতে পারতেন। তাছাড়া হিন্দি ছবির রোজগারের দিকটাও অস্বীকার করা যায় না…
দেবিকা: মুম্বই থেকে অফারগুলো যখন আমি পাই, তখন এখানেই আমার প্রচুর কাজ। অমলের ছবিতে যখন কাজ করেছি, তখন সকালের ফ্লাইটে গিয়ে সারাদিন কাজ করে আবার রাতে কলকাতায় ফিরে এসেছি। তাছাড়া মুম্বইতে কাজ করতে গেলে পাকাপাকিভাবে ওখানেই থাকতে হত। মাকে এখানে ছেড়ে সেটা আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। আমি চাইওনি।
প্রশ্ন: একটা কথা হামেশাই শোনা যায়, মুম্বই ভীষণই পেশাদার, সেখানে কলকাতা অনেক বেশি ননফর্মাল। এটা কতটা সত্যি?
দেবিকা: একশো ভাগ সত্যি। মুম্বই সত্যিই পেশাদার। ওরা কাজ বোঝে। কাজের বাইরে তুমি কী করলে, তাই নিয়ে কারওর মাথাব্যথা নেই। অন্যদিকে টালিগঞ্জ স্টুডিয়োপাড়া একটা বিরাট পরিবারের মতো ছিল। সবাই সবাইকে চিনত, খোঁজ নিত, সাধ্যমতো একে অপরকে সাহায্য করত। এমন অনেকদিন হয়েছে আমরা দু’-তিনটে ইউনিটের লোকজন একসঙ্গে বসে লাঞ্চ করেছি। বেণুদি (সুপ্রিয়া দেবী) হয়তো একদিন মোচার ঘণ্ট রান্না করে এনেছেন। আমি সেদিন মাছের ঝোল নিয়ে গিয়েছি। আমি ওঁকে বললাম, বেণুদি, আমার রান্না তোমার মতন ভালো হবে না কিন্তু তোমাকে খেয়ে দেখতেই হবে। সম্পর্কগুলোর মধ্যে একটা দাবির জায়গা ছিল। অনেকেই বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসতেন, আমরা ভাগ করে খেতাম। এর মধ্যেই আমরা কাজ করতাম, একের পর এক সফল ছবি তৈরি হতো। দরুণ হৃদ্যতা ছিল সবার মধ্যে। আন্তরিকতা ছিল, বন্ধুত্ব ছিল।
আরও পড়ুন: ‘সুচিত্রা সেন সুন্দরী নয়, ফটোজেনিক ছিল’
প্রশ্ন: এই পরিবেশটা কি এখন মিস করেন?
দেবিকা: ভীষণ। এখন এমন একজনও কেউ নেই যে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে, কি রে খেয়েছিস? কেউ কাউকে মনেই রাখে না। পল্লবী (চট্টোপাধ্যায়) খুব খেয়াল রাখত সবার। কে কেমন আছে ডেকে জিজ্ঞাসা করত। এই মানুষগুলোকেও আর দেখতে পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন: বড়পর্দায় আবারও কাজ করবেন তো?
দেবিকা: ভালো চিত্রনাট্য, ভালো চরিত্র পেলে নিশ্চয়ই করব।
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Swati Chatterjee
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





