Interviews

‘পচা দুর্গন্ধ ছড়ালে, প্রতিবেশীরাই এসে দাহ করবে’

বাংলার চলচ্চিত্র মহলে একটা সময় হরিদাস ভট্টাচার্য (Haridas Bhattacharya) ছিলেন খুবই পরিচিত। প্রয়াত অভিনেত্রী কাননদেবীর স্বামী পরিচয়েই নন, তিনি নাম করেছিলেন সফল পরিচালক হিসাবেও। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিপ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যWBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ

একখানা দশ ফুট বাই বারো ফুট ঘরে কোনওরকমে দিন কাটাচ্ছেন হরিদাস ভট্টাচার্য। ‘দর্পচূর্ণ’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’র মতো বেশ কয়েকটি ছবির সফল পরিচালক তিনি। হরিদাসবাবু অভিনেত্রী কাননদেবীর স্বামী এবং শ্রীমতী পিকচার্সের কর্ণধার। একটা সময়ে রিজেন্ট পার্কে প্রাসাদোপম বাড়িতে যিনি থাকতেন, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রোডে একটা বাড়ির তিনতলার এক কামরার ঘরে এখন তিনি একা থাকেন। ঘরের একদিকে একটা ছোট খাট, একটা টেবিল। সেই টেবিলের ওপর ডাঁই করা বইপত্র, খবরের কাগজ, কিছু ফাইল এবং লেখার জন্য সাদা কয়েক দিস্তা কাগজ ও পেন। টেবিলের নীচে এক পাশে রান্নার বাসনপত্র, একটা হিটার, কিছু তরিতরকারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঢাকা দেওয়া এক বালতি জল। একটা হাফ সাইজ়ের কাঠের আলমারি তার ওপরে ছোট একটা টিভি। ঘরের মধ্যে আড়াআড়ি করে বাঁধা দড়ির ওপর ঝুলছে জামাকাপড়। তারই মধ্যে হরিদাসবাবু আমাদের বসার জন্য একটু জায়গা করে দিলেন।

একসময় রাজ্যপালের এ-ডি-কং (Aide-de-Camp) ছিলেন। সুদর্শন ও সুপুরুষ। মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর। কাননদেবী দেখামাত্রই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। এখন বয়স প্রায় ছিয়াশি। তবুও ছিপছিপে শরীর। সাদা ধবধবে চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি।

আরও পড়ুন: ওয়ান-টেক ছবি করছেন অংশুমান প্রত্যুষ

দরজা খুলে দিয়েই হরিদাসবাবু বললেন, “তিনটে শর্তে আমার এখানে বসতে পারেন। এক, আমার সম্পর্কে কিছু লিখতে পারবেন না। দুই, উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে কিছু বলব না। তিন, কানন সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।”

তাঁর শর্ত মেনেই ঘরের মধ্যে বসলাম। ঘরের চারদিকে চোখ বোলাতেই উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কী দেখছেন?”

ভারতের প্রথম বাঙালি এ-ডি-কং কেমন আছেন দেখছি।

আরও পড়ুন: ট্রিলজির শিরোপা দিতে এত কার্পণ্য কেন?

শুষ্ক হেসে, চোখ থেকে চশমা খুলে ডানহাতে নিয়ে, ঘোলাটে দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন, “দ্যাট ইজ় আ পাস্ট হিস্টরি। আজকে আমার এই ঘর দেখে, আমাকে দেখে, কেউ বিশ্বাস করবে না, এই আমি হরিদাস ভট্টাচার্য এক সময়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, বিধানচন্দ্র রায়, কৈলাসনাথ কাটজুদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছি, ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি।”

সে সব চল্লিশ দশকের কথা। একদিকে ইংরেজ, অন্যদিকে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ। বর্মা (বর্তমানে মায়ানমার) থেকে সদ্য পাশ করা এক তরুণ ভারতবর্ষে চলে এলেন। বলা ভালো, চলে আসতে বাধ্য হলেন। তাঁর চোখে স্বপ্ন। বর্মায় থাকাকলীনই ইংরেজদের কালচার রপ্ত করে ফেলেছিলেন। সেটাই কাজে লেগে গেল। বর্মাতে প্রিভেনটিভ অফিসারের পদে যোগ দেন। সেটা ছিল মে মাস। পরের এপ্রিল মাসে ভারতে এসে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভিতে যোগ দিলেন।

আরও পড়ুন: উত্তমকুমারের পরিচালনায় প্রসেনজিৎ, হয়েছিল ফটোশুটও

“কাদের সঙ্গে আমি মিশিনি! কাদের সঙ্গে কাজ করিনি! সেই সব দিনের কথা আজকে এই ঘরে বসে ভাবলে মনে হয়, সত্যিই কি আমি সেই হরিদাস ভট্টাচার্য! লর্ড মাউন্টব্যাটেন, সর্দার বল্লভভাই পটেল, নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, কাদের সান্নিধ্য না পেয়েছি। ওঁরা ঘরে বসে মিটিং করছেন আর আমি তৈরি আছি ফাইল নিয়ে। যখন যে ফাইলটা লাগবে, সেটা এগিয়ে দেওয়ার জন্য। ওই ঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসতাম, তখন অন্যান্য লোকজন, চাপরাশিরা এগিয়ে আসত আমার কী প্রয়োজন তা জানবার জন্য। অথচ আজ একগ্লাস জল এগিয়ে দেওয়ার জন্যও কেউ নেই।”

সেই জন্য আপনার কোনও অনুশোচনা হয় না? কারওর ওপর অভিমান?

“অভিমান? কার ওপর অভিমান করব? যার ওপর অভিমান করতে পারতাম, সে তো আমাকে ছেড়ে কবেই চলে গিয়েছে।”

প্রয়াত কাননদেবীর কথা বলছেন। সব থেকেও আজ আপনি নিঃস্ব। কিন্তু একটা সময় তো সবই ছিল। সরকারি চাকরির পরেও তো আপনার আলাদা একটা পরিচিতি, বৈভব ছিল। শ্রীমতী পিকচার্সের কর্ণধার ছিলেন আপনি। ওই ব্যানারে তো দশ-দশটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। সেগুলো কী হলো?

আরও পড়ুন: অতি উত্তম! এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি

“সবই হয়েছিল ওর জন্য। মানে কাননের জন্য। কাননকে যখন আমি বিয়ে করি, তখন ওর দেড় লাখ টাকার মতো দেনা ছিল। কিন্তু সেটা জেনেই আমি ওকে বিয়ে করেছিলাম। সিনেমার প্রতি একটা টান আমার বরাবরই ছিল। কাননকে বিয়ে করার পর সেই টানটা যেন আরও বেড়ে গেল। ওর সঙ্গে থেকে থেকেই চলচ্চিত্র বিষয়ে অনেককিছু জানতে পারলাম। বরং বলতে পারেন ওই বিষয়ে নেশা ধরে গেল। একে-একে এই শিল্পের অনেক মান্যগণ্য মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। তার আগেই অবশ্য আমি নেভির চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। বার্ড কোম্পানির হিলজার্সে চাকরি করছি। হঠাৎ কোম্পানি আমাকে রেঙ্গুনে ট্রান্সফার করে দিল। তখনই মাথায় এল, একটা প্রোডাকশন কোম্পানি খুললে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। বার্ডের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে প্রোডাকশন কোম্পানি খুলে ফেললাম।”

তারপর?

“আমার তখন একটাই ধ্যানজ্ঞান। আমাদের ব্যানারে কোন ধরনের গল্প নিয়ে ছবি করব? শুরু করলাম ছবি দেখা এবং পড়াশোনা। ইংরেজি ভাষাটা বলতে পারেন আমার রক্তে। তবে বাংলাও জানতাম। কিন্তু বাংলা ছবি প্রোডিউস করার তাগিদে তখন বাংলা সাহিত্যকে প্রায় গুলে খেলাম। এ ক্ষেত্রে আমার একটা সুবিধা ছিল। আমি চিরদিনই পড়তে ভালোবাসি। ঘণ্টার পর ঘন্টা বই নিয়ে বসে থাকতে আমার কোনওদিনই অসুবিধা হতো না। বাড়িতে হয়তো ঝগড়া হয়েছে, আমি বই নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বসে পড়েছি। সে যাক, আমাদের প্রোডাকশনের, আমার চিত্রনাট্যগুলো বাংলায় তর্জমা করে দিত আমার বিশেষ বন্ধু সজনীকান্ত দাশ।

Haridas Bhattacharya

যুবা বয়সে হরিদাস

প্রযোজনা ছাড়া আপনি তো অনেক ছবি পরিচালনাও করেছিলেন? ছবির নামগুলো কি মনে আছে।

“কিছু মনে আছে, তবে স্পষ্ট নয়। ‘দর্পচূর্ণ’, ‘নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘আশা’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’। তবে ওই সময়ে সব্যসাচী গোষ্ঠী নাম নিয়ে কয়েকজন আমাদের শ্রীমতী পিকচার্সের ছবি পরিচালনা করতেন। তাঁদের মধ্যে অজয় কর, তরুণ মজুমদারেরা ছিলেন। মনে হয়, এই ছবিগুলির মধ্যে দু’-একটা বোধহয় ওঁরা করেছিলেন। সে সব তো একটা যুগ, একটা সময়ের কথা। সে সব দিনের কথা আজকে শুধুই ধূসর স্মৃতিমাত্র। সেই স্মৃতিকে আর বহন করে বেঁচে থাকতে চাই না। কেউ এসে সেই স্মৃতি উসকে দিয়ে যাক, সেটাও চাই না। তাই আপনাকে বলেছিলাম, এই সব বিষয় নিয়ে কোনও কথা বলব না।”

আরও পড়ুন: আর্ট ফিল্ম মানে শুধুই যৌনতার ছড়াছড়ি, ক্ষুব্ধ ঋত্বিক

আমিও চাই না। আমি শুধু চাই, আপনার বর্তমান সময়ের কথা শুনতে। এখন আপনার সময় কাটে কীভাবে?

“ওই যে বললাম, বই পড়া আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। বই নিয়েই সময় কেটে যায়। তাছাড়া আমি একটা চিত্রনাট্য লেখার কাজে হাত দিয়েছি। বাংলা ছবির জন্য নয়। ইংরেজি ভাষায়। গল্পের পটভূমি পরিবেশের ওপর। লেখা এবং পড়া ছাড়াও ধ্যান করে আমি অনেকটা সময় ব্যয় করি। আমার মনে হয়, মানসিক শান্তি বজায় রাখতে হলে মেডিটেশন ইজ় দ্য বেস্ট ওয়ে।”

পড়াশোনা তো করছেন, ছবি দেখা কি ছেড়ে দিয়েছেন?

“দেখি। ওই টিভিতে যা দেখায় তাই দেখি। আর খবরের কাগজে ছবির বিষয়ে যা বেরোয়, তাই পড়ি।”

হলে গিয়ে ছবি দেখেন না?

“প্রায় পনেরো বছর হয়ে গেল হলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমার বাড়ির কাছে তো চার-পাঁচটা সিনেমা হল। বিশ্বাস করুন, তা সত্ত্বেও সেখানে গিয়ে আমার ছবি দেখতে ভালো লাগে না।”

আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্কটে বাংলা ছবি, উদ্বিগ্ন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা

তা হলে এখনকার সিনেমা সম্পর্কে সে রকম খোঁজখবর রাখেন না?

“ওই কাগজ আর টিভির মাধ্যমে যা জানতে পারি, তাই জানি। এই যেমন যিশু সেনগুপ্ত অনেকগুলো ছবিতে কাজ করছে। ওর ‘মহাপ্রভু’ সিরিয়ালটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। শর্মিলার মেয়ে সোহা আলি খান একটা বাংলা ছবিতে কাজ করে গেল। টিভিতে যখন ছবিটা দেখাবে তখন বুঝতে পারব ও কেমন কাজ করল।”

হিন্দি ছবি দেখেন?

“না। এখনকার হিন্দি ছবি দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না। মারামারি ছাড়া আর কী আছে হিন্দি ছবিতে? ইনটেলেক্ট বলে কোনও পদার্থই নেই।”

একটা সময় তো অনেক মানুষজন আপনাদের চারপাশে ভিড় করে থাকত। এখন তারা কোথায়। আপনার ছেলে। কেউ কি খোঁজ করেন না?

“ছেলে? ও এখন দেরাদুনে আছে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে আছে।”

আরও পড়ুন: আরতির থেকে বিদায় নিতে এলেন সৌমিত্র

আর অন্য কেউ?

“সেরকম কেউ নেই। একমাত্র ডঃ জ্যোতিপ্রকাশ গুহ আসেন। তিনি কাননের ওপর একটা ওয়েবসাইট খুলেছেন। ওর সঙ্গেই যা কথা বলি। এ ছাড়া এই বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে কেই বা আসবে! কেনই বা আসবে! আমার তো এখন কাউকে কিছু দেওয়ার নেই। আর কারওর সঙ্গে যদি নিজে থেকে যোগাযোগ করি, তবে সে ভাববে কিছু সাহায্য চাইছি। হরিদাস ভট্টাচার্য তো হাত পাততে শেখেনি।”

কিন্তু এতগুলো ছবির প্রযোজক হয়েও আপনার সেই সব ছবিগুলোর স্বত্ব কোথায় গেল? বা আপনার রিজেন্ট পার্কের বাড়ি?

“ও সব নিয়ে কোনও প্রশ্ন করবেন না। আমি কিছু জানি না।”

একাকিত্ব তো আপনাকে গ্রাস করে ফেলছে।

“যদি তাই ভাবেন, তবে তাই। কিন্তু আমি তা মনে করি না। বই এবং লেখালেখিই আমার একাকিত্ব ঘুচিয়ে দেয়। একটা বই লিখলাম, ‘দ্য মাইন্ড মিনডার্স’। কোনও টাকা পেলাম না। যাঁরা পড়েছেন তাঁরা অবশ্য প্রশংসা করেছেন। আসলে একটা বিদ্যা আমি শিখিনি। হাউ টু সেল মাইসেলফ। নিজেকে বিক্রি করার কায়দাটা আপনাকে শিখতে হবে। নয়ত এ যুগে আপনি অচল।”

আরও পড়ুন: প্রথমবার হিন্দি ছবি করছেন সত্যজিৎ রায়, থাকছেন সঞ্জীবকুমার

কাননদেবী সম্পর্কে আপনি তো কিছুই বলবেন না বলেছেন।

“একটা কথাই বলতে পারি, আর একজন অভিনেত্রী দেখান তো যে কাননের মতো সুন্দরী, কাননের মতো ভালো অভিনয় করতে পারে এবং কাননের মতো অসাধারণ গানও গাইতে পারে। সব দিক থেকেই সে ছিল একজন কমপ্লিট আর্টিস্ট।”

আপনার বয়স হয়েছে। মানুষের অসুখ-বিসুখ বলেও তো একটা কথা আছে।

“এখন আর অসুখ-বিসুখ নিয়ে চিন্তা করি না। জন্মানোর সময়ই মানুষ মৃত্যুটাকে সঙ্গে নিয়ে জন্মায়। আমি জানি, একদিন আমাকে মরতেই হবে। তখন আমার পাশে কেউ থাকবে না। আমার মরদেহটা এ ঘরেই পড়ে থাকবে। যখন পচা দুর্গন্ধ ছড়াবে, তখন প্রতিবেশীরাই এসে নিয়ে যাবে, দাহ করবে। এবং সেটাও তাদেরই প্রয়োজনে। আমার নয়।”

প্রথম প্রকাশ: আনন্দলোক, আগস্ট ২০০৪


Edited and Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *