অনীহা ছেড়ে পথে নামলেন সত্যজিৎ রায়
স্টুডিয়ো সংবাদদাতা: শোনা যায়, ফ্রান্সে যখন সিনেমা ভেরিৎ স্টাইলের জোয়ার এসেছিল, তখন রাঘববোয়াল থেকে চুনোপুঁটি সব পরিচালকই ক্যামেরা বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়েছিলেন রাস্তাঘাটে, হাটেবাজারে। পাঁচশো-দু’শো-রেঞ্জ-ফিল্টার-টিল্টআপ-টিল্টডাউন বা প্যান, এসবের বালাই ছিল না। প্রকৃতির আলোয়, বৃষ্টিতে ভিজে, রাতের অন্ধকারে তাঁরা ছবি তুলেছেন। সেরকম দু’-চারটে ছবি এ দেশেও দেখানো হয়েছে। চরিত্রের পেছনে ক্যামেরা কীভাবে ছুটে চলেছে, প্রতিটি ভঙ্গীকে নিখুঁতভাবে ধরে রেখেছে সে সব ছবি। চলমান চরিত্রের সঙ্গে ক্যামেরাও চলতে শুরু করায় নতুন প্রাণ এসেছে যেন। ক্ল অঁরি শাব্রল যাকে ক্যামেরা স্টাইলো বলেছেন, তার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় ওদের দেশের ছবিতেই। ক্যামেরা স্টাইলো ব্যাপারটা আসলে যে কী, কীভাবে তাকে কাজে লাগানো হয় বা যায়, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিশেষ কিছু হয়নি। যা হয়েছে তা স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে, কাহিনিচিত্রে নয়।
‘ছিন্নমূল’ ছবিতে পরিচালক নিমাই ঘোষ ক্যামেরাকে চার দেওয়ালের বাইরে এনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ক্যামেরাকে দিয়ে কথা বলাতে পারেননি, যন্ত্রটাকে ফটোগ্রাফির কাজেই ব্যবহার করেছিলেন। সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) প্রথম ক্যামেরা দিয়ে ছবি আঁকলেন, কথা কওয়ালেন। কিন্তু ক্যামেরা স্টাইলো কি তাই? সত্যজিৎবাবু প্রায় সব ছবিতেই ক্যামেরাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। ‘মহানগর’-এর শুটিংয়ের সময়ও সময়েও রিফ্লেকটর, আলোকপাতের আরও কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তবে ক্যামেরাকে বগলদাবা করে বেরনো তাঁর হয়ে ওঠেনি। ফ্রেম কম্পোজ়িশন মেপে শুটিং করেছেন। কিন্তু চরিত্রকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তার পেছনে ক্যামেরা নিয়ে দৌড়লে পর্দায় যে ইম্প্রেশন আসে তা নিশ্চয়ই মাপা চলাফেরার থেকে স্বতন্ত্র।
আরও পড়ুন: ‘কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করে না, কি রে খেয়েছিস?’
সত্যজিৎবাবু এবার সে পথেই নেমে এসেছেন। ‘প্রতিদ্বন্দী’ ছবির জন্য রেস্তোরাঁয়, বাসে, দোকানে তিনি নায়ককে (ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়) ছেড়ে দিয়েছেন, লুকনো ক্যামেরা দিয়ে দিনদুপুরে টাইগারের সামনে ছবি তুলেছেন। বিটলদের আড্ডায় গিয়ে গোপনে ক্যামেরা চালিয়েছেন। অর্থাৎ সত্যজিৎবাবু যথার্থ চরিত্রের পেছনে ছোটাছুটি শরু করেছেন। চরিত্র সত্যজিৎবাবুর কথা শুনছে ঠিকই, কিন্তু অভিনেতাও এবার চুপচাপ গুড বয় সেজে পুতুল হননি। তুলি নিয়ে ক্যানভাসের চারদিকে রং ছিটিয়ে চলেছেন শিল্পী। কী অপরূপ সৃষ্টি হয় কে জানে!
কিছুদিন আগে পর্যন্তও শহর কলকাতায় শুটিং করার ব্যাপারে সত্যজিৎবাবুর প্রচণ্ড অনীহা ছিল। নামীদামী স্টার নিয়ে রাস্তাঘাটে বেরনোই মুস্কিল। শুটিং করা তো দূরের কথা। অনীহার কারণ অবশ্য তাই। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির কাজের সময়ও রাঁচির অনেক ভেতরে গ্রামস্য গ্রাম ছিপাদোহেরে কাজ করতে গিয়েও তাঁকে বহু অসুবিধার সামনে পড়তে হয়েছিল। ‘প্রতিদ্বন্দী’র ক্ষেত্রে যে সে অসুবিধা তিনি একবারে এড়াতে পেরেছেন তা নয়। যেখানে একটু বেশীক্ষণ দৃশ্যগ্রহণের কাজ করতে হয়েছে সেখানেই ভিড় জমেছে। তবে পরিচিত অভিনেতা কেউ না থাকায় ক্যামেরায় বা বাসের মধ্য থেকে যখন শট নিয়েছেন, তখন তো আলাদা কথা!
আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
সত্যজিৎবাবু কিছুদিন আগে দিঘা গিয়েছিলেন। সেখানেও প্রায় নির্বিঘ্নেই কাজ হয়েছে। এখন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে একটানা কাজ করে চলেছেন। আউটডোরের মতো ফ্রি শুটিংয়ের নিয়ম ফ্লোরেও চলছে।
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির শিল্পীরা প্রায় সবাই নতুন। নায়ক ধৃতিমানের নাটক করার একটু আধটু অভ্যাস থাকলেও সিনেমায় মুখ দেখানো এই প্রথম। ভদ্রলোক ইকনমিকসে এমএ। কাজ করেন মেটালবক্সে। নায়িকা জয়শ্রী রায় কী কাজ করেন জানা নেই, তবে দু’বছর আগে এক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সেরা সুন্দরীর পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। ভাস্কর চৌধুরী ও কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় পুণা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পাশ করা অভিনেতা। ভাস্কর বম্বেতে (মুম্বই) একটা ছবিতে অল্প কাজ করেছিলেন, এ ছবিই তাঁর ব্রেক বলা যায়। তুলনায় কল্যাণ চট্টোপাধ্যয়ের অভিজ্ঞতা বেশী। তপন সিংহের ‘আপনজন’, ‘সাগিনা মাহাতো’, অরুন্ধতী দেবীর ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি জনপ্রিয় অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের ভাইপো। আরেকটি প্রধান চরিত্রে আছেন নতুন মুখ কৃষ্ণা রায়।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, বৈশাখ ১৩৭৭
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





