Flashback

লোডশেডিং রেশনিং করার দাবি সত্যজিৎ, উত্তম, সৌমিত্রদের (পর্ব ১)

প্রায় প্রতিদিনই প্রতিটি ছবির বাড়তি দিন শুটিং করতে হচ্ছিল সেই সময়। বিদ্যুৎ ঘাটতির কবলে পড়েছিল বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করেছিল স্টুডিয়ো পাড়ার এক প্রতিনিধি দল। প্রতিবেদন লিখেছিলেন স্বপনকুমার ঘোষWBFJA-এর পাতায় রইল সেই প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব

বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের আকার বৃহৎ শিল্পেরই অনুরূপ। কলেবর যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনই বেড়েছে তার জটিলতা। তবে বর্তমান জটিলতা বিদ্যুৎ সঙ্কট নিয়ে। এই তীব্র সঙ্কটে কেউ নিশ্চিন্ত নন। বিশেষ করে যেখানে কয়েক হাজার লোকের রুজি-রোজগারের প্রশ্ন জড়িত। এক একদিনের বাড়তি শুটিং মানেই প্রায় ₹১৪-১৫ হাজার অতিরিক্ত খরচ।

বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রের ওপর থেকে বক্স অফিস মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কারণ বহুবিধ। কখনও হিন্দি ছবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কখনও রঙিন ফিল্মের সঙ্গে দ্বন্দ্বে হার, আবার কখনও পরিচালনা, কাহিনি, চিত্রনাট্য, দুর্বল কলাকৌশলের জন্য বাংলা চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে পরিত্যক্ত। ক্ষতি কার? প্রযোজকের, পরিবেশকের, পরিচালকের, কলাকুশলীর, অভিনেতা-অভিনেত্রীর, এমনকী সরকারেরও। তবে সবথেকে কঠিন অবস্থা কলাকুশলীদের। বিশেষ করে যাঁরা দৈনিক অর্থের হিসেবে কাজ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথা সহজবোধ্য, বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প আজ শরশয্যায় শায়িত।

এর ওপর বাড়তি বোঝা চেপেছে বিদ্যুৎ ঘাটতি। পশ্চিমবঙ্গে কয়েক বছর ধরেই বিদ্যুৎ সঙ্কট চলছে। এই সঙ্কট চলচ্চিত্র শিল্পকে কী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। লোডশেডিংয়ের জন্য অনেক বেশি দিন শুটিং করতে হচ্ছে। আগে যেখানে তিনদিন লাগত এখন সেখানে পাঁচদিন লাগছে। এর জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে প্রচুর। সম্প্রতি ‘সন্ধি’ ও ‘দেবদাস’ ছবি দু’টিকে লোডশেডিংয়ের প্রকোপে পড়তে হয়েছে। দু’টি ছবিই তৈরি হচ্ছে ইস্টম্যান কালারে। এর জন্য পরিচালকেরা ইদানিং কম ঝুঁকি নিয়ে আউটডোরে শুটিং করছেন। ফলে টালিগঞ্জের স্টুডিয়োগুলোর অবস্থা আরও সঙ্কটাপন্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাছাড়া অর্থাভাবে স্টুডিয়ো কর্তৃপক্ষ নতুন যন্ত্রপাতি আনাতে পারছেন না। এমনকী মেরামতও করাতে পারছেন না। তার ওপর পরিচালকেরা যদি আউটডোরে শুটিং করতে থাকেন তবে স্টুডিয়োগুলো অদূর ভবিষ্যতে গুদামঘরে পরিণত হতে পারে।

ছবির শুটিং শেষ হলেও নিশ্চিন্ত হবার জো নেই। ল্যাবরেটরিতে কাজ চলাকালীন হঠাৎ করে লোডশেডিং শুট হয়ে যাওয়া ফিল্মের ক্ষতি করছে। এর ক্ষতিপুরণ করার সাধ্য থাকে না বহু প্রযোজকের। যেমন হয়েছে ‘নদী থেকে সাগরে’ ছবির ক্ষেত্রে। প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ক্ষতিগ্রস্থ ফিল্ম দেখছেন।

অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও বিপদে পড়েছেন। মেকআপ করে কয়েকটা শট দিয়ে লোডশেডিং হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে। মেকআপ তুলতে পারছেন না। কারণ যখন-তখন আলো এসে যেতে পারে। আবার চলেও যেতে পারে। সকাল থেকে একটা শট টেক করা না হলেও তাঁদের মেকআপ নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে আলোর প্রতীক্ষায়। দীর্ঘ সময় ধরে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এতে পরিচালকদের মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করা সম্ভব নয়। তাঁদের সবসময় ভাবতে হচ্ছে নির্ধারিত দিনে শুটিং শেষ না হলে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছ থেকে কীভাবে বাড়তি ডেট পাওয়া যাবে?

এইসব চিন্তা থেকে নিশ্চয়তার সন্ধানে আসাম ও ওড়িশার অনেক প্রযোজক যাঁরা কলকাতায় এসে শুটিং করতেন, ল্যাবরেটরিতে প্রসেস করতেন, তাঁরা পাড়ি দিয়েছেন মাদ্রাজ (চেন্নাই) বা বম্বেতে (মুম্বই)। এতে এখানকার স্টুডিয়োগুলোর আর্থিক ক্ষতি যে কতদূর পৌঁছবে তার সঠিক হিসেব করা এখনই সম্ভব নয়। সুতরাং বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প যে এক বিরাট বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এই শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বার আগেই কিছু করা প্রয়োজন।

৭ আগস্টের সন্ধ্যা। বেশ কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক ও কলাকুশলী জমায়েত হয়েছিলেন টেকনিশিয়ন্স স্টুডিয়ো প্রাঙ্গণে। স্লোগানহীন, পোস্টারহীন, ব্যানারহীন জমায়েত। চোখেমুখে রুজি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কীভাবে লোডশেডিংয়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়, তাই নিয়ে সভা। কীভাবে বাঁচানো যায় এই বৃহদায়তন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে? সভার আহ্বায়ক ছিলেন সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray), উত্তমকুমার (Utttam Kumar) ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee)। সভা যেমন হয়, ঠিক তেমন নয়। সেরকমভাবে কেউ ভাষণ দিলেন না। এমনকী সভাপতি হিসেবে উপস্থিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও একটি কথা বললেন না। বেশিরভাগটাই বললেন সত্যজিৎ ও উত্তম। তিনি জানালেন, “আমি জ্যোতিবাবুকে ফোন করেছিলাম। উনি দিল্লি যাচ্ছেন। আমাকে ৯ তারিখে যোগাযোগ করতে বলেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে দু’টো প্রস্তাব ওঁকে দিতে চাই। এক, দূরদর্শনকে যেমন লোডশেডিংয়ের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তেমনই টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়াকেও বাদ দেওয়া হোক। আর না হয় সপ্তাহের নির্দিষ্ট চারদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা স্টুডিয়োগুলোকে লোডশেডিং থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।”

Satyajit Ray

সভায় বাঁদিক থেকে সৌমিত্র, উত্তমকুমার, হেমন্ত, দিলীপ রায় ও সত্যজিৎ

দুটো প্রস্তাবই সুচিন্তিত। লোডশেডিংয়ের ব্যাপারে রেশনিং করে দেওয়া হলে চিন্তামুক্ত হয়ে কাজ করা যাবে। প্রয়োজনবোধে রাতেও শুটিং করা যেতে পারে। আগে অবশ্য কিছুদিনের জন্য এরকম ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। তাছাড়া স্টুডিয়োগুলোকে লোডশেডিংয়ের আওতা থেকে বাইরে রাখতে পারলে তো কোনও সমস্যাই থাকে না। এর জন্য প্রস্তাবিত দূরদর্শনের সঙ্গে স্টুডিয়োগুলোর বিদ্যুৎ কানেকশন করে দেওয়া চলে। কিন্তু কানেকশন করতে খরচ পড়বে ₹৫-৬ লক্ষ টাকা। এত টাকা দেবে কে? স্টুডিয়োগুলোর সেই আর্থিক ক্ষমতা নেই। সরকার কি দেবে?

সভায় জনৈক পরিচালক বলেন, “জেনারেটরে কাজ হবে না। বড় শব্দ হবে। ফ্রিকোয়েন্সি ড্রপ করবে। জেনারেটর স্টুডিয়োর কাজে অচল, কারখানায় চলতে পারে।”

তবু হয়তো জেনারেটরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সম্প্রতি পরিচালক পূর্ণেন্দু পত্রী (Purnendu Pattrea) তাঁর ‘মালঞ্চ’ ছবির ইন্ডোর শুটিং শুরু করেছেন টেকনিশিয়ন্স স্টুডিয়োতে জেনারেটর নিয়ে। প্রমাণ করেছেন, জেনারেটর নিয়ে শুটিং করা যায়। এতে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমবে বলে মনে করেন তিনি।

সভায় উপস্থিত প্রায় সকলেই কিছু আবেদন জানান।

দিলীপ সরকার (প্রযোজক এবং নিউ থিয়েটার্স এক নম্বর স্টুডিয়োর অন্যতম কর্ণধার): রাজ্য সরকার স্টুডিয়োর যন্ত্রপাতি কেনার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ রেখেছেন সেই টাকা থেকে যদি প্রত্যেক স্টুডিয়ো একটা করে জেনারেটর কেনার ব্যবস্থা হয় তাহলে অনেকটা উপকার হয়।

উত্তমকুমার: কখন লোডশেডিং হবে তা আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হোক, অর্থাৎ রেশনিং হোক।

সৌমিত্র: লোডশেডিংয়ের আওতা থেকে স্টুডিয়োগুলোকে বাদ দেওয়া হোক।

মাধবী চক্রবর্তী: কী আর নতুন বলব! সময় বেঁধে দেওয়া হোক।

পূর্ণেন্দু: জেনারেটর নিয়ে কাজ করলেও সংকট অনেকটা কাটবে।

কৃষ্ণ চক্রবর্তী (চিত্রশিল্পী): জেনারেটর নিয়ে কাজ করতে অসুবিধা হবে ঠিকই। তবে উপস্থিত সঙ্কট কিছুটা কাটবে যদি সরকার প্রত্যেক স্টুডিয়োতে জেনারেটর বসানোর ব্যবস্থা করে।

সুনীতি মিত্র (শিল্প নির্দেশক): রাতে সেট তৈরির জন্য অন্তত ক’ঘণ্টা আলো চাই। তা না হলে কাজ করা যায় না।

সুবোধ রায় (সম্পাদক): একমাসের এডিটিং শিডিউল তিনমাসে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুটিং শেষ করেও শান্তি নেই। ল্যাবরেটরিতে ফিল্ম প্রসেসিংয়ে থাকলে আরও ভয়ের ব্যাপার। যখন-তখন লোডশেডিং ফিল্মের ক্ষতি করে। এভাবে কাজ চলতে পারে না। অবিলম্বে লোডশেডিংয়ের রেশনিং হওয়া দরকার।

শ্যামল চক্রবর্তী (সহকারী পরিচালক): সরকার যদি লোডশেডিংয়ের সময় বেধে দেয় তাহলে যদি দরকার হয় আমরা সারারাত শুটিং করতে পারি। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোর জন্য প্রতীক্ষা করার থেকে তা অনেক ভালো।

পরের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

প্রথম প্রকাশ: আনন্দলোক, সেপ্টেম্বর ১৯৭৮


Edited by Balmiki Chatterjee
Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *