জটায়ু একশো (পর্ব ১)
কমলেন্দু সরকার: সন্তোষ দত্তকে বাঙালি চিনল কবে! ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ‘সোনার কেল্লা’ থেকে। তবে তার অনেক আগেই শুন্ডি আর হাল্লার রাজাকে দেখেছি, ভাল লেগেছিল কিন্তু লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর মতো প্রাণের মানুষ হতে পেরেছিলেন কী! হয়তো পারেননি। তার কারণ ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে পরিচালক-লেখক সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) যতটা সময় ও স্পেস দেন সন্তোষ দত্তকে, সেইভাবে পাননি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে। পাওয়ার প্রশ্নও নেই। তবুও শুন্ডি এবং হাল্লার রাজার দ্বৈত ভূমিকায় কিছু-কিছু জায়গায় সন্তোষ দত্ত (Santosh Dutta) আলাদা করে দৃষ্টি কাড়েন। যেমন, হাল্লার কুচক্রী মন্ত্রী (জহর রায়) যখন তাকে মন্ত্রপূত ওষুধ খাইয়ে যুদ্ধ করার জন্য উত্তেজিত করার চেষ্টা করে আর হাল্লার রাজা বর্শাটি নিয়ে শুন্ডির কুশপুতুলে বারবার আঘাত করে, তখন খলনায়ক সন্তোষ দত্তের অভিনয় আলাদা করে চিহ্নিত হয়।
আরও একটি জায়গায় তিনি অসাধারণ। ছবির শেষে হাল্লার রাজা জিজ্ঞাসা করেন, ‘রাজকন্যে কি কম পড়িতেছে?’ শুন্ডির রাজার কন্যা মণিমালা। গুপীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হলে বাঘা বিয়ে করার জন্য খেপে ওঠে। সেইসময় হাল্লার রাজা ওই প্রশ্ন করেন। তারপর মনে করিয়ে দেন তার একমাত্র কন্যা মুক্তামালা রয়েছে হাল্লায়। শুন্ডি এবং হাল্লার রাজা দুই ভাই মুখোমুখি, বহুদিন পর তাদের মধ্যে কথোপকথন হয়। পুরো সিকোয়েন্সে সন্তোষ দত্তের দ্বৈত অভিনয় অপূর্ব! একেবারে অন্যরকম। এই অভিনয় ছিল তাঁর একেবারে নিজস্ব। এবং সন্তোষ দত্তের অভিনয়ের মধ্যে কখনও পুনরাবৃত্তি দেখা যায়নি। মনে হতে পারে অভিনয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে কিন্তু তা হয়নি কখনও।
আরও পড়ুন: ছ’মাসের শিশুর মুখটা উত্তমকুমারের
সন্তোষ দত্ত অভিনীত কিছু চরিত্রের বিশ্লেষণে দেখা যাক তাঁর অভিনয়ের ব্যাপ্তি। ‘হারমোনিয়াম’ ছবির বিয়েবাড়ির দৃশ্য। নিমন্ত্রিততরা বসে খাচ্ছেন, তদারকি করছে মেয়ের বাবার ভূমিকায় সন্তোষ দত্ত। আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা আসছেন। তাদের অভ্যর্থনা এবং যারা খেতে বসেছেন তাদের অ্যাটেন্ড করা, একইসঙ্গে দু’টি অভিনয়ে কোনও ভুলচুক নেই অভিনেতার।
কোটপ্যান্ট পরিহিত এক ভদ্রলোক এসে বললেন, ‘আরে এ যে বিরাট আয়োজন করেছ দেখছি!’
সন্তোষ দত্ত উত্তরে বললেন, ‘উপায় নেই ভাই, মেয়ের বিয়ে।’
ভদ্রলোক বলেন, ‘এটাই দুঃখের, মেয়ে আমাদের এত প্রিয়…”
ভদ্রলোক কথা শেষ করার আগেই সন্তোষ দত্ত বললেন, ‘অথচ বিয়ের সময় বাপের নাম ভুলিয়ে দেয়। এই ব্যাচে বোধহয় আপনার জায়গা হবে না, আপনাকে একটু বসতে হবে।’
সংলাপে দু’টি বাক্যের মধ্যে তাৎক্ষণিক মুডের পরিবর্তন!
অতিথি ভদ্রলোক ‘আচ্ছা-আচ্ছা, ঠিক আছে,’ বলে অন্যত্র যেতেই সন্তোষ দত্ত চলে গেলেন হরেনবাবুর (কালী বন্দ্যোপাধ্যায়) কাছে। হরেনবাবু প্রতিবেশী, খেতে বসেছেন।

‘হারমোনিয়াম’
সন্তোষ দত্ত জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হরেনবাবু? হচ্ছে তো, ঠিক?
খেতে ব্যস্ত কালী বন্দ্যোপাধ্যায় হাত নেড়ে বললেন, ‘আমি কোথাও ইনভাইটেশন খাই না। আমি তো জানি আজকাল এসব জোগাড় করা একটা ইনহিউম্যান টাস্ক। তা আপনি এসব জোগাড় করলেন কোত্থেকে?’
কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মুখে পরিবর্তন এল। বললেন, ‘ওই প্রভিডেন্ড ফান্ডটা ভাঙলুম…’
কালী বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘বাহ, দারুণ! আপনার এই ছানার পোলাওটা দারুণ হয়েছে।’
সঙ্গে-সঙ্গে এক পরিবেশনকারীকে ডেকে সন্তোষ দত্ত বললেন, ‘ওরে…ওরে…আরও হাফ কিলোটাক ছানার পোলাও দিয়ে যা।”
খাওয়াদাওয়ার মাঝে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দই খেয়েই বলে দিলেন সেটা মোল্লার চকের, স্বগোতক্তি করলেন সন্তোষ দত্ত, মধ্যবিত্ত বাঙালিবাড়ির মেয়ের বিয়েতে যেটা খুবই স্বাভাবিক, ‘ওই মোল্লার চকেই আমার স্ত্রীর ছ’গাছা চুড়ি চলে যাবে!’
পুরো সিকোয়েন্সটিতে বোঝা যায় সন্তোষ দত্ত কী মাপের অভিনেতা!
আরও পড়ুন: ট্রিলজির শিরোপা দিতে এত কার্পণ্য কেন?
আবার সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’ (১৯৬১) ছবির ‘সমাপ্তি’তে দেখুন, সন্তোষ দত্ত কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। হবু জামাইয়ের সামনে গলবস্ত্র হয়ে সারাক্ষণ ‘হেঁ-হেঁ-হেঁ’ করে গেলেন। একেবারে বিপরীত চরিত্র, বিপরীত অভিনয়।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশ পাথর’ (১৯৫৮) ছবির অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তিনি বলতে শুরু করেন। যখনই শুরু করতে যাচ্ছেন তখনই মাইকের গণ্ডগোল, বিশ্রী একটা মেটালিক সাউন্ড কানে আসে। সেই দৃশ্যে ওই শব্দের সঙ্গে সন্তোষ দত্তের মুখের অভিব্যক্তি একেবারে নিখুঁত। এই ব্যাপারটা খুব বড় অভিনেতা না হলে হয় না। মেটালিক সাউন্ডের সঙ্গে মুখের অভিব্যক্তি মিলিয়ে দেওয়াটা বেশ কঠিন। এই কঠিন কাজটি অনায়াসে করে দিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: শেষ নাহি যে
সন্তোষ দত্তকে খুঁজে পান সত্যজিৎ নাটক দেখতে গিয়ে। উনি তখন ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ব্যস্ত আইনজীবী হিসেবে। পাশাপাশি অভিনয়ও করতেন। অভিনেতা-গায়ক সবিতাব্রত দত্তের দলে নিয়মিত অভিনয় করতেন। কর্মসূত্রে সবিতাব্রতের সঙ্গে সন্তোষ দত্তের আলাপ-পরিচয়, যোগাযোগ। ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ নাটকে সন্তোষ দত্ত করতেন ভবদুলাল চরিত্রটি। নাটকে সন্তোষ দত্তের অভিনয় ভাললাগে সত্যজিতের। সেই সময় তিনি ‘পরশ পাথর’ ছবিটি করবেন, সব ঠিক। ছোট্ট একটি চরিত্রে নির্বাচন করলেন তিনি। যে অভিনয়ের কথা ইতিপূর্বেই বলেছি।
সত্যজিৎ নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন এঁকে পরবর্তী সময়ে আরও কাজে লাগানো যাবে। ‘পরশ পাথর’ (১৯৫৮) ছবির পরে আরও সাতটি অর্থাৎ মোট আটটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। ‘পরশ পাথর’ ছাড়া বাকিগুলো ছিল ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১), ‘মহাপুরুষ’ (১৯৬৫), ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ (১৯৬৮), ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪), ‘জন অরণ্য’ (১৯৭৬), ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) ও ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০)।
আরও পড়ুন: ‘এক ফিল্ম হিরোর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি’
এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিতের পুত্র, পরিচালক সন্দীপ রায় বলেছিলেন, “সন্তোষদা ‘পরশ পাথর’-এ একটা ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ওঁর সেই কাজ দেখেই বাবা বুঝেছিলেন যে এঁকে পরে অবশ্যই ব্যবহার করা যায়। এরপর তো আস্তে-আস্তে ‘তিনকন্যা’, ‘সমাপ্তি’তে অভিনয় করলেন। এরপর তো পরপর তো বাবার পরিচালনায় উনি অজস্র ছবিতে অভিনয় করলেন।”
অন্য এক সাক্ষাৎকারে সন্দীপ বলেন, “আসলে বাবা চাইতেন কয়েকজন অভিনেতার সঙ্গে বারবার কাজ করতে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সন্তোষ দত্ত। ভীষণ পছন্দ করতেন বলেই না যখন তেমন কোনও পছন্দের চরিত্র তিনি তৈরি করতেন, দুম করে সন্তোষ দত্তকে ফোন করে দিতেন। বাবা সবসময়ই চাইতেন ওঁকে যদি কোনওভাবে ছবিতে কাজে লাগানো যায়। রবি ঘোষের বেলাতেও এটা করতেন বাবা।”
আরও পড়ুন: ‘কন্যাদায়গ্রস্ত এক বয়স্ক ভদ্রলোক সাহায্য চাইতে এলেন’
সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজ়ের ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে প্রথম আবির্ভাব হয় জটায়ুর। সন্দীপের কথায়, “গোড়ার দিকে জটায়ুর ইলাস্ট্রেশন পুরোপুরি আলাদা ছিল। তারপর ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে সন্তোষদা এমন অভিনয় করে বাজিমাত করে দিলেন যে বাবা দেখলেন, এই রে আর তো জটায়ুকে অন্যরকমভাবে আঁকা যাবে না। তাই জটায়ুর ইলাস্ট্রেশন পুরো তাঁর মতো হয়ে গেল। কোনও ছবির অভিনেতাকে দেখে সাহিত্যের চরিত্রের ইলাস্ট্রেশন পাল্টে গেল, এটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।”
বলা যায় সন্তোষ দত্ত নয়, বাঙালি তাঁকে চেনে জটায়ু নামে। সন্তোষ দত্ত বা লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু, বাঙালি কোন নামে বেশি চেনেন? অবশ্যই জটায়ু। তবে গড়পাড়ের লালমোহন গাঙ্গুলির আড়ালে বাঙালি ভুলে গিয়েছেন ‘জন অরণ্য’-এর হীরালাল, ‘সমাপ্তি’র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, ‘হারমোনিয়াম’-এও তাই, ‘গোপাল ভাঁড়’-এর গোপাল, ‘চারমূর্তি’র মেসোমশাই। ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) ও ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) ছবিতে জটায়ুর পর বাঙালি সন্তোষ দত্তকে পেয়েছিল উত্তমকুমারের স্যাঙাত অবলাকান্ত চরিত্রে। উত্তমকুমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এমনকী কিছু-কিছু জায়গায় অবলাকান্ত অর্থাৎ সন্তোষ দত্তের কাছে উত্তমকুমারকে সামান্য হলেও ম্রিয়মান লাগে।
আরও পড়ুন: ‘কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করে না, কি রে খেয়েছিস?’
সত্যজিৎ রায়ের ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ (১৯৬৫) ছবির ‘মহাপুরুষ’-এর বিজ্ঞানী প্রফেসর ননীর চরিত্রে সন্তোষ দত্তকে আলাদা করে ভাল লাগে। ‘মহাপুরুষ’-এ অভিনীত প্রতিটি চরিত্রই ভিন্ন শ্রেণির। যদি বিরিঞ্চিবাবা আর তাঁর চেলা কেবলরামকে ধরা যায় এক নম্বরে। এঁদের ঘিরেই ছবি আবর্তিত। ধর্ম বা আধ্যাত্মবাদ এই দু’জনের কাছে ব্যবসা বই আর কিছুই নয়। ঈশ্বরবিশ্বাসী লোকদের ঠকানোই বিরিঞ্চবাবা-কেবলরামের একমাত্র ব্যবসা। এদের জাদু বা সম্মোহনী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেন আইনজীবী গুরুপদ মিত্র। বিরিঞ্চিবাবার জাদুতে মোহিত তিনি। আরও কিছু বিশ্বাসী লোকজন তাকে ঘিরে ভিড় করে। আবার বিপরীত চিত্রও ধরা পড়ে। তারা হলো অবিশ্বাসীদের দলে। আবার দেখা যায়, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু অর্থ রোজগারে ব্যস্ত কেউ। আবার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ভুগছেন কেউ-কেউ। ঠিক এই গোত্রের নন অধ্যাপক-বিজ্ঞানী ননী। একেবারে অন্যরকম একটি চরিত্র। এমন ধরনের একটি ভূমিকায় প্রথম এবং শেষ দেখা যায় সন্তোষ দত্তকে।
একইসঙ্গে যোগ করলাম জটায়ু চরিত্রটি। সন্তোষ দত্তের মৃত্যুর পর সত্যজিৎ আর ফেলুদার কাহিনি নিয়ে ছবিই করলেন না। অবশ্য তিনি ঘোষণাও করেছিলেন আর ফেলুদা করবেন না। এই প্রসঙ্গে সন্দীপ বলেন, “মনে আছে বাবা বলেছিলেন, এখন তো আর ফেলুদা করলে জটায়ু ছাড়া করা যাবে না। আর সন্তোষ যখন নেই তখন তো তার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”
পরের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রথম প্রকাশ: জাগ্রত বিবেক, জুন ২০২৫
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





