সপ্তডিঙা হারিয়ে বাড়ি ফিরলেন চাঁদ সওদাগর
অভি ভট্টাচার্য (Abhi Bhattacharya) ও সুব্রতা চট্টোপাধ্যায় (Subrata Chatterjee) অভিনীত ছবি ‘বেহুলা লখীন্দর’ (Behula Lakhindar) মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৭ সালে। ঝাড়গ্রামে সেই ছবির আউটডোরে উপস্থিত ছিলেন নির্মল ধর। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই প্রতিবেদেনের পুনর্মুদ্রণ
ক্যামেরাম্যান সত্য রায় কেয়ারিকরা ফুলের বাগানের বাঁদিকে ক্যামেরা বসিয়ে রাজবাড়িটাকে কম্পোজ়িশনে আনছিলেন। ফোরগ্রাউন্ডে বাগানের সাজেশন হিসাবে দু’-চারটে গাছের ডাল বা ফুলের দরকার। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। কী করা যায়?
হঠাৎ প্রোডাকশনের প্রদীপ নস্কর এসে বলল, “দাঁড়ান, ব্যবস্থা করছি।”
একটা বড় টুল নিয়ে এসে পাতাবাহার গাছটার দুটো নুয়েপড়া ডাল বেঁধে দিল প্রদীপ। পাতার ভারে ডাল দুটো নেমে এল। শুধু নামলই না একবারে ফ্রেমের মধ্যে ঢুকে গেল। সত্যবাবু ক্যামেরায় লুক থ্রু করে বললেন, “ফাইন।”
ওদিকে চাঁদ সওদাগরের পোশাক পরে অভি ভট্টাচার্য একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। পরবর্তী দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। সনকাবেশী প্রিয়া চট্টোপাধ্যায় তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে। বম্বে (মুম্বই) ফিল্মের আলোচনা চলছে দু’জনের মধ্যে।
আরও পড়ুন: উত্তমকুমারের পরিচালনায় প্রসেনজিৎ, হয়েছিল ফটোশুটও
হঠাৎ সামনের রাজবাড়ি থেকে দু’জন মহিলা এসে ঢিপ করে ওঁদের প্রণাম করলেন।
অপ্রস্তুত অভিদা বাধা দিয়ে বললেন, “আরে না-না, আমি আসল চাঁদ সওদাগর নই। সেজেছি।”
কে শোনে কার কথা! চাঁদ সওদাগরকে প্রণাম সেরে ওঁরা সনকার পদানত হলেন। এবার একেবারে সষ্টাঙ্গে। কাঁকড় বিছানো পথের ওপর তাঁরা যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন সাদা শাড়ি লালে লাল। প্রিয়া গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। হেসে ফেললেন।
আরও পড়ুন: ফের বাংলার সুরে শান্তনু মৈত্র
অথৈ জলে সপ্তডিঙা হারিয়ে রাজা প্রায় পাগলের বেশে যখন নিজের বাড়ির সিংহদরজায় হাজির হলেন, দ্বাররক্ষী তাঁকে ভেতরে যেতে দিতে চাইল না। উল্টে মারধর করল। ইতিমধ্যে ভেতরবাড়িতে রানিমা সনকার কাছে খবর গিয়েছে, কে একজন পাগল নিজেকে মহারাজ বলে পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইছে। ছুটে এলেন রানিমা, স্বচক্ষে সেই পাগলকে দেখতে। সিড়ির ওপর থেকে চারচক্ষুর মিলন হলো। সনকা আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। মুহূর্তেই তিনি চিনে ফেললেন নিজের স্বামীকে। এসে লুটিয়ে পড়লেন পায়ে।
এই দৃশ্যটা টেক করতে গিয়ে প্রিয়াকে তিন-তিনবার রিহার্সল দিতে হলো। আর প্রতিবারই আবেগের সঙ্গে ছুটে এসে লাল কাঁকুড়ে পথের ওপর স্পটে পড়ে যেতে লাগলেন। অভিদা কাছে দাঁড়িয়ে মজা দেখে গেলেন।
আরও পড়ুন: ‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
এবার টেকিং। সত্যবাবুর ক্যামেরা বাগানের মধ্যে। পরিচালক অমল দত্ত অভিদাকে ঠিকমত একসপ্রেশনটা হোল্ড করতে বললেন। ক্যামেরা চালু হলো। স্পটে সনকা এসে চাঁদ সওদাগরের পায়ে পড়লেন।
মহারাজ: হ্যাঁ, আজ আমি রিক্ত, নিঃস্ব, সর্বহারা। ছ’মাস পথে-পথে ঘুরে অনাহারে, অনিদ্রায় শেষ হয়ে গিয়েছি!
সনকা: আর এদিকে লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন লক্ষ্মী এসে তোমার ঘরে ধরা দিয়েছে।
মহারাজ: (বিস্ময়ের সুরে) লক্ষ্মী!
আরও পড়ুন: ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে আর ভাবছেন না সত্যজিৎ
পরিচালক লাঞ্চ ব্রেকের সময় জানালেন, লক্ষ্মী মানে চাঁদ সওদাগরের একমাত্র পুত্র সর্পভ্রষ্ট লখীন্দর মর্তে জন্ম নিল সনকার কোলে। পরের কাহিনি লখীন্দর-বেহুলা পর্ব।
এই ক’দিনের জন্য ঝাড়গ্রামের বিশাল রাজবাড়িটি রূপান্তরিত হয়েছিল চাঁদ সওদাগরের বাড়িতে। রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন জায়গায় শুটিং করলেন অমলবাবু। আমরা লোকেশনে পৌঁছবার আগের দিন তিনি দিঘার সমুদ্রতীরে চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙি ভেসে যাওয়ার দৃশ্যগ্রহণ করে এসেছেন। সাগর জলে ভাসতে-ভাসতে মহারাজ পাড়ে চলে এসেছেন। তাঁর অবসন্ন, ক্লান্ত, ভিজে দেহ বালি মাখানো অবস্থায় পড়ে আছে। শুনলাম, দারুণ নকি শট হয়েছে সেটি।
আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্কটে বাংলা ছবি, উদ্বিগ্ন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা
এই রাজবাড়িতে কাজ শেষ করে অমলবাবুর ইউনিট পাড়ি দেবে কোনও পাহাড়ি পথে। সেখানে লখীন্দর-বেহুলার কিছু শট আছে। আমরা থাকাকালীন কলকাতা থেকে লখীন্দর ও বেহুলা চরিত্রে রূপদানকারী দুই শিল্পী দেবাশিস মল্লিক ও মহুয়া রায়চৌধুরী, কেউই এসে পৌঁছননি। শুনলাম পরদিন পৌঁছবেন। বেহুলা-লখীন্দর এই ছবির প্রধান জুটি। চাঁদ সওদাগর অবশ্যই অন্যতম প্রধান। এবং সেই কারণেই বম্বেতে হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও অভিদা এই ছবিতে কাজ করার সময়টুকু বার করেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, এই বাঙালি অভিনেতাটিকে কেন টালিগঞ্জ এখনও তেমন করে ব্যবহার করছে না বোঝা দায়। অথচ ‘সুবর্ণরেখা’র পর তাঁর চাহিদা তো বাড়ার কথা ছিল! দেখা যাক এই ছবির পর তাঁর প্রতিভা যোগ্য স্বীকৃতি পায় কি না। অমলবাবুর এই রঙিন ছবিটি বাংলা সিনেমায় কোনও নতুন দিক আনতে পারবে কি?
উপরোক্ত শিল্পীরা ছাড়াও এই লোকেশন শুটিংয়ে অংশ নিলেন সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়, প্রদ্যোৎ চট্টোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, শান্তি পাল, নারায়ণ ভট্টাচার্য, গীতা নাগ ও প্রায় একশত স্থানীয় অধিবাসী। ‘বেহুলা লখীন্দর’ (Behula Lakhindar) ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করছেন সন্তোষ মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: ‘এখনকার ছবি শুক্রবারে আবিষ্কার, সোমবারে পরিষ্কার’
সবশেষে একটি খবর পেলাম। কয়েকদিন আগে নাকি রাজবাড়ির মহারাজ কলকাতায় পরলোগমন করেছেন। শোকাচ্ছন্ন এই রাজ পরিবার তবুও এঁদের কাজের কোনও বাধা সৃষ্টি করেননি। সহৃদয়তার সঙ্গে অনুমতি দিয়েছেন।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, অগ্রহায়ণ ১৩৮৩
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





