মেয়ের মৃত্যুসংবাদ! তবু শট দিয়ে গেল জহর
অভিনেতা জহর রায় (Jahar Roy) এবং পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, দুজনেরই জন্ম ১৯১৯ সালে। দুই কিংবদন্তি ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। একজন পাটনাৃর, অন্যজন ভাগলপুরের বাসিন্দা। পরবর্তী জীবন কাটে কলকাতায়। একসঙ্গে কাজ করেছেন। প্রায় দু’দশক আগে জহর রায়কে নিয়ে পরিচালকের স্মৃতিচারণ। শুনলেন অশোক সেন
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়: আমি জহর রায়কে প্রথম দেখি ১৯৪৫ সালে ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়োতে। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। অর্ধেন্দুবাবু এমন একজন মানুষ যিনি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করে গিয়েছেন। অনেক নতুন শিল্পী তৈরি করেছেন। জহর রায় হচ্ছে তেমনই অর্ধেন্দুবাবুর অন্যতম এক অমর সৃষ্টি। উনিই প্রথম জহরকে সিনেমায় এবং কলকাতার স্টেজে অভিনয় করবার সুযোগ করে দেন।
অর্ধেন্দুবাবু আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুইও যেমন ভাগলপুর থেকে এসেছিস, জহরও তেমনই পাটনা থেকে এসেছে।’ ওখানে ওর একটা টেলরিং শপ ছিল। জহরের বাবাও খুব ভালো অভিনয় করতেন। পাটনায় ওদের একটা নাট্যসংস্থা ছিল। জহর খুব ভালো ক্যারিকেচার করতে পারত। তার মধ্যে বিখ্যাত ছিল চার্লি চ্যাপলিনের ‘গ্রেট ডিক্টেটর’-এর সেই বক্তৃতাটি। অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র, শিশির ভাদুড়ির মতো অভিনেতাদের গলা হুবহু নকল করতে পারত। নরেশবাবু রাশভারী লোক ছিলেন। ওঁর ছবিতে জহর কাজ করেছে। একবার নরেশবাবু জহরকে বললেন, ‘আমার মতো গলা নকল করে বল তো।’ জহর কোনও ভনিতা না করে নরেশবাবুর মতো কণ্ঠস্বর করে কথা বলতেই রাশভারী মানুষটিও না হেসে পারলেন না।
আরও পড়ুন: নতুন লুকে অপরাজিতা, কলকাতায় শুরু শুটিং
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জহরও কমেডিয়ান হিসেবে খুবই নাম করে। শিব্রামের মতো ‘অনুপ্রাশ’ করতে পারত। সত্যজিৎ রায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ শুটিংয়ের অবসরে জহরের বয়স জিজ্ঞাসা করায় ও বলে, ‘মানিকদা, আমি আপনার চেয়ে বয়সে বড়।’ এ কথা শুনে সত্যজিৎ বলেন, ‘জহর, তুমি আমাকে মানিকদা বলো কেন? তোমাকেই তো আমার জহরদা বলা উচিত। কারণ, তুমি আমার থেকে এজে (age) বড়।’ এ কথা শুনে জহরের চটজলদি জবাব, ‘আপনি আমার থেকে এজে ছোট কিন্তু ইমেজে বড়!’
মনে পড়ে একটা সাধারণ প্রায় ফ্লপ হওয়া নাটকে জহর একা অভিনয় করে হিট করিয়ে দিয়েছিল। নাটকটির নাম ‘অন্যান্য’। প্রযোজক শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে ওই নাটকটা জহর ছাড়া স্টেজে করবে না এই সিদ্ধান্তে স্থির ছিলেন। শেষপর্যন্ত জহরকে দিয়েই করালেন। রংমহলে তখন জহরের অভিনয় দেখার জন্য টিকিটের হাহাকার। নাটকে জহর ওর চরিত্রটাকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল তা ভোলার নয়! অসাধারণ ওর ব্যাঙ্গাত্মক অভিনয়!
আরও পড়ুন: সেন্সর বোর্ডের মৌখিক আপত্তি, আটকে গেল ‘কাল্পনিক’
জহর মাঝেমাঝে ডায়লগ চেঞ্জ করত। একবার নতুন ডায়লগ জুড়েছিল: ‘কী বলব ভাই, দোকানে জুতো কিনতে গেছি, জুতোওয়ালা পায়ের মাপ না নিয়ে বগলের মাপ নিচ্ছে। রেগে দোকানদারকে বললাম, বগলের মাপ নিচ্ছ কেন? দোকানদার বললে, রাস্তাঘাটের যা অবস্থা জুতো পায়ে পরতে পারবেন না বগলে করেই নিয়ে যেতে হবে!’
জহর নানারকম চরিত্রে অভিনয় করেছে। আমার বহু ছবিতে কাজ করেছে। তার ভেতর ‘ধন্যি মেয়ে’তে ফুটবল-পাগল জমিদারের চরিত্রটি এবং ‘অগ্নিশ্বর’-এর গুডস ক্লার্কের চরিত্র দু’টি একেবারে আলাদা কিন্তু কী সুন্দর অভিনয় করে দর্শককে আনন্দ দিয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না!
আরও পড়ুন: ‘ময়লা কাপড়টাও বদলে নিতে দিল না বুড়ো’
আমার ‘পিতাপুত্র’ ছবির একটা ঘটনা বলি। ওই ছবিতে ভীতু চাকরের অভিনয় করে খুব হাসিয়েছিল জহর। একদিনের ঘটনা মনে পড়ছে। হিরোর পড়ার ঘরের সেট। হিরো ডাক্তারি পড়ে। সেইজন্য তার ঘরে একটা কঙ্কাল রাখা আছে। সেটাকে চাকরটা খুব ভয় পায়। সকালে জহর এল, পার্ট বুঝে অপূর্ব শট দিল। একটু পরে কে যেন এসে বলল, ‘জহরদা আপনার ফোন এসেছে।’ জহর অফিসে গিয়ে ফোনে কথা বলে আবার সেটে এসে শট দিতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পর লাঞ্চ ব্রেক হলো। জহর বললে, ‘আমি কিছু খাবো না, শরীরটা ভালো নেই।’
আমরা ক্যান্টিন থেকে খেয়ে বেরোচ্ছি, এমন সময় মেকআপ ম্যান শৈলেনদা খুবন নীচু স্বরে আমাকে বলল, ‘জহরদা মেকআপ রুমে বসে কাঁদছে।’
আরও পড়ুন: ‘এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে’
সেকি! এ কথা শুনেই আমি মেকআপ রুমে গেলাম। দেখি জহর টেবিলে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে রে?’ জহর বলল, ‘একটু আগে টেলিফোনে খবর পেলাম, পাটনায় বাবার কাছে আমার বোবা মেয়েটা থাকত, মারা গিয়েছে। আমাকে খুব ভালোবাসত রে।’ বলে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল।
এ কথা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তোর মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে তুই শুটিং করে গেলি?’
‘কী করব ভাই,’ জহর বলল, ‘তোর ক্ষতি হবে।’
আরও পড়ুন: ‘টাকা চেয়ে বসলেন বাবা’
কিচ্ছু ক্ষতি হবে না। ছবির প্রযোজক অমর নাম বললেন, ‘ঢুলুদা (আমার ডাক নাম) এক্ষুণি প্যাকআপ করে দিন।’
জহর আমার হাত ধরে বললে, ‘না-না প্যাকআপ করিসনি। বরং শুটিং করলে খানিকটা দুঃখ ভুলে থাকতে পারব।’
সত্যি, সেদিন সন্ধে সাতটা পর্যন্ত এমন সব শট দিয়েছে জহর, হাজার-হাজার দর্শক সেই সব দৃশ্য দেখে হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে! তারা তো জানে না এই শটগুলোর হাসির কানায়- কানায় লুকিয়ে রয়েছে নীরব চোখের জল।
আরও পড়ুন: সেরা ছবি ‘সীমাবদ্ধ’
জহর খুব পড়াশুনো করত। ওই মির্জাপুর স্ট্রিটের মেস অমিয় নিবাসের ঘরে একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিল ওর। আমরা দু’জনে একসঙ্গে সিনেমাজীবন শুরু করেছিলাম। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ১৯৪৫-৪৬ সালে আমি আর জহর হন্যে হয়ে একের পর এক স্টুডিয়োতে কাজের জন্য ঘুরেছি। আমি যখন পরিচালক হলাম, ওকে কাস্ট করে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘তোকে কত দিতে হবে?’
প্রতিবারই জহর বলত, ‘তুই যা ভালো বুঝবি, তাই দিবি।’
তাই দিতাম। খুশি মনে গ্রহণ করত।
আমার চলচ্চিত্রজীবনে জহর রায়ের মতো মানুষ দেখিনি!
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





