Interviews

‘কন্যাদায়গ্রস্ত এক বয়স্ক ভদ্রলোক সাহায্য চাইতে এলেন’

অতীত যুগের কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক নির্মল ধর। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিনতা রায় (Binota Roy)। ‘উদয়ের পথে’, ‘অভিযাত্রী’, ‘জতুগ্রহ’-এর মতো ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বিনতা। ১৯৭৮ সালে তিনি প্রয়াত হন। WBFJA-এর পাতার রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ 

নির্মল ধর: যখন প্রথম ছবি করতে আসেন তখন পারিবারিক ও সামাজিক দিক থেকে কী ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?

বিনতা: প্রথম যখন এই লাইনে আসি, যতদূর মনে পড়ে সেটা ১৯৪২ সাল। শ্রদ্ধেয় বিমল রায় তখন ‘উদয়ের পথে’র জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন। সেই সময় আমি, সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায় ও আরও কয়েকজন মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেছিলাম। বিমলবাবু আর নীতিন বসু সেই অভিনয় দেখে ‘উদয়ের পথে’র জন্য আমাকেই নির্বাচন করলেন। সিনেমা থেকে অফার এসেছে শুনেই আমার মন যতটা আনন্দে ও কৌতূহলে ভরে উঠেছিল, বাড়ির লোক ও আত্মীয়স্বজন ঠিক তার দ্বিগুণ বেঁকে বসলেন। তার আগে আমি রেডিয়োতে গান-টান গেয়েছিলাম, স্কুলে কয়েকটা ছোটখাটো অভিনয়ও করেছি। ছবিতে কাজ করার ব্যাপারে যে তাঁদের খুব একটা মত ছিল তা নয়। তাই সিনেমার কথা শুনে তাঁরা কিছুতেই রাজি হলেন না। আমার সমস্ত আত্মীয়স্বজন মিলে মা, বাবা, আমাকে বোঝাতে লাগল। কিন্তু কোনও ফল হল না। বাবার উৎসাহই আমাকে অনেকখানি প্রেরণা জুগিয়েছিল। তখন আমার বয়স আর কত হবে, বছর ১৫। বাবাই সঙ্গে করে স্টুডিয়োয় নিয়ে যেতেন, আবার নিয়ে আসতেন। কারওর এ ব্যাপারে মত ছিল না বলে আমি যেন সকলের মধ্যে থেকেও একঘরে হয়ে গিয়েছিলাম। একমাত্র বাবা ছাড়া কেউই কথা বলত না, খুবই খারাপ লাগত। নিজের কেমন যেন জেদ আসত মনে। আর তাই ছবিটা যখন মুক্তি পেল, হিট হল, দর্শকের কাছ থেকে সুনাম পেলাম, তখন আস্তে-আস্তে বাড়ির সেই অসহ্য আবহাওয়াটাও সরে যেতে লাগল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

প্রশ্ন: তখনকার পরিচালকদের কাছ থেকে অভিনয় করার ব্যাপারে কী ধরনের সহযোগিতা পেতেন?

বিনতা: প্রথমেই আমি বিমলবাবুর ছবিতে অভিনয় করি। একে খুব ছোট, তায় একেবারে নতুন, তাই প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমি তাঁর কাছ থেকে খুবই সহযোগিতা পেয়েছি। প্রথম ছবিতেই যে আমার সাফল্য এসেছে, তার মূলে বিমলবাবুর দানই বেশি। আমি শুধুমাত্র তাঁর আজ্ঞাবহ ছিলাম। তারপর নীতিনবাবু, কচিদা (সুবোধ মিত্র), চন্দ্রদার (হেমচন্দ্র চন্দ্র) সংস্পর্শে এসে কিছু ছবি করেছি। ততদিনে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কিছু সঞ্চয় হয়েছে। আর তাঁদের কাছে আমার অভিনয়ের পাঠ নিতে গিয়ে এমনসব অভিজ্ঞতা হয়েছে যা আমায় পরবর্তী কালে অনেক সাহায্য করেছে।

আরও পড়ুন: সেন্সর বোর্ডের মৌখিক আপত্তি, আটকে গেল ‘কাল্পনিক’

প্রশ্ন: তখন তো চলচ্চিত্র আঙ্গিকের দিক থেকে আজকের মতো উন্নত হয়নি। অভিনয় করতে গিয়ে আপনার এ ব্যাপারে কোনও অসুবিধে হত কি? হলে কীরকম হত, যদি একটু বলেন।

বিনতা: ছবির টেকনিক্যাল দিকের তো আজ আশ্চর্যজনক উন্নতি হয়েছে। সে সময় ঘণ্টা তিনেক ধরে মেকআপ করতে হত, তারপর একটা শট নিয়ে পরবর্তী শটের জন্য প্রায় ঘণ্টাখানেক বসে থাকতে হত। খুব বিরক্ত লাগত। আমি আবার খুব একটা মিশুকে ছিলাম না। চুপচাপ সেটের এককোণে বসে থাকতাম। একদিন তাই দেখে বিমলদা বললেন, ‘ওখানে অমন করে চুপচাপ বসে আছেন? একটু রিল্যাক্স করুন। আপনারই তো খারাপ লাগবে।’ তা লাগত বইকি! তবুও কেন জানি না আমি নিজেকে ঠিক আর পাঁচজনের মতো করতে পারতাম না। তা যাইহোক, অন্য কথায় চলে আসছি…আপনার হয়তো খারাপ লাগছে।

প্রশ্ন: না-না, পুরনো কথা শুনতে আমার ভালোই লাগে। আপনি বলুন

বিনতা: তখন সাউন্ড এত সুক্ষ্ম ছিল না। ক্যামেরার এত কারিকুরি তখনও জানা হয়নি আমাদের দেশে। ধরুন, যে-কথাটা একটু আস্তে বলা প্রয়োজন, সাউন্ডে তা উঠবে না বলে বেশ জোরে উচ্চারণ করতে হত। ফলে হত কী, অভিনয়ের যে মোশন বা মোটিভ, সেটা বাধা পেত। এখনও মাঝে-মাঝে অভিনয় করছি, দেখছি তো কারিগরি বিভাগের উন্নতি শিল্পীদের অভিনয়ে বাস্তবতার পরশ আনতে অনেকবেশি সাহায্য করছে।

আরও পড়ুন: ”বাঞ্ছারামের বাগান’ না করা মস্তবড় ভুল ছিল’

প্রশ্ন: আপনার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে কোন ছবির কোন চরিত্রটি আপনাকে বিশেষভাবে অভিভূত করেছে এবং কেন?

বিনতা: ‘উদয়ের পথে’ গোপা চরিত্র করতে গিয়ে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর যে উন্মাদনা, তা ছিল বলেই হয়তো কেমন যেন আত্মতুষ্টির ভাব এসে গিয়েছিল। তবে গোপা করে যে সম্মান আমি পেয়েছিলাম, তা অন্য কোনও চরিত্রে পাইনি। গোপার চরিত্রটি ছিল এক দয়াবতী, দানশীলা মহিলার। ওই ছবি দেখে কত লোক আমাকে চিঠি দিয়েছেন, প্রশংসা করেছেন। অনেকে আমার আদর্শে তাঁদের জীবন গড়ার প্রতিজ্ঞা করে চিঠি দিয়েছেন। একদিন হয়েছে কী, কন্যাদায়গ্রস্ত এক বয়স্ক ভদ্রলোক আমার কাছে সাহায্য চাইতে এলেন। উনি কারওর কাছে শুনেছেন গোপাদেবী খুব দানশীলা। তাঁকে আমি তারপর বুঝিয়ে বললাম, ও আমি নই, অভিনয় করেছি। তা যাইহোক, ভদ্রলোককে যথাসাধ্য সেদিন দিয়েওছিলাম। সেদিন কী যে আনন্দ হয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারব না! তবে যে চরিত্র করে আমি আন্তরিকভাবে অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছি, তা হল হেমেন গুপ্তের ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে। চরিত্রটা ছিল নায়িকা জয়ার। অভিনয় করতে গিয়ে সহযোগী হিসাবে অবশ্য প্রখ্যাত নট নির্মলেন্দু লাহিড়িকে পেয়েছিলাম। হয়তো সে কারণেই অভিনয়ের মধ্যে নিজেকে একবারে একাত্ম করে ফেলতে পেরেছিলাম। তাছাড়া ‘কাঁচা-মিঠে’, ‘টাকা আনা পাই’ ছবিতেও অভিনয় করে ভালো লেগেছিল।

আরও পড়ুন: ‘এত নিষ্ঠুর, কৃপণ হবে ভাবিনি’

প্রশ্ন: চলচ্চিত্রকে আপনি কী হিসেবে মানতে প্রস্তুত, প্রমোদমাধ্যম না শিল্পমাধ্যম?

বিনতা: চলচ্চিত্রকে প্রমোদ উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা মোটেই যুক্তি অসঙ্গত নয়। প্রযোজক যে বিপুল পরিমাণ টাকা একটা ছবিতে ইনভেস্ট করেন, তা আবার তাঁর হাতেই ফিরে আসুক, এ চিন্তা থাকা তাঁর স্বাভাবিক। কাজেই দর্শক টানবার জন্য তাঁকে এন্টারটেন করার দিকটায় নজর দিতেই হবে। আবার এটাও ঠিক, মনোরঞ্জন করতে গিয়ে ছবিতে এমন কিছুর অনুপ্রবেশ যেন না ঘটে, যা সাধারণের নৈতিক চিন্তা ও চরিত্রের অবনতির কারণ হয়। আমাদের দেশে কিন্তু ও-ধরনের ছবিই সংখ্যায় বেশি। আমাদের সময়ে ছবির আর্টিস্টিক ব্যাপার নিয়ে এত মাথা ঘামানো হত না। তবে আর্ট ফিল্ম করতে গিয়ে যদি তা দর্শকের ভালোই না লাগে, সে ছবির মূল্যই বা কী! ছবি করার প্রথম ও অন্যতম উদ্দেশ্যই হল দর্শকের মনোরঞ্জন করা। তাই যদি সে করতে সক্ষম না হয়, তবে উদ্দেশ্যটাই তো মাটি হয়ে গেল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ছবিকে পুরোপুরি আর্ট করতে গিয়ে দর্শক মনোরঞ্জনের দিকটা উপেক্ষা করা চলে না। কাজেই আর্টও হোক আবার কমার্শিয়াল টাচও থাকুক, এ ধরনের ছবি হওয়াই ভালো। এরকম ছবি তো আমাদের বাংলাতেই বেশি হচ্ছে এবং হওয়া দরকারও।

প্রশ্ন: বর্তমানে চলচ্চিত্রে অভিনয় সম্পর্কে আপনার কী মত? অভিনয়ের ধারার কি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়? যদি হয়ে থাকে, সেই পরিবর্তন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

বিনতা: হালের ছবি দেখি না তা নয়, মাঝে মাঝে যাই। ভালোই লাগে দেখতে। অভিনয়ের ব্যাপারে যা বললেন, তা চোখে পড়েছে। অভিনয়ের যে পরিবর্তন ঘটেছে তা খারাপ লাগে না তো! তবে কিনা আরও সুন্দর করা যায় টেকনিক্যাল সুবিধাগুলোকে ঠিকমতো কাজে লাগিয়ে, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যদি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেন, তাহলে। সত্যি কথা বলতে কী, আজকাল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গ্ল্যামারের প্রতিযোগিতাটাই বেশি তার ফলে অভিনয়ের দিকে তাঁরা বিশেষ নজর দেন না। ফাঁকি দিয়ে কিস্তিমাত করতে চান আর কী। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। মাঝেমধ্যে রেডিয়ো প্রোগ্রাম করতে গিয়েই আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। রিহার্সাল দিতে কেউ আসেনই না। জানি না, সিনেমাতেও তা হচ্ছে কিনা। অনেককেই বলতে শুনেছি, অভিনয় এখন অনেক ফাস্ট, আগেকার সময়ে নাকি খুব স্লো ছিল। হয়তো ছিল, তবে তা তখন চোখে পড়েনি। এখনকার অভিনয় দেখে তা চোখে পড়ছে। তবে অভিনয়ের ধারার বিবর্তনে আঙ্গিকগত উন্নতিই প্রধান কারণ। এক একটি দৃশ্যের ভাঙা-ভাঙা অনেকগুলো টেক হওয়ার জন্য তাঁরা ছোট-ছোট দৃশ্যের ওপর বেশি নজর দিতে পারেন। তা যাইহোক, মোটামুটি অ্যাক্টিংয়ের উন্নতিই হয়েছে বলব।

প্রথম প্রকাশ: অমৃত, পৌষ ১৩৭৪


Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *