Uncategorized

রেগে আগুন কমল মিত্র, সুবিধা হলো সত্যজিতের

পৈতৃক ব্যবসায় ছেলের মন নেই, বাবাকে না জানিয়েই সে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পাড়ি দিচ্ছে দূর শহরে। ওদিকে অফিসে ছেলের হিসেবে বেজায় গরমিল পেয়ে বাবার মেজাজও সপ্তমে। বাড়ি ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে যায় পিতাপুত্রের। ইস্পাত কঠিন কণ্ঠে বাবার প্রশ্ন ‘কোথায় যাচ্ছ?’ এতক্ষণ বাবার মেজাজ নিয়ে মায়ের সঙ্গে মজা করা ছেলের ততক্ষণে মুখ শুকিয়ে গেছে। অফিসের কাজে অমনোযোগী হবার কারণে ছেলেকে প্রবল শাসন করা ও তার গানবাজনা করার ব্যাপারে ভয়ঙ্কর আপত্তি করে তাকে প্রায় ত্যাজ্যপুত্র করার উপক্রম করে যিনি সাদাকালো যুগের বাংলা ছবির সেরা রাশভারী বাবার তকমা পেয়েছেন তিনি অভিনেতা কমল মিত্র। 

সে যুগের একাধিক ছবিতে হয় রাগী বাবা নয়তো মহিষাসুর, কংস, প্রজাপতি দক্ষর মতো বিভিন্ন চরিত্রে ক্রুদ্ধ ও রুষ্ঠ অভিব্যক্তিতে যাকে দেখতেই দর্শক অভ্যস্ত ছিল তিনি কিন্তু বাস্তবেও যথেষ্ট মেজাজী ছিলেন। 

আশির দশকের সময় থেকে যেমন হিন্দি ছবির গানের দৃশ্যে একাধিক তারকা সমাবেশ দেখতে আমরা অভ্যস্ত, সেই রেওয়াজ বাংলা ছবিতে প্রথম চালু করেছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পরশ পাথর’ ছবির একটি দৃশ্যে সত্যজিৎ চেয়েছিলেন বাংলা ছবির ব্যস্ততম নক্ষত্রদের একইসঙ্গে ক্যামেরাবন্দী করতে। দৃশ্যটি সকলেরই চেনা, মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী কাচালুর (গঙ্গাপদ বসুর) দেওয়া পার্টির দৃশ্য। সেই দৃশ্যের জন্য সমস্ত শিল্পীদের আগে থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল নিজেদের পছন্দ মতো পার্টির পোশাক পরে আসতে। সত্যজিতের ছবি, তাই মোটামুটি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন সেই সময়ের টালিগঞ্জের দিকপাল শিল্পীরা। ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দ্রাবতী দেবী, রেণুকা রায়, তুলসী লাহিড়ী, ভারতী দেবী, অমর মল্লিক, নীতিশ মুখোপাধ্যায়, কে নেই সেই নক্ষত্র সমাবেশে।

শুধু বেঁকে বসলেন কমল মিত্র। যিনি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে পত্রপাঠ বিদায় করে দিলেন। এত বড় অভিনেতা হয়ে তাঁকে এক্সট্রার চরিত্রে অভিনয় করতে হবে শুনে তিনি তো রেগে আগুন! অগত্যা আসরে নামলেন প্রযোজক প্রমোদ লাহিড়ী স্বয়ং। ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে অবশেষে নিমরাজি হলেন অভিনেতা। প্রমোদবাবু বুঝিয়েছিলেন, ‘আসলে একটা রেকর্ড রাখতে চাইছি, যে একসঙ্গে এত স্টার একই ছবির একটি দৃশ্যে থাকবে’। পারিশ্রমিকের জন্য যদিও কাউকে ভাবতে হয়নি। ওই একটি দৃশ্যেই খরচ হয়েছিল ৩৫,০০০ টাকা, যা সে যুগের একটি ছবির পক্ষে অভাবনীয়।

কমল মিত্র রাজি তো হলেন। উপস্থিতও হলেন উক্ত দিনে নিজের পছন্দের পোশাক প্রিন্সকোর্ট ও গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরে। কিন্তু ব্যাপারটা তাঁর মোটেও পছন্দ হচ্ছিল না। প্রযোজকের অনুরোধে তিনি এলেন বটে, কিন্তু এত বড়মাপের এক শিল্পীকে ডেকে এনে শুধু বসিয়ে রাখা হবে জেনে তিনি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। তাঁর মেজাজ বেশ চড়া, মুখের ভাবও তেমনই। সত্যজিৎ যেন অভিনেতার ঠিক এই মুডটাই চাইছিলেন। চট করে ক্যামেরাবন্দী করে ফেললেন রাগী চেহারার কমল মিত্রকে। এই রাগী মুখই তো বুঝিয়ে দেবে হঠাৎ করে ধনী হওয়া পরেশ দত্তকে উচ্চবংশীয় বনেদি সম্প্রদায় তাঁদের একজন বলে মেনে নিতে নারাজ। কমল মিত্রর স্বাভাবিক অভিব্যক্তি পরিচালকের কাজে লেগে গেল। বাংলা ছবির ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *