নিষিদ্ধপল্লীতে চোরবেশী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা রায় অভিনীত ছবি ‘সংসার সীমান্তে’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে। টালিগঞ্জে সেই ছবির সেটে উপস্থিত ছিলেন নির্মল ধর। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই প্রতিবেদনের পুনর্মুদ্রণ
নিষিদ্ধপল্লীতে বিরাট হৈ-চৈ। চোর…চোর। এক চোর ঢুকে পড়েছে। দেহোপজীবিনীরা তখন যে যার দরজায় দাঁড়িয়ে। অঘোর পেশায় চোর। সে অতর্কিতে ঢুকে পড়েছে এই পাড়ায়। না এসে উপায় ছিল না। যেমন একটা ঝড় আসে। দরজায় খিল পড়ে। রজনী তো অবাক। কই এমন খদ্দের তো সে জীবনে কখনও দেখেনি। লোকটা কী রে বাবা! ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে আছে কেন?
রজনীর আরও অবাক হওয়ার পালা। লোকেরা এই জাতীয় ঘরে ঢুকে যা-যা করতে চায়, কই সে তো কিছুই করছে ন! সে বড় ক্লান্ত, অবসন্ন। দেখলেই একটু-আধটু মায়া হয় বৈকি। তবুও রজনী হিসেব থেকে নড়ে না। পাওনা গণ্ডা বুঝে নিতে চায়। সেই চোর—অঘোর—রজনীকে চায় না। রজনীর সঙ্গও চায় না। তবু হিসেবটা কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দেয়। পাক্কা দু’টাকা।
আরও পড়ুন: ‘পচা দুর্গন্ধ ছড়ালে, প্রতিবেশীরাই এসে দাহ করবে’
অঘোর তক্তপোষের ওপর গা এলিয়ে দেয়। রজনী মেঝেতে শুয়ে থাকে কুঁকড়ে। ভোর হলে তার ঘুম ভাঙে। তাকিয়ে দেখে ঘরে আর কেউ নেই। মিনসে গেল কোথায়! শাড়িটা গোছাতে গিয়ে আঁচলের দিকে নজর পড়ে। কাটা! যেখানে টাকা দু’টি বাঁধা ছিল। অঘোর তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে কেটে পড়েছে। কেটে পড়ে সে মনে-মনে শান্তি পায়নি। ছিন্নভিন্ন হয়েছে তার মন। রজনীর মুখ, টুকরো-টুকরো কথা মনে পড়েছে। বড় বেশি করে তাকে নাড়া দিয়েছে। তাই একখানা শাড়ি হাতে সে গিয়েছে রজনীর কাছে। দেখামাত্র রজনী গর্জন করে উঠেছে। লোকজন জড়ো করেছে। ফলাফলে অঘোর বেচারা বেঘোরে প্রাণটা দিতে বসেছিল। ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় আশ্রয় পেয়েছিল সেই রজনীর ঘরেই।
ধীরে-ধীরে সেরে উঠল অঘোর। রজনীর সেবা, শুশ্রূষা এবং যত্নে সে এক নতুন অভিজ্ঞতার জগতে পৌঁছে গেল। সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। রজনীকে ছেড়ে সে আসতে পারে না। সমাজের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দু’টি প্রান্তিক মানুষ মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়। রঙিন স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের চারপাশে ওদের আবর্তন।
আরও পড়ুন: ‘কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করে না, কি রে খেয়েছিস?’
এরই মাঝে নিয়মিত থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। কারণ সে দাগী চোর। বেশ কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকার জন্য সে থানার বড়বাবুকে মিথ্যে অজুহাত দেখায়। শরীর খারাপ, পেট খারাপ, অনেককিছু খারাপ…বিশ্বাস করুন হুজুর…এইসব।
এই হলো ‘সংসার সীমান্তে’ (Sansar Seemantey)। বর্তমানে টেকনিশিয়ন্স স্টুডিয়োর ফ্লোরে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের বিখ্যাত গল্প অবলম্বনে, তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় শুটিং চলছে। থানার বড়বাবুর ঘর। অঘোরের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) সম্পূর্ণ নতুন রূপসজ্জায়। নতুন চরিত্রে। পরনে ময়লা জামাপ্যান্ট, গায়ে তেলচিটে চাদর, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, মাথায় উস্কোখুস্কো চুল…। বোধকরি এই প্রথম চোরের ভূমিকায়। চরিত্রের মন-মানসিকতা ধরা পড়ল উজ্জ্বল আলোয়, বিষণ্ণ ছায়ার মধ্যে। মাঝে-মাঝে চোখের মধ্যে উত্তাপ, নৈর্ব্যক্তিক যন্ত্রণার প্রকাশ। অত্যন্ত বিদগ্ধতার সঙ্গে তিনি নিজেকে পরিবেশন করছেন। জীবনতৃষ্ণা আর জীবন-যন্ত্রণার এমন অনুচ্চারিত মুখ কমই দেখা যায়। অন্তরঙ্গে অথবা বহিরঙ্গে সেই একই মুখ, অঘোর।
আরও পড়ুন: ‘এক ফিল্ম হিরোর কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি’
গল্পের বোঝা বয়ে বেড়ানোই আজকের সিনেমায় একমাত্র দায়দায়িত্ব নয়, তরুণবাবু সেটা বেশ ভালোই বোঝেন। সেই অনুযায়ী তিনি এই ছবিতে যে স্টাইল অফ ট্রিটমেন্ট ধরেছেন তা গল্পের মেজাজকে ধরবে। অর্থ-পরম্পরায় গোটা ছবির বক্তব্য উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আশা করা যায়।
প্রথম পর্যায়ের শুটিং এগিয়ে চলেছে। ‘রজনী’র ভূমিকায় রূপদান করছেন সন্ধ্যা রায় (Sandhya Roy)। অন্যান্য ভূমিকায় আছেন উৎপল দত্ত, শেখর চট্টোপাধ্যায়, সন্তু মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়, সুলতা চৌধুরী, শমিতা বিশ্বাস ও কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্রগ্রহণ করছেন কে রেজা। শিল্প নির্দেশনায় আছেন রবি চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, আশ্বিন ১৩৮১
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





