‘সুচিত্রা সেন সুন্দরী নয়, ফটোজেনিক ছিল’
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর নিউ আলিপুরের বাড়িতে আড্ডায় বসেছিলেন পাপিয়া অধিকারী (Papiya Adhikari)। কথা হচ্ছিল শৈশবের ফেলে আসা স্মৃতি, ঘর-সংসার, অভিনয়জীবন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। সেই আড্ডার আসরে হাজির অশোক সেন। তুলে আনলেন সেই স্মৃতিকথা। আজ শেষ পর্ব
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পাপিয়া: পুরনো স্মৃতি কিছু মনে পড়ছে?
সাবিত্রী: প্রথমেই তো ভানুদার বহু স্মৃতি ছবির মতো ভেসে ওঠে। তারপর ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, উত্তমকুমার, তরুণকুমারের মতো শিল্পীদের কথা বেশি মনে পড়ে। এঁদের সঙ্গে কীভাবে অভিনয় করতাম। পরামর্শও দিতেন। ছবিদা বলতেন, ‘সাবি তুই এই জায়গাটা এভাবে কর, দেখবি দারুণ লাগবে।’ করতামও। দুর্দান্ত শট হতো। তারপর উনি বলতেন, ‘তোর সুবিধা কী জানিস? একবার বলে দিলে তুই অন্তর দিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারিস!’ অনেকে বলেন, আমি নাকি প্রতি মুহূর্তে অভিনয়ে কণ্ঠস্বর, ভঙ্গিমা ইত্যাদি বদলাতে পারি। বিশ্বাস করো, সংলাপ বুঝে আপনা থেকেই চলে আসে। আমি কোনওদিন অভিনয় শিখিনি। চেষ্টা করিনি। আমি মনে করি অভিনয়টা শেখানোর বিষয় নয়, ভেতরের ব্যাপার। জীবনে গ্লিসারিন দিয়ে কাঁদিনি। পারিও না।
আমাদের সময় স্টুডিয়োর পরিবেশ ছিল একেবারে অন্যরকম, যা আজকের দিনে ভাবাই যায় না। ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে একসঙ্গে তিরিশজন মেকআপ করতাম। সাতটি ছবির শুটিং হচ্ছে। কারা ছিলেন জানো? আমি, শোভা সেন, সন্ধ্যারানি, প্রণতি ঘোষ, সুচিত্রা সেন, ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র। সবার নাম মনে পড়ছে না। সুচিত্রা আর আমি ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ করেছি। ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যেও আনন্দ করে কাজ করেছি, কোনও অসুবিধা হয়নি।
আরও পড়ুন: ‘সমাজের কীট বলেই ভাবত আমাদের’
একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে। একদিন সুচিত্রা আর আমি পাশাপাশি মেকআপ করছি। হঠাৎ সুচিত্রা বলল, ‘সাবু পান দে।’ দিলাম। সেই পান চিবোতে-চিবোতে নিজের মনেই বলতে লাগল, ‘সুচিত্রা সেন তুমি যতই মেক-আপ করো না কেন, সাবিত্রী চ্যাটার্জি কোনওদিনই হতে পারবে না।’ তবে ওই মহিলা একেবারে অন্যরকম। ওঁর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা কঠিন। কখন যে কাকে চিনেও না-চেনার ভান করে চলে যেত বোঝা মুশকিল। সেটা অবশ্য ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল। তবু আমরা দিদি-বন্ধুর মতো সকলে মিশতাম। কেউ প্রতিযোগী ছিলেন না। যে যাঁর কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের যোগ্যতাকে প্রমাণ করতাম। এখন তো যোগ্যতা নয়, কে আগে গিয়ে দৌড়ে জায়গা দখল করবে সেই প্রতিযোগিতা। আমরা খুব কষ্ট করে অভিনয়টা করেছি। এই কষ্টের মধ্যেও একটা আনন্দ ছিল।
পাপিয়া: যেমন?
সাবিত্রী: ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এর কথা সকলেই জানেন। নতুন করে কী আর বলব। বীকানের, রাজগীর, ঘাটশিলা, দিঘা, জাগুলিয়ায় শুটিং হয়েছিল। জাগুলিয়ায় তখন জঙ্গল আর জঙ্গল। বসতি নেই। আলো নেই। আমাদের চেহারা কঙ্কালের মতো হয়ে গিয়েছিল। আমরা সাতদিন একটা টেন্টের মধ্যে ছিলাম। উত্তমদা একটা খাটিয়ায় শুতেন। হোটেল নেই। শুধু অন্ধকার। আমরা বিকাশদার (রায়) মুখের দিকে চেয়ে রা-কাড়তে পারিনি। প্রায় ১৫০ জনের গোটা ইউনিট তাঁবুর নীচে থাকতাম। এত গরম যে আমাদের গায়ের চামড়া খসে-খসে পড়ছিল। ওই গরম আর বালির ভয়ে আমি বহুদিন দিঘা যাইনি। এখনকার নতুন আর্টিস্টরা এসব মানিয়ে নিতে পারবে? আমার মনে হয় পারবেই না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, আমি যখন হিরোইনের পার্ট করি তখন মাসে বেতন ছিল মাত্র ₹১,৫০০!
আরও পড়ুন: ‘এখনকার ছবি শুক্রবারে আবিষ্কার, সোমবারে পরিষ্কার’
যাক, এবার স্টেজের কথা একটু বলি। পর্দা থেকে স্টেজই আমার প্রথম প্রেম। মঞ্চে উত্তর সারথি সংস্থার ‘নতুন ইহুদি’র পর ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘শ্যামলী’, ‘পরিণীতা’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘শ্রেয়সী’, ‘অতএব’, ‘কথা কও’, ‘ঘর’, ‘পরস্ত্রী’, ‘মল্লিকা’, ‘অমরকণ্টক’, ‘রাজকুমার, ‘কাচের পুতুল’, ‘সেই রাত’, ‘আগন্তুক’ কত আর বলব! চিরকালই দর্শকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ভালোবাসি। এই দুই মাধ্যমে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পাপিয়া: উত্তমকুমারের বিপরীতে প্রথম অভিনয়ের কথা মনে পড়ছে?
সাবিত্রী: মনে হয় ‘লাখ টাকা’ বা ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। তারপর তো অনেক ছবি করেছি। ‘নিশিপদ্ম’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘কল্যাণী’, ‘অনুপমা’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘রাজা সাজা’, ‘কুহক’, ‘নবজন্ম’, ‘রাতভোর’, ‘গৃহদাহ’, ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘অভয়ের বিয়ে’, ‘বড় বউদি’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘মৌচাক’ আর ‘প্রতিশোধ’। সত্যি কথা বলতে কী, অভিনেতা উত্তমকুমার আমার কাছে অন্য মানুষ। অসাধারণ তাঁর অভিনয় প্রতিভা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও দক্ষ। আমার কাছে উত্তমদা, সৌমিত্রদা দু’জনেই সমান। ধরো, দু’জনেই ভাত খাচ্ছে। তবে দু’জনের খাবার স্টাইলই আলাদা। চাহনি, ভাত মাখা, খাওয়ার মধ্যে দু’রকম ছন্দ পাওয়া যায়। ওদের অভিনয়েও ভিন্ন-ভিন্ন ছন্দ আছে। অভিনেতা সৌমিত্র, নাট্য পরিচালক সৌমিত্র, নাট্যকার সৌমিত্র আমার কাছে সমান এবং প্রিয়। পরিচালক হিসেবে নিখুঁত। অন্যদিকে, ছবিতে উত্তম-সাবিত্রীর প্রতিটি ছবি সুপারহিট। রসায়নটা ছিল অন্যরকম। আমি অনেককে বলেছিলাম। সবাই বলে উত্তম-সুচিত্রা। আরে বাবা উত্তম-সাবিত্রীও তো আছে। আমি সুচিত্রার মতো অত সুন্দরী নই। তবে সুচিত্রা মোটেই সুন্দরী ছিল না। ফটোজেনিক ফেস ছিল। আমি আমিই। আসলে ওদের জুটিটা ক্লিক করে গিয়েছিল। সাবিত্রী কী দোষ করল? সুচিত্রাদির সঙ্গে উত্তমদার ক’টা ছবি? ম্যাক্সিমাম জুটি তো আমার সঙ্গে! আমি উত্তমদার সঙ্গে পার্ট করে দারুণ আনন্দ পেয়েছি। অসাধারণ অভিনেতা বটে! উত্তমদা, সৌমিত্রদা সম্পর্কে বলে শেষ করা যায় না। দু’জনেই পাওয়ারফুল অভিনেতা। উত্তম-সাবিত্রী জুটির মতো উত্তম-হেমন্ত জুটিও সুপারহিট।
আরও পড়ুন: অতি উত্তম! এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি
পাপিয়া: সত্যজিৎ রায় তোমাকে সুযোগ দেননি। আক্ষেপ হয়?
সাবিত্রী: নাহ্, কোনও আক্ষেপ নেই। উনি যে ধরনের ছবি করেছেন, তাতে ওঁর মনে হয়েছে আমাকে ছাড়া অন্যকে নিলেও হবে তাই। তবে দেখা হলেই বলতেন, ‘আপনি দারুণ অভিনয় করেন। এবার আপনাকে নেব।’ কিন্তু নেননি।
পাপিয়া: ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, মৃণাল সেনের ছবিতেও তোমাকে তেমনভাবে পাওয়া যায়নি
সাবিত্রী: কী আর বলি! ঋত্বিকদা একবার বাড়িতে এসেছিলেন। গল্প শুনিয়ে বললেন, ‘সাবু একটা ছবি করছি, তোমাকে নেব।’ ব্যাস, কথাবার্তা বলে গেলেন। কিছুদিন পর উনি মারা গেলেন। আর তাঁর ছবিতে কাজ করা হল না।
আরও পড়ুন: সেরা ছবি ‘সীমাবদ্ধ’
পাপিয়া: বাংলা ছবির এই হাল কেন?
সাবিত্রী: এই গল্প, সেই গল্প চুরি করে ছবি করলে সাফল্য আসবে? না। আমাদের দেশে একটু ভালো গল্প হলেই ছবি সুপারহটি হয়। এখন সিরিয়ালে ডিরেক্টর হিসেবে যাঁদের নাম পর্দায় দেখা যায়, তাঁরা কি ডিরেক্টর? তাঁরা আসলে ফ্লোর ডিরেক্টর। দীর্ঘদিন ফ্লোরেই আসেন না। এর বেশি বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। ভালো ছবি করতে গেলে ভালো গল্প চাই। সাহিত্যকে আশ্রয় নিতে হবে। আমাদের সময় যা ছিল আর কী।
পাপিয়া: ফিরে দেখা সাবুদি, এখন কেমন আছ?
সাবিত্রী: বাব্বা, ঘুরিয়ে প্রশ্ন করার দরকার কী? (একটু হেসে) আমি এখনও সাদাসিধে সাবুই রয়েছি। দিব্যি আছি। তবে পরিমিত আহার, শরীরচর্চার মধ্যে দিন কাটলেও বড্ড একা লাগে। প্রিয়জনেরা খোঁজ নিলে, একটু এসে দেখা করলে, একটা পান কিনে এনে যদি বলে দিদি কেমন আছ, তখন মনে হয় নিজের ঘরের লোককে পেলুম। তা আর হচ্ছে কই?
(সমাপ্ত)
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





