রিঅ্যাকটিং ইজ় মোর দ্যান অ্যাক্টিং, শিখিয়েছিলেন ভানুজেঠু
পাপিয়া অধিকারী: ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Bhanu Banerjee) আমি জেঠু বলেই ডাকতাম। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর। সকলেই জানেন, পরীক্ষার পর মাস তিনেকের মতো অবসর থাকে। ওই অবসরে ভেবেছিলাম শর্টহ্যান্ড শিখব। বা কিছু একটা করব। ছাত্রজীবনের ভাবনা তখন একটু এলোমেলোই থাকে। আমারও ছিল। যেহেতু মা (কল্যাণী অধিকারী) অভিনেত্রী ছিলেন, ভালো নৃত্যশিল্পী ছিলেন, সেহেতু ছোটবেলা থেকে অভিনয় এবং নাচের তালিম নিয়েছিলাম। সে প্রসঙ্গ থাক। লেখার বিষয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
দীপিকামাসির (দীপিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) প্রস্তাবে, তাঁর আগ্রহে নাটকে অভিনয় করব বলে মনস্থির করলাম। নির্দেশক পার্থকাকু (পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়)। নাটকের নাম ‘পিঞ্জর’। অভিনয় করলাম।
আরও পড়ুন: ‘এক ফিল্ম হিরোর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি’
প্রসঙ্গটা একটু স্মরণ করিয়ে দিই। একদিন দীপিকামাসি আমার মায়ের কাছে এলেন। বললেন, ‘একটা ভালো রোল আছে। সম্পূর্ণ ইংরেজিতে সংলাপ। তোমার ছোট মেয়েকে ওই রোলে নিতে চাই।’ মাসির কথা শুনে মা বললেন, ‘অভিনয়ে কারা আছেন? তাছাড়া আমার এই ছোট্ট মেয়েকে ‘রঙ্গনা’তে কে নিয়ে যাবে (তখন আমার বয়স ১৬-১৭ হবে)?’ মাসি বললেন, ‘যেদিন-যেদিন শো হবে, আমি নিজে এসে নিয়ে যাব (মাসি ভালো ড্রাইভ করতে পারতেন)।’
মা আশ্বস্ত হলেন। কথাও দিলেন। তারপর মাসি বললেন, ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনিস? তাঁর সিনেমা দেখেছিস?’ আমি বললাম, ‘চিনি।’ হাসিমুখেই মাসিকে জবাব দিয়েছিলাম। তারপর মাসি বললেন, ‘মনে আছে, মাসিমা মালপোয়া খামু?’ বললাম, ‘মনে থাকবে না?’ সেদিনের মতো মা-মাসি এবং আমার কথোপকথন শেষ। মাসিমা যাওয়ার আগে মাকে বললেন, ‘আপাতত তিনমাস ‘পাপ্পা’ (আমার ডাকনাম) চালিয়ে দিক, ওর স্কুল খুলে গেলে তারপর অন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
আরও পড়ুন: ”বাঞ্ছারামের বাগান’ না করা মস্তবড় ভুল ছিল’
যাইহোক, সেই নাটকে ছিলেন সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, গীতামাসি (গীতা দে), রমেন রায়চৌধুরী, উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, কল্যাণী মণ্ডল ও আরও অনেকে। সেই চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগের কথা এখন সকলের নাম মনে পড়ছে না। সেই নাটকের শো হয়েছে উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের ‘রঙ্গনা’ থিয়েটারে। এই নাটকের সূত্রেই সহ-অভিনেত্রী হিসেবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপের প্রথম পর্ব।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, প্রথম শো থেকেই আমার অভিনয়ে সকলেই মুগ্ধ। জানি না, ছোট ছিলাম বলেই তাঁদের ভালো লেগেছিল হয়তো। শেষমেশ আমাকে প্রত্যেকটা শো করতে হলো। বৃহস্পতিবার একটা শো, শনি-রবি দুটো করে শো। ওই টিমে একমাত্র আমি সর্বকনিষ্ঠা অভিনেত্রী ছিলাম বলেই সকলের স্নেহ-আদর পেয়েছিলাম। বিশেষ করে ভানুজেঠু এবং দীপিকামাসির স্নেহ আজও স্নিগ্ধ-শীতল করে দেয়।
আরও পড়ুন: আর্ট ফিল্ম মানে শুধুই যৌনতার ছড়াছড়ি, ক্ষুব্ধ ঋত্বিক
প্রকৃত নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সকলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নামেই চেনেন। জন্ম ঢাকার বিক্রমপুরে, ১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে স্বদেশী আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে রাজরোষে ঢাকা ছাড়তে হয়। পরে চলে আসেন এপার বাংলায়। দক্ষিণ কলকাতার চারু অ্যাভেনিউয়ের মেজবোনের বাড়িতে। সেখান থেকেই তাঁর অভিনয়জীবনের যাত্রা শুরু।
ভানুজেঠুকে আমার ‘মামা’ বলেই সম্বোধন করা উচিত ছিল। আমার মা ‘দাদা’ বলে ডাকতেন। কিন্তু কেন জানি না প্রথম দিন থেকেই জেঠু বলে ডেকে এসেছি। তাই তিনি আমার কাছে জেঠু হয়েই রয়ে গিয়েছেন।
এক্কেবারে যাকে বলে কাঠবাঙাল। সবসময় বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। প্রথম আলাপেই তাঁকে আমার অন্যরকম মনে হয়েছিল। উনি যেভাবে কথা বলতেন, অন্যদের হাসি পেলেও নিজে নির্বিকার থাকতেন। ওঁর মুখে ‘কও’, ‘টও’, ‘জ়ামু’, ‘খামু’, ‘কমু’ ‘দিমু’ ইত্যাদি এরকম বিদঘুটে শব্দ শুনে হাসি পেত। কিন্তু সামনে হাসবার সাহস পেতাম না, আড়ালে গিয়ে মুখে রুমাল চাপা দিতাম।
আরও পড়ুন: দ্বিতীয় সেরা সত্যজিৎ, হতভম্ব দর্শক
এবার আসি রিহার্সাল প্রসঙ্গে। রঙ্গনায় রিহার্সাল হচ্ছে। পার্থকাকুর নির্দেশমতো সকলেই অভিনয় করে দেখাচ্ছেন। আমার মুখে প্রথম সংলাপ ছিল, ‘এক্সকিউজ মি, উড ইউ লাইক টু ডান্স উইথ মি?’ প্রথম দিনেই আমার সংলাপ শুনে পার্থকাকু এবং ভানুজেঠু আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর ভানুজেঠু পিতৃস্নেহে আমার হাতদুটো সকলের সামনে চেপে ধরে বললেন, ‘থ্যাঙ্কস’। তারপর সেই সংলাপটা ইংরেজদের স্টাইলে অন্যরকমভাবে বললেন। আমার উচ্চারণ, বলার স্টাইল মোটেই ভুল হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। কারণ, আমি সবসময় ইংরেজি উচ্চারণ সঠিকভাবেই করে থাকি। যাইহোক, সেদিন আমি জেঠুর ইংরেজি উচ্চারণ শুনে অবাক হয়েছিলাম।
উচ্চারণ সঠিক রেখে একই বাক্য কতরকমভাবে বলা সম্ভব, তা সেদিন ভানুজেঠুর কাছে শিখেছিলাম। প্রথম রিহার্সালে উনি বলেছিলেন, ইংরেজি উচ্চারণ একেকজন একেকরকমভাবে বলেন। নর্থের লোক তাঁদের মতো, সাউথের লোক তাঁদের মতো উচ্চারণ করেন। আবার উচ্চারণ করে বুঝিয়ে দিলেন। পরে বললেন, ‘নর্থ-সাউথ মানে ক্যালকাটা নয় রে, ইন্ডিয়া। নর্থ ইন্ডিয়া, সাউথ ইন্ডিয়া।’ বেশ মজা করে বলতেন। আশ্চর্যের কথা, জেঠু বলতেন, ‘সবচেয়ে ভালো ইংরেজি বলতে জানে বাঙালিরা!’
কেন? তিনি বলেছেন, ‘আগে ব্রিটিশরা এখানেই ছিল। রাজধানী তো এখানেই। তাই এখানকার লোকেরা ভালো ইংরেজি বলতে পারে।’ তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের নাম বলেছিলেন। বঙ্কিমবাবুও অসাধারণ স্টাইলে ইংরেজি বলতেন।
আরও পড়ুন: অতি উত্তম! এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি
রিহার্সালের সময়ের আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। আমাকে উদ্দেশ্য করে বাঙাল ভাষায় বললেন, ‘এই ম্যাইয়া যদি বাঁইচ্যা থাকে, তালে অনেকের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফ্যালবো!’ এর অর্থ বুঝতে পারিনি। বাড়িতে গিয়ে মাকে বলেছিলাম, এ কথার মানে কী? মা বলেছিলেন, ‘তোমার অভিনয়, বাচনভঙ্গি ভালো লেগেছে বলেই ভানুদা এ কথা বলেছেন। ওসব কথায় কান না দিয়ে তোমার কাজ তুমি নিষ্ঠার সঙ্গে করে যাও।’
সেই শুরু হয়ে গেল রঙ্গনায় অভিনয়। টানা শো করেছি। বহু কল শো করেছি। কল শোয়ের দিনগুলোতে ভীষণ মজা হতো। ভানুজেঠু অবসর পেলেই ওঁর অভিনয়জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতেন। একদিন বললেন, ‘রিঅ্যাকটিং ইজ় মোর দ্যান অ্যাক্টিং।’ সেটা সিনেমায় বা স্টেজে সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মানে, যিনি সংলাপ বলবেন, তার থেকেও যিনি তা শুনবেন, সেই প্রতিক্রিয়াই আসল। রিঅ্যাক্টিংটাই মুখ্য। মাচ মোর ইমপর্ট্যান্ট। আসলে যিনি সংলাপ শুনছেন তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখলেই বোঝা যাবে অভিনয়টা কেমন হচ্ছে। দর্শক তো তাঁকেও দেখবেন। যিনি তাঁর পার্শ্ব অভিনেতা।
জেঠু বলতেন, ‘জানিস, শিরদাঁড়াটা টান-টান কইর্যা, মাথাটা একটু নীচু কইর্যা…।’ মানেটা বুঝতে পারতাম না। পরে বলতেন, ‘এর মানে হচ্ছে, বড়দের সম্মান করতে হবে।’ দলের মধ্যে হয়তো সবচেয়ে ছোট পেয়েছিলেন বলেই জীবনশিক্ষা দিয়েছিলেন। জেঠু বলে ডাকলেও মনে হতো শিক্ষক।
আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্কটে বাংলা ছবি, উদ্বিগ্ন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা
অসাধারণ ইংরেজি বলতেন। সাহেবের মতো ছিল তাঁর উচ্চারণ। উনি ইংরেজিতে একটা বই লিখেছিলেন, আমাকে দিয়েওছিলেন। একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ এমন সুন্দর ইংরেজি বলতেন, যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাঁরাই জানেন।
দুর্ভাগ্য, একটিমাত্র নাটকে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আর হয়নি। আমি যখন পুরোপুরি নায়িকা, তখন উনি তার অনেক আগেই (১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ) চলে গেলেন। পরবর্তী জীবনে তাঁর অভিনীত বহু ছবি দেখেছি। অভিনয়গুণে মুগ্ধ হয়েছি। বাংলা চলচ্চিত্রের কৌতুকাভিনতাদের মধ্যে ভানুজেঠু ছিলেন অন্যতম ব্যতিক্রমী।
অনুলিখন: অশোক সেন
Edited by Kamalendu Sarkar
Published by Swati Chatterjee
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





