‘এখনও মাটিতে বসে ভাত খাই’
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর নিউ আলিপুরের বাড়িতে আড্ডায় বসেছিলেন পাপিয়া অধিকারী (Papiya Adhikari)। কথা হচ্ছিল শৈশবের ফেলে আসা স্মৃতি, ঘর-সংসার, অভিনয়জীবন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। সেই আড্ডার আসরে হাজির অশোক সেন। তুলে আনলেন সেই স্মৃতিকথা। আজ প্রথম পর্ব
পাপিয়া: প্রথম সাক্ষাতে কানন দেবী তোমাকে টফি দিয়েছিলেন। কেন? তাঁর সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল?
সাবিত্রী: আমি তখন অনেক ছোট। ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেইসময় কাননবালার সঙ্গে দেখা হয়েছিল টালিগঞ্জে। আমি দিদির বাড়িতেই থাকতাম। আমরা দশ বোন ছিলাম। অষ্টম দিদির শ্বশুর ছিলেন থানার ওসি। থানার কম্পাউন্ডে একটা মাঠ ছিল। বিকেলবেলা সেই মাঠে আমরা খেলাধুলো করতাম। অন্যদিনের মতো সেদিনও স্কুল থেকে ফিরে এসে খেলছিলাম। হঠাৎ দেখি, একটা গাড়ি এসে থানার সমানে থামল। গাড়ি থেকে নেমেই এক ভদ্রলোক সোজা থানায় ঢুকে পড়লেন। ঢোকার মুখে উনি একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। আমি তখন সিনেমার পোকা ছিলাম। আর্টিস্ট দেখার জন্য টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কখনও তাঁদের দেখা পেতাম। আবার পেতামও না। অতৃপ্তি নিয়ে মনে-মনে স্বপ্ন দেখতে-দেখতে বাড়ি ফিরতাম।
হ্যাঁ, যে কথাটা বলছিলাম। থানার সামনে গাড়ি থেকে নেমে ভদ্রলোক তো ঢুকে পড়লেন। অনেকক্ষণ পর গাড়িতে বসে থাকা এক মহিলা তিনি আমাকে ডাকলেন। গেলাম। উনি বাক্স থেকে টফি বার করে আমাকে দিলেন। আমি তো টফি পেয়ে দারুণ খুশি। কিন্তু বান্ধবীরা অখুশি। তারা বলতে থাকল, ‘সাবু টফি পেল, আমরা পেলাম না।’ সেইসময় ওই ভদ্রলোক আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘দেখো-দেখো ওর চোখটা ঠিক তোমার মতো।’ আমি তো ওঁদের চিনি না। রাতে আমার দিদির শ্বশুরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘থানায় কারা এসেছিলেন?’ উনি বললেন, ‘কাননবালা এবং তাঁর স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য।’ সেই থেকে কাননবালা হওয়ার শখ জন্মেছিল। তারপর থেকে আমি সেই স্বপ্নে বিভোর। এক সপ্তাহ স্কুলেই যাইনি। আশ্চর্য, বাড়িতে এবং পাড়ায় আমাকে কাননবালা বলেই ডাকত! এরপর যা ঘটল, তা ভয়ঙ্কর! দিদি বাবাকে চিঠি লিখল, ‘সাবু লেখাপড়া করছে না, ও কাননবালা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর!’ সেই চিঠির উত্তর এল, সাবধানবাণী শুনিয়ে। আমি কিন্তু নিজের স্বপ্নকে মনে-মনে গড়ে তুলছি।
দীর্ঘ এত বছর, চারশোর বেশি ছবি, বহু নাটক, সিরিয়ালে অভিনয় করার পর এখনও মনে হয় কাননবালা হতে পারিনি। হওয়া সম্ভব নয়। কাননবালা, কাননবালা-ই। সাবিত্রী চ্যাটার্জি, সাবিত্রী চ্যাটার্জি-ই। তবে কাননবালা হওয়ার স্বপ্নপূরণে থেমে থাকিনি। লড়ে গিয়েছি। এখনও লড়ছি। লড়বও।
আরও পড়ুন: অতি উত্তম! এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি
পাপিয়া: প্রথম যেদিন ক্যামেরার মুখোমুখি হলে, সেদিনটার কথা মনে পড়ছে?
সাবিত্রী: মনে তো পড়বেই। তবে মনে রাখতে চাইনি। কেন না, সুখকর ঘটনা নয়। বোধহয় আমার মতো কোনও অভিনেত্রী এত স্ট্রাগল করেননি। প্রথম যেদিন ক্যামেরার মুখোমুখি হলাম, সেদিন থেকেই ধাক্কা খেতে শুরু করলাম। এত পরীক্ষা নিয়েছিলেন…ওফ্! মাঝে-মাঝে বলতেন, হাঁটো, দৌড়ও, হাসো, কাঁদো…ইত্যাদি। নখ থেকে মুখ পর্যন্ত ছবি তুলতেই থাকলেন! আমি ফেডআপ হয়ে গিয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম, আমি বাতিল। তার কারণ, ছোট মেয়েকে হিরোর সঙ্গে মানাবে না (যদিও সেটা হাসির ছবি ছিল)। তাছাড়া আমার উচ্চারণে বাঙাল কথার টান! নিরাশ হয়ে বাসে করে বাড়ি ফিরে এলাম। সেই সময় আমাদের পারিবারিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। প্রায় অনাহারেই দিন কাটত। অর্থের প্রয়োজন ছিল বলেই সংসার বাঁচাতে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছিলাম।
পাপিয়া: তারপর?
সাবিত্রী: তখন মাঝে-মাঝে ফাংশনে আমি ডান্স করে কিছু টাকা পেতাম। ওইটুকুই। এরপর বেশ কিছুদিন পর ভানুদা (বন্দ্যোপাধ্যায়) ফের ওখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, ওরা যুৎসই মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিল না। সুধীর মুখার্জির যে গ্রুপটা ‘পাশের বাড়ি’ করবেন, উনি আগে ‘বরযাত্রী’তে ছিলেন। ‘বরযাত্রী’ হিট করেছিল। যমুনা সিংহ তখন হিরোইন ছিলেন। তিনি হঠাৎ মোটা হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে চলবে না। ডাক পড়ল আমার। গেলাম। বললেন, ‘তোমার দুটো শট নেব। যদি পারো, তবেই নেওয়া হবে।’ প্রথম শটটাই নাকি দারুণ দিয়েছিলাম! সেদিনই আমি মনোনীত হয়ে গেলাম। তাঁরা বললেন, ‘আজই তোমার সঙ্গে চুক্তি হবে।’ বললাম, ‘আমি ওসব বুঝি না। আপনারা বাবার কাছে যান।’ ওঁরা এলেন। ঠিক হল, মাসে দু’শো টাকা। যতদিন না ছবির কাজ শেষ হবে ততদিন আমি অন্য কারও ছবিতে কাজ করতে পারব না।
আরও পড়ুন: মৃণাল সেনের ছবি থেকে বাদ পড়লেন অমিতাভ বচ্চন
পাপিয়া: সেই যাত্রা শুরু, আজ কেমন লাগছে।
সাবিত্রী: ওটা তো ভেতরকার ব্যাপার। আমি কিন্তু বদলাইনি। কত গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্য, পরামর্শ পেয়েছি। ভাবতে ভালোই লাগে। এত সাফল্য, পুরস্কার পেয়েও মাথা ঘুরে যায়নি। আগে যেমন দিদিদের সঙ্গে মাটিতে বসে গল্প করতে-করতে ভাত খেতাম, এখনও মাটিতে বসে ভাত খাই। ছোটবেলার স্মৃতিকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছি। সেই কষ্টের কথা ভুলতে চাই না। ভোলা যায় না। অথচ এখন বিশাল বাড়ি। প্রচুর আসবাবপত্র। বাবা স্টেশন মাস্টার ছিলেন। প্রচুর খরচ করে বোনদের বিয়ে দিয়েছেন। অর্থকষ্ট ছিল ঠিকই, তবে ঐতিহ্য হারাননি। ঐতিহ্যই জীবনের সম্পদ। আমি মাটির গন্ধ নেওয়া সাবিত্রী। সাধারণ জীবনযাপনেই অভ্যস্ত।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। একবার শুটিং শেষে উত্তমকুমার একটা সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ছবিটার নাম ‘দো বিঘা জ়মিন’। ওই ছবিটা দেখার পর ভীষণ কেঁদেছিলাম। সেদিন আমার কাছে রুমালও ছিল না। উত্তমদা নিজের পকেট থেকে রুমাল বার করে বললেন, ‘এটা পরিষ্কার রুমাল। চোখের জল মোছ।’ তারপর আমাকে নিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় চাইনিজ় খেতে গেলেন। জীবনে এই প্রথম কোনও রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। গিয়ে তো মহাবিপদে পড়েছি! আমি তো কাঁটা-চামচ ধরতে পারি না। কারওর দিকে না তাকিয়ে হাত দিয়ে খেলাম, পেটে খিদে রেখে। আহা, কী গন্ধ বের হচ্ছে। খেতেও ইচ্ছে করছে। কিন্তু খেলাম না। কারণ, আমার খাওয়া দেখে যদি কেউ হাসে। পাশে আবার উত্তমদা!
আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
পাপিয়া: তোমার জীবনে ভানুজেঠুর অবদান তো অনেক?
সাবিত্রী: ভানুদা তো আমার সব। আমি তাঁকে আজও অন্য চোখে দেখি। আমার জীবনে উনি ধ্রুবতারা। জীবনে দীপ জ্বেলে দিয়ে গিয়েছেন। তখন ওঁদের মতো বহু গুণী আর্টিস্টদের আমি সিনেমায় দেখেছিলাম। তাঁরা তখন রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে পানের দোকানে আড্ডা দিতেন। আমি রাংতায় মোড়া পান খেতে পছন্দ করতাম। ট্রাম ভাড়া বাঁচিয়ে সেখানে আমিও মিষ্টিপাতার পান খেতে যেতাম। হঠাৎ একদিন ভানুদা আমাকে ডেকে বাঙাল ভাষায় বললেন, ‘তোমারে একটা কথা কমু?’ আমিও বললাম, ‘কন!’ উনি বললেন, ‘আমরা বাঙাল ভাষায় একটা নাটক করছি। নাম ‘নতুন ইহুদি’। তুমি তো বাঙাল। সেই নাটকে অভিনয় করবে?’ আমি বললাম, ‘আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি বাবার কাছে যান। উনি রাজি হলে অভিনয় করব।’ ওঁরা বাবার কাছে এলেন। আমরা তখন ছোট্ট ভাড়াঘরে থাকি। ভানুদাকে দেখে বাবা বললেন, ‘তুমি সাম্যময় তো? তুমি তো আমাদের আত্মীয়। ঠিক আছে, সাবু অভিনয় করবে। তবে একটা শর্ত। তুমি এসে ওকে নিয়ে যাবে। ও তো সবে কলকাতায় এসেছে। এখানকার রাস্তাঘাট তেমন চেনে না।’ প্রথম দিন ভানুদা এসে আমাকে চেতলায় নিয়ে গেলেন বলীন সুরের বাড়িতে। ওঁর বাড়িতে রিহার্সাল হতো। ভানুদা ছিলেন ডিরেক্টর। সুশীল মজুমদার সেই গ্রুপে ছিলেন। সেখানে গিয়েও আমাকে নিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। সকলেই বললেন, ‘ভানু, এ তুই কাকে নিয়ে এসেছিস? এতটুকু মেয়ে! ওকে দিয়ে হিরোইন চলবে না!’ ফিরে এলাম বাড়িতে। ঘুরে-ফিরে ফের ছ’-সাত মাস পর ডাক। রিহার্সাল শুরু। বাঙাল কথায় ডায়লগ ছিল। আমার তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বাঙাল যে! রিহার্সালে পাস করে গেলাম। ওঁদের ভালো লাগল। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, যেদিন ভানুদা রিহার্সালে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেদিন পায়ের জুতোটি পর্যন্ত ছিল না। ভানুদা কিনে দিয়েছিলেন। সেই জুতো বহুদিন কাছে রেখে দিয়েছিলাম। তবে শেষরক্ষা করতে পারিনি। তখন তো শুধু রাস্তায় কাঁকর ছিল, এখন তো সর্বত্র কাঁকর।
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





