না হতে পারা হিন্দি উত্তম রত্ন
সোমনাথ লাহা: এ বছর ৩ সেপ্টেম্বর শতবর্ষে পদার্পণ করেছেন উত্তমকুমার (Uttam Kumar)। একশো বছরে পদার্পণ করেও তাঁর জনপ্রিয়তায় যে এতটুকু ভাঁটা পড়েনি তার প্রমাণ সিনেপ্রেমী তথা আমজনতার তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বাস। জন্ম শতবর্ষ সূচনায় উত্তমকুমারের এমন কিছু হিন্দি ছবির দিকে তাকানো যাক, যেগুলো দিনের আলো দেখলে হয়তো মুম্বইতেও নিজের অনন্য প্রতিভার ছাপ ছেড়ে আসতে পারতেন বাঙালির মহানায়ক।
উত্তমকুমার অভিনীত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ছবি আলো সরকার পরিচালিত ‘ছোটি সি মুলাকাত’। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় সেই ছবি। অনেকেই হয়তো জানেন না যে তারও বহু আগেই হিন্দি ছবির অঙ্গনে নিজের ভাগ্য অন্বেষণের চেষ্টা করেছিলেন উত্তমকুমার।
আরও পড়ুন: ‘এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে’
১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত সুচিত্রা সেন-উত্তমকুমার জুটির অন্যতম সুপারহিট ছবি ‘ইন্দ্রাণী’র রিমেক হিন্দিতে করতে চেয়েছিলেন উত্তম। হিন্দি ছবির নাম রাখা হয় ‘ঝঙ্কার’ (Jhankar)। পরিচালক কে ছিলেন তা জানা না গেলেও ছবিতে উত্তমকুমারের বিপরীতে ছিলেন আশা পারেখ (Asha Parekh)। বেশ কিছুদিন শুটিংও হয়। ছবিতে অনান্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজেন্দ্রনাথ, গিরিধারি ও তাবাসুমের মতো শিল্পীরা। ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির একটা দৃশ্যে উত্তম-সুচিত্রা তাঁদের প্রেমপর্বে একটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসেছিলেন। সেই আদলেই হিন্দি ছবিটিতে একটা দৃশ্য তোলা হয়, যেখানে একটা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার সময় পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন উত্তমকুমার ও আশা পারেখ। এই ছবি দিয়ে হিন্দি সিনেমার দুনিয়ায় পা রাখতে চেয়েছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ছবিটির প্রযোজনায় সমস্যা দেখা দেয়। কিছুদিন কাজের পর মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায় শুটিং।
সৃজনশীলতার দিক থেকে ‘ছোটি সি মুলাকাত’-এর থেকে অনেকাংশে এগিয়ে থাকা ছবি ছিল ‘ঝঙ্কার’। ছবির বাজেটও অনেক কম ছিল। হয়তো এ ছবি মুক্তি পেলে অনেক আগেই হিটের মুখ দেখতেন উত্তমকুমার। সে ক্ষেত্রে তাঁর বম্বের যাত্রাপথ আরও সুদূরপ্রসারী হতো।
আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
এর পরবর্তী সময়ে আরেকটি হিন্দি ছবির নাম ঘোষণা করা হয়। সেটাও উত্তমকুমারের হিন্দি ছবির কেরিয়ারের একটি অন্যতম মাইলস্টোন হতে পারত। প্রখ্যাত গায়ক-সঙ্গীত পরিচালক তথা প্রযোজক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রযোজনা সংস্থা গীতাঞ্জলি পিকচার্সের ব্যানারে ‘শর্মিলা’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করবেন বলে মনস্থির করেন। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল উত্তমকুমারের। ছবিতে তাঁর বিপরীতে নায়িকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল ওয়াহিদা রহমানের নাম। বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়ের পত্র-পত্রিকায়। আসানসোলে শুটিং শুরু হওয়ার কথাও ছিল। কোনও এক অজানা কারণে শুটিং শুরু হয়নি। এমনকী ছবিটা থেকে সরে আসেন উত্তমকুমার। ফলস্বরূপ ছবিটা বন্ধ হয়ে যায়। শোনা যায় এর ফলে উত্তমকুমারের সঙ্গে হেমন্তের পারস্পরিক সম্পর্কেও চিড় ধরে। তবে অনেক সিনেবোদ্ধাদের মতে এ ছবি তৈরি হলে হিন্দি সিনেমার আঙিনায় বেশ ভালো জায়গা অচিরেই পেতে পারতেন মহানায়ক।
১৯৭৭ সালে গুলজ়ারের পরিচালনায় মুক্তি পায় উত্তমকুমার অভিনীত ছবি ‘কিতাব’ (Kitaab)। সমরেশ বসুর লেখা উপন্যাস ‘পথিক’ অবলম্বনে এই ছবিটি তৈরি করেছিলেন গুলজ়ার। কাজের সূত্রে এবং পূর্বপরিচিত হওয়ার কারণে গুলজ়ারের সঙ্গে সখ্য বাড়ে উত্তমের। সেই সময় উত্তমকুমারকে নিয়ে আরেকটি ছবির পরিকল্পনা করেছিলেন গুলজ়ার। ছবির নাম ‘হামেশা’। উত্তমকুমারের বিপরীতে অভিনয় করার কথা ছিল হেমা মালিনীর। কিন্তু উত্তমের প্রয়াণে সে ছবি আর তৈরি হয়নি। পরবর্তীকালে ‘হামেশা’ ছবির নাম ও কাস্টিং দুটিই পরিবর্তন করে ‘ইজাজ়ত’ নামের ছবি তৈরি করেন গুলজ়ার। সেই ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নাসিরউদ্দিন শাহ ও রেখা।
আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
বাসু ভট্টাচার্য (Basu Bhattacharya) পরিচালিত ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন উত্তমকুমার। ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর (Sharmila Tagore) ও সারিকা। বেশ কিছুদিন শুটিংও হয়। সেই সময়ের বিভিন্ন বিনোদন পত্রিকায় উত্তমকুমার ও সারিকার শুটিং স্টিলসও প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরেই শুরু হয় সমস্যা। শোনা যায়, একদিন ছবির চিত্রনাট্য পরিচালকের কাছে দেখতে চান উত্তমকুমার। বিষয়টি তাঁর আত্মসম্মানে লাগায় পরিচালক জানান তিনি তাঁর ছবির চিত্রনাট্য কাউকে দেখান না। অসম্মানিত উত্তমও সটান জানিয়ে দেন চিত্রনাট্য না দেখে তিনি কাজ করতে পারবেন না। পরবর্তীকালে সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার।
সত্তরের দশকের শেষার্ধে ‘তিন বাঁদর’ ছবিটি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। ছবিতে উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করার কথা ছিল জ়িনত অমানের। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁদের নাম ঘোষণাও করা হয়। এছাড়াও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল অমজাদ খানের। উত্তমকুমারের অকাল প্রয়াণে বন্ধ হয়ে যায় ছবির কাজ।
আরও পড়ুন: ‘পচা দুর্গন্ধ ছড়ালে, প্রতিবেশীরাই এসে দাহ করবে’
দুলাল গুহ পরিচালিত ‘দাবেদার’ ছবির গানের রেকর্ডের অ্যালবাম কভারে বীণা হাতে নিয়ে উত্তমকুমারের হাসিমুখ ধরা পড়ে। ছবিতে উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন ধর্মেন্দ্র ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। প্রযোজনা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে বহু বিলম্বের পর ছবিটা যখন ১৯৮৭ সালে মুক্তি পায়, তখন সেটা নাম বদলে হলে যায় ‘মেরা ধরম মেরা করম’ (Mera Dharam Mera Karam)। চিত্রনাট্যেও অনেক পরিবর্তন করা হয়। প্রায় ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানির মতো ধর্মেন্দ্রর মামার ভূমিকায় উত্তমকুমার অভিনীত দেবীপ্রসাদ চরিত্রটা এসেই চলে যায়। এমনকী এক অন্য অভিনেতাকে দিয়ে উত্তমকুমারের সংলাপও ডাবিং করানো হয়। বাঙালি সিনেপ্রেমীদের কাছে যা ছিল চরম অতৃপ্তির সামিল।
এ তো গেল হিন্দি ছবির কথা। বহু বাংলা ছবিতেও উত্তমকুমারের অভিনয় করার কথা ছিল। সত্তরের দশকের শেষদিকে অগ্রগামীর জয়ন্ত ভট্টাচার্যের পরিচালনায় বুদ্ধদেব গুহর ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘কোয়েলের কাছে’, ‘নগ্ন নির্জন’ ও ‘চবুতরা’ উপন্যাসগুলো নিয়ে ছবি করার কথা ভেবেছিলেন প্রযোজক অজয় বসু। এর মধ্যে উত্তমকুমার নিজে ‘নগ্ন নির্জন’ ও ‘চবুতরা’ পড়েছিলেন। সেই সময় এই ছবিগুলির সহ-প্রযোজক হতে চেয়েছিলেন চণ্ডীমাতা ফিল্মসের সত্যনারায়ণ খাঁ। যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত উত্তমকুমার অভিনীত এই চারটি উপন্যাস থেকে ছবি তৈরি হওয়ার কথা ছিল। শুধু তাই নয়, ‘চবুতরা’ ছবিতে উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রথমবার বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হয়েছিলেন রেখা (Rekha)। অসীমবাবু ও পরিচালক আলো সরকার এই বিষয়টি নিয়ে কথাও বলেছিলেন শক্তি সামন্তের সঙ্গে। ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিল অমজাদ খানেরও। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই ছবিগুলির একটিও তৈরি হয়নি।
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





