আর্ট ফিল্ম মানে শুধুই যৌনতার ছড়াছড়ি, ক্ষুব্ধ ঋত্বিক
স্টুডিয়ো সংবাদদাতা: ঋত্বিক ঘটক (Ritwik Ghatak) নতুন ছবি শুরু করছেন, এ সংবাদেই কাঁপন। তাঁর প্রতিটা ছবিই আলোড়ন তোলে। অবশ্য এখন যে ছবিটা করছেন তা পুরোমাত্রায় ডকুমেন্টারি। তবে ছবির রাজ্যে ঋত্বিক ফিরে এসেছেন, এটাই বড় খবর! এ বিষয়ে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন সুশীল করণ।
ঋত্বিকের সঙ্গে এর আগে এমন পরিবেশে এত খোলাখুলিভাবে ছবি করা নিয়ে কোনও কথাবার্তা হয়নি বললেই চলে। শান্তভাবে চিন্তাভাবনা করে বেশ ঋজু ভাষায় ঋত্বিক তাঁর বক্তব্য রাখছিলেন। বিতর্কিত কিছু প্রসঙ্গও উঠল। যেমন, যে ইংমার বার্গম্যান আজকের দিনে অন্যতম সেরা পরিচালক হিসাবে স্বীকৃত, ঋত্বিক তাঁর মধ্যে পলায়নী মনোবৃত্তির পরিচয় পান। বার্গম্যানের ছবি “উদ্দেশ্যহীন” বলে মনে করেন তিনি। আবার ফ্রান্সের জাঁ লু গোদার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলেও একই উত্তর দেন তিনি।
আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
গোটা ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে আর্ট ফিল্ম, পরীক্ষমূলক ছবি, এমন নাম করে যে সব কাণ্ডকারখানা চলছে সে সম্পর্কে ঋত্বিক দ্বিধাহীনভাবে বললেন, “ও সব আর কিছু নয়, এসকেপিজ়ম। আর্টের নামে শুধু যৌনতারই ছড়াছড়ি। শিল্প তো মানুষের মনের কথা মানুষের মনের মতো করেই বলবে। তা নয়। এ বৃথা জটিলতা কেন? এটা নেহাতই অজুহাত। শিল্পের প্রধান কথা বক্তব্যনিষ্ঠ হওয়া। আদর্শনিষ্ঠ হওয়া পরের কথা। বক্তব্যনিষ্ঠ হতে গেলেই দৃঢ়বিশ্বাসের ওপর পা থাকা চাই। তা না হলে কিছুই সম্ভব নয়। নিরালম্ব শূন্যতার মধ্যে কোনওকিছু সৃষ্টি হতে পারে না নিশ্চয়ই।”
ঋত্বিক এই শেষ কথাগুলোর ওপর ওপরই জোর দিলেন বেশি। যাঁরা শিল্পী, রসিক, তাঁদের কাছে এ কথা নতুন নয়। কিন্তু বিশ্বাস ও বক্তব্যের মধ্যে ফারাক আছে জনে-জনে। এ দেশে, বিদেশে, দু’জায়গাতেই। ফেদেরিকো ফেলিনি বলেছেন যে কোনও পরিচালক সারাজীবনে একখানা ছবিই মনের মতো করে করতে পারেন। ঋত্বিক এ ব্যাপারে ঐক্যমত। হয়তো কারও সবক’টা ছবিই যথেষ্ট রসমাত্রা ছাপিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু মনের মতো ছবি হতে বাধা কোথায়? বড়জোর ছোটখাট ত্রুটি থাকতে পারে।
আরও পড়ুন: ‘এক ফিল্ম হিরোর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি’
এসব ত্রুটি নিয়েই তাঁর ভালো লাগে মাইকেলেঞ্জলো আন্তনিওনি, রোমান পোলানস্কি, আন্দ্রে ওয়াইদা, ফেলিনিকে। আর সবথেকে বেশি ভালো লাগে লুই বুনুয়েলকে। ঋত্বিকের মতে বুনুয়েলের ছবির “প্রতিটা ফ্রেমই যথেষ্ট অর্থপূর্ণ ও ইঙ্গিতময়।” তাই একমাত্র বুনুয়েলকেই খুব কাছের করে নিতে চান তিনি। নিজের মনের কিছু ছায়া তিনি একমাত্র ওঁর মধ্যেই দেখতে পান।
আসল ব্যাপার হলো ঋত্বিকের মধ্যে এত কথা, এত ব্যথা লুকিয়ে আছে যে তাঁর যেন বলার ভাষা হারিয়ে গিয়েছে। ছবির মধ্য দিয়ে, যন্ত্রিক ক্যামেরা দিয়ে তিনি কিছু দেখাতে চান, বলতে চান। সেই ক্যামেরার ভাষাকে তিনি খুঁজছেন।
আরও পড়ুন: পরিবেশ-রাজনীতির এক মায়াবী ইস্তাহার
বললেন, “একটা ভাষা, যেটা কম বলবে, বেশি ফেনাবে না। কচকচ করবে না। যে স্বয়ং প্রকাশ, যার অ্যালুশনের ভার নেই, পরিপূর্ণতা যার আছে, যে প্রেফারেন্স চিহ্নিত করে না, মনে করিয়ে দেয়, কারণ যেগুলো আর্কিটাইপাল, যে ভাষা অসম্ভব ক্ষমতাশালী, সব মুডকে একটা প্যাট্রিয়াকাল ভঙ্গীতে ধরিয়ে দেবে। যা আপাত শুষ্ক, ফল্গুর মতো, মালদার আমের মতো একেবারে রসে টইটম্বুর। এ ভাষাটা কিন্তু আছে, তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। ছবিতে ওই ভাষাতে কথা বলা যায়। ইউরোপ পারবে না এ যুগে। আমরা পারব, যদি খুঁজি। এটুকু বুঝি এ ভাষা জন্মাতে পারে শুভ্র উত্তাপময় প্রেরণা থেকে। যে প্রেরণা মনে হয় পেশাদারি ছবি করিয়েদের দিয়ে হবে না। আমাদের দেশের পেশাদারি মানে, যারা একটার পর একটা ছবি করেই যাচ্ছে। এ ভাষা বোধহয় জন্মায় যে রোজ করে না তার চেতনায়। জীবনে খুব দরকার না পড়লে সে মুখ খোলে না। এবং যে মুখ খোলে একমাত্র জীবনমরণ সমস্যার চাপে পড়ে। খুব খানিকটা না রাগলে, ভালো না বাসলে, খুব খুশি না হলে, খুব না কাঁদলে, এ আদিম মিষ্টি ভাষা কোত্থেকে জুটবে? আমি সেই দুরাশা করেছি। সেই ভাষাটাকে ধরার জন্য প্রাণপাত করে যাব।”
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, ফাল্গুন ১৩৭৬
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





