Flashback

অতি উত্তম! এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি

বাল্মীকি চট্টোপাধ্যায়: কালো প্রিয়দর্শীনি ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে রিসিভার তুলে সুপ্রিয়া দেবী বললেন, “হ্যালো।”

ওপার থেকে ভেসে এল জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর, “কে, বেণু?”

“হ্যাঁ, বলছি।”

“মানিকদা বলছি।”

“হ্যাঁ মানিকদা, বলুন?”

“উত্তম আছে নাকি?”

“না। মানে, ও তো এখনও ফেরেনি। শুটিংয়ে আছে।”

“এলে বোলো, আমাকে একটা টেলিফোন করতে।”

“আচ্ছা মানিকদা।”

ঘণ্টাখানেক পর ফিরলেন উত্তমকুমার (Uttam Kumar)। বেণুদি মানে সুপ্রিয়া বললেন সব কথা। উত্তম সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করলেন। সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) বললেন, “কাল ‘নায়ক’-এর ফার্স্ট শো। ইন্দিরা হলে। চারটের আগে চলে এস।”

উত্তমকুমার আমতা-আমতা করে বললেন, “মানিকদা, আমার যাওয়াটা কি ঠিক হবে? বোঝেন তো! আমি গেলেই…”

কথার মাঝেই সত্যজিৎ বললেন, “উত্তম, এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি। ঠিক সময়ে চলে এস।” ফোন রেখে দিলেন সত্যজিৎ।

আরও পড়ুন: ‘এক ফিল্ম হিরোর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি’

মুখখানা থমথমে হয়ে গেল উত্তমের। অবাক সুপ্রিয়া। জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হল!”

উত্তমকুমার বললেন, “মানিকদা বুঝতে চাইছেন না যে আমি গেলে কী সমস্যা হয়!”

পরেরদিন।

হাজরা মোড় থেকে গাড়ি ডানদিকে ঘুরতেই দেখা গেল, সহস্র কালো-কালো মাথা। কেমন করে যেন খবর হয়ে গিয়েছে, গুরু আসছে। উত্তমকুমার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হয়তো এক চিলতে হাসিও চলকে পড়ল গাল বেয়ে! উত্তমকুমারের চিরসঙ্গী ড্রাইভার ন্যাপা। উত্তম বললেন, “হ্যাঁ রে ন্যাপা, কী করবি?”

ন্যাপা বললেন, “আর কিছু করার নেই, দাদা। গাড়ি ঘোরানো যাবে না।”

অগত্যা জনসমুদ্র ঠেলে গাড়ি এগিয়ে চলল। ঘনঘন আছড়ে পড়ছে ঢেউ। গুরু-গুরু!

আরও পড়ুন: অনন্য মায়াময় ফ্রেম তৈরি করে ‘ডিয়ার মা’

পাঁচ মিনিটের রাস্তা এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। গাড়ি ইন্দিরা সিনেমা হলের সামনে এসে পৌছল। ধাক্কাধাক্কি চেঁচামেচি। গাড়ির দরজা খোলাই দায়। তখনকার দিনে সিকিউরিটি, পার্সোনাল বডিগার্ড, এসবের বালাই ছিল না। খানকতক পুলিশের লাঠি হাতে বাঁশি বাজানো বৃথাই গেল। কোনওমতে উত্তমকুমার আর সুপ্রিয়া নামলেন। মুহূর্তে ঢুকে পড়লেন হলে। বাইরের লোহার দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

হল কানায়-কানায় পূর্ণ। উত্তম ঢুকতেই বাইরের ঢেউ আছড়ে পড়ল ভিতরে। গুরু-গুরু-গুরু শব্দব্রহ্ম।

পর্দা উঠল। ছবি শুরু হল। টাইটেলে উত্তমকুমার নাম পড়তেই গুরুধ্বনি প্রলয়রূপ ধারণ করল। কান পাতা দায়। হলের সিট বুঝি ভেঙেই পড়ে। জনতার দাবি, গুরুকে দেখতে চাই। বাধ্য হয়ে প্রোজেকশন বন্ধ করতে হল। হলের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হল। স্টেজে মাইক লাগানো হল। উত্তাল উদ্দাম শব্দস্রোতে ভাসতে-ভাসতে উত্তমকুমার স্টেজে উঠলেন। দর্শক পাগলপারা। বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস, গুরু-গুরু-গুরু!

আরও পড়ুন: ভয়ের ছবিতে তনুশ্রী, দেবরাজ

হলের ভিতরের সেই আওয়াজ যেন প্রবাহিত হল বাইরে। কয়েক হাজার ভক্ত চিৎকার করে উঠল, গুরু-গুরু-গুরু!

স্টেজে উত্তমকুমার। হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে অনুরোধ করলেন। বেশ খানিকক্ষণ পর দর্শক শান্ত হল। উত্তমকুমার বললেন, “আপনারা বসুন। ধৈর্য ধরে বসুন। এই ছবিতে আমি অভিনয় করেছি বটে। তবে মনে রাখবেন, এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি।”

প্রবল চিৎকার, হাততালি। নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছু পরে ছবি শুরু হল।

হাফটাইমের একটু আগে হলের মালিক ছুটে এলেন। সত্যজিৎকে কী যেন বলে তারপর উত্তমের কাছে এসে বললেন, “আপনি শিগগির উঠে পড়ুন। হাজার-হাজার লোক ভিড় করেছে। দেওয়াল বেয়ে ব্যালকনিতে উঠে পড়েছে। এবার হল বুঝি ভেঙে পড়ে!”

আরও পড়ুন: ছবিতে গল্প থাকতেই হবে

উত্তম-সুপ্রিয়া বাইরে এসে দেখলেন এক জনমহাসমুদ্র ও তার প্রলয়ংকর প্রাণোচ্ছ্বাস।

কোথায় তাঁর গাড়ি, কোথায় শ্রীমান ন্যাপা। হলের দরজা খুলে বেরনো অসম্ভব। কিন্তু এখানে এভাবে থাকা বিপজ্জনক। যে করেই হোক বেরোতেই হবে! তখনই দেবদূতের মতো হাজির হলেন এক ভদ্রলোক। উত্তমকুমারকে আস্বস্ত করে বেরিয়ে গেলেন। কিছু পরে কীভাবে যেন একটা ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হলেন হলের সামনে। উত্তম-সুপ্রিয়া বেরোলেন। কয়েক সহস্র ভক্ত আছড়ে পড়ল তাঁর পায়ে। ধাক্কাধাক্কি, টানা হ্যাঁচড়ার পর কোনওমতে ট্যাক্সিতে উঠলেন ওঁরা।

গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়তে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সবাই। উত্তমকুমার বললেন, “সোজা গ্র্যান্ড হোটেল চলো।”

গাড়ি ছুটল ধর্মতলার দিকে।

আর পড়ুন: ‘এতগুলো মালয়ালম ছবি করার পর ভাষাটা রপ্ত হয়ে গিয়েছে’

আর তখনই দেখলেন, উত্তমকুমারের কোটের একটা হাত নেই। সুপ্রিয়ার শাড়ির আঁচল ফালাফালা। আতঙ্কিত উত্তমকুমার, “কী হবে! একটা হাত নিয়ে গ্র্যান্ড হোটেলে ঢুকব কী করে! আর তুমিই বা ছেঁড়া শাড়ি পরে…”

হেসে উপায় বাতলালেন সুপ্রিয়া। খানিক পর ট্যাক্সি ঢুকল হোটেলের গাড়ি বারান্দায়। চোখে কালো চশমা, হাতে ভাঁজ করা কোট, নামলেন উত্তমকুমার। পিছনে আঁচলে মুখ ঢাকা দিয়ে উত্তমের সাধনসঙ্গিনী সুপ্রিয়া।

উত্তমকুমার আর সেই ভদ্রলোক চলে গেলেন পুল সাইডে। সুপ্রিয়া ঢুকলেন ওয়াশরুমে। শাড়িটা উল্টো করে পরে নিলেন।

চিয়ার্স! খোলা হল শ্যাম্পেনের বোতল। এক চুমুক দিয়ে ওই ভদ্রলোক বললেন, “উফ বাবা, কী গেল! আপনার ছবি মানেই…”

থামিয়ে দিলেন উত্তমকুমার, “আমার নয়। এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি।”


Edited and Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *