Flashback

বাক্স বদল সৌমিত্র-অপর্ণার

স্টুডিয়ো সংবাদদাতা: আপনি হয়তো বেড়াতে বেরিয়েছেন কোনও দূরপাল্লার ট্রেনে। একাই যাচ্ছেন। স্টেশনে এসে আপনার আত্মীয়স্বজন গাড়িতে তুলে দিয়েছে। গাড়ি ছাড়ার আগে অনেক উপদেশ আপনাকে শুনতে হয়েছে। আপনি সবই শুনছেন, কীভাবে জিনিসগুলোর ওপর নজর রাখতে হবে, অযাচিত উপকার থেকে কীভাবে সতর্ক থাকতে হবে। যেচে আলাপ জমাতে এলে কাউকে তেমন বিশ্বাস করা চলবে না। রাত্রের দিকেই চুরি বেশি হয়। এমনই অনেককিছু হুঁশিয়ারি তত্ত্বকথা। যদি প্রথমবার হয় তাহলে বেশি সতর্কতায় আপনি একটু নার্ভাস হয়ে পড়বেন। মনের মধ্যে একটু ভয়ও উঁকি দেবে। কিন্তু এরকম একা যদি বারকয়েক গিয়ে থাকেন তাহলে এসব হিতোপদেশ পানসে বলে মনে হবে। বরং পাশের কোনও অপরিচিতকেই আপনি ট্রেনযাত্রার সব সতর্কতা জানিয়ে নিজের অভিজ্ঞতাকে হালকা করবেন।

সেরকমই একা চলেছে অমিতা। সে কালিম্পং যাবে মামার কাছে। মামা হরবিলাসের অধ্যাপনা আর গবেষণা নিয়ে দিন যায়। মাঝেমধ্যে এই আত্মভোলা মামার কাছে এসে অমিতা কলেজ পরীক্ষার পর কয়েক মাসের জন্য বেড়িয়ে যায়। প্রথম শ্রেণীর কামরায় তেমন ভিড় নেই। জনাতিনেক যাত্রী হবে। তাদের মধ্যে একজন ভদ্র যুবক বই পড়তে-পড়তে চুপচাপ চলেছেন। ট্রেনে কোনও কথাই হয়নি। তাছাড়া গায়ে পড়ে আলাপ জমাবে, সে ধরণের মেয়ে অমিতা নয়। কলকাতায় সে কিন্তু খুব ছটফটে। কলেজে বা কোনও সংস্থার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অমিতা হলো নৃত্যে এবং সঙ্গীতে প্রথম শিল্পী।

আরও পড়ুন: সেরা ছবি ‘সীমাবদ্ধ’

অমিতাকে ভালোবাসে শোভনলাল। বড়লোকের ছেলে। ভালো চাকরি করে। গাড়ি-বাড়ি দুই আছে। এই তো আসবার আগে অমিতাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গিয়েছে শোভনলাল। অমিতার হাসি পায়। এমন বোকার মত মাঝে-মাঝে শোভন বিয়ের তাড়া দেয় যা অমিতার একেবারে ভালো লাগে না। এই তো বেশ ভালো। কেমন মুক্ত। এই যে একা-একা স্বাধীনমত নিয়ে চলেছে, বিয়ে করলে কি এমনটা করতে পারত? এক একসময় শোভনকে বড় অসহ্য মনে হয় অমিতার। বিয়ে করলেই যেন সব পাওয়া হয়ে গেল! তাই তো অমিতা চলে আসার সময় শোভনকে এই বিয়ের চিন্তাভাবনা দূর করার জন্য একজন ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলে এসেছে।

শিলিগুড়ি স্টেশনে এসে গাড়ি থেমেছে। এখানেই নামতে হবে। তারপর মটরযোগে কালিম্পং। জিনিসপত্তর বলতে শুধু বেডিং আর বাক্স। গোছানোই ছিল। হরবিলাস এসেছেন স্টেশনে। অমিতা তাড়াতাড়ি অন্যমনস্ক হয়ে জিনিসগুলো নিয়ে নেমে পড়েছে। মামাকে পেয়ে যেন সে হালকা হলো। বাড়িতে এসে জামাকাপড় ছাড়বে বলে বাক্স খুলে দেখে অবাক কাণ্ড! বাক্স বদল! পুরুষের বাক্স! শাড়ির বদলে ধুতি, ব্লাউজের বদলে শার্ট আর ভেতরের জামার বদলে গেঞ্জি। যতই দেখছে অমিতার মুখ ততই লাল হয়ে উঠছে। এ কী বেয়াদপি! লুঙ্গি আর দাড়ি কামাবার যন্ত্র সব ছড়ানো। যত্তসব পুরুষালি জিনিস। ভেতর থেকে একটা কার্ড বেরলো, তাতে লেখা ডঃ প্রতুল। মানসিক রোগের চিকিৎসক। কার্ডে কলকাতার ঠিকানা জ্বলজ্বল করছে। মাথায় হাত দিয়ে বিছানার ওপর বসে পড়ল অমিতা। এখন উপায়!

আরও পড়ুন: আর্ট ফিল্ম মানে শুধুই যৌনতার ছড়াছড়ি, ক্ষুব্ধ ঋত্বিক

ওদিকে প্রতুলেরও ঠিক একই অবস্থা। ধুতি, শার্ট, গেঞ্জির বদলে লাল-নীল শাড়ি, ব্লাউজ আর নতুন ফ্যাশনের মেয়েলি টুকিটাকি জিনিস। সেই সঙ্গে লিপস্টিক এবং ভ্যানিটি ব্যাগ। একটা ডায়েরি। রোজনামচার জীবন পরিক্রমা তাতে লেখা নাম অমিতা। কিন্তু ঠিকানা নেই। কেমন দেখতে কে জানে। ট্রেনে অবশ্য একজন মহিলাকে সে দেখেছে। ভাসা-ভাসা মনে পড়ছে।

ভ্রমণবিলাসী প্রতুলের আর আফসোসের সীমা নেই। বাধ্য হয়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হলো একই জামাকাপড়ে। অমিতাও ফিরে এসেছে বদলি বাক্স নিয়ে। প্রথমটা ভেবেছিল নিজেই গিয়ে দেখা করবে প্রতুলের সঙ্গে। কিন্তু ফিরে এসেই নৃত্যের মহড়ায় মেতে উঠল অমিতা। ‘মায়ার খেলা’য় তাকে নাচতে হবে। বাক্স বদলের ব্যাপারটা অমিতা একদম চেপেই গিয়েছে শোভনের কাছে। শুধু প্রতুলের ঠিকানাটা দিয়ে একবার মনোবিকারের চিকিৎসককে তার অসুখের কারণটা জেনে নিতে বলেছে।

আরও পড়ুন: জাতীয় সঙ্কটে বাংলা ছবি, উদ্বিগ্ন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা

প্রতুলের বোন রত্না দাদাকে ধরেছে ‘মায়ার খেলা’র টিকিট কাটতে। ও এ সংস্থার একজন সদস্য। অনুষ্ঠানের দিন প্রতুল ‘মায়ার খেলা’য় ট্রেনের সহযাত্রী এবং বাক্স বদলের মালিক অমিতাকে দেখে অবাক! তাছাড়া অমিতার নৃত্য দেখে সে আরও বেশি মুগ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন শুধু আলাপের সুযোগটুকু বাকি। বাড়িতে ফিরেই সে রত্নাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। কবে তাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান, মেয়েটি কে, কোথায় থাকে, কী করে, নানা প্রশ্ন।

এদিকে শোভনলাল ঠিকানা নিয়ে প্রতুলের চেম্বারে এসে চিকিৎসার পরামর্শ নিয়ে গিয়েছে। বিয়ে তাকে করতেই হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তা না হলে শোভনের এ অসুখ সেরে উঠবে না।  শোভনও সেই মতো সব কথা অমিতাকে জানায়। এসব শুনে অমিতা খুব রেগে যায় শোভনের ওপর।

আরও পড়ুন: ‘ছবি পরিচালনার জন্য এখনও প্রস্তুত নই’

অমিতা নিজেই একদিন প্রতুলের সঙ্গে দেখা করতে যায়। প্রথম আলাপেই অমিতার কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পায় প্রতুলের কাছে। ডায়েরিতে পড়া অমিতার চরিত্র, রুচি এবং অরুচি সম্পর্কে সবকিছু তথ্য প্রতুলের কন্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। কথায়-কথায় তাই অমিতার সেই সব পছন্দ রুচির সঙ্গে প্রতুলের টেস্ট মিলে যাওয়ায় সে যেন আরও নিকটতর হয়।

প্রতুলের কথামত রত্নাকে বেশ কিছুটা অভিনয় করতে হয় শোভনলালের সঙ্গে। তাই রত্নার সান্নিধ্যে শোভন প্রায়ই প্রতুলের কাছে আসে।

আরও পড়ুন: ‘এখনকার ছবি শুক্রবারে আবিষ্কার, সোমবারে পরিষ্কার’

শেষপর্যন্ত কাহিনি কীভাবে শেষ হবে তা আমাদের জানা নেই। বাক্স বদলের সঙ্গে আবার অমিতা-প্রতুলের মন বদলি হয়েছে কিনা তাও জানা নেই। শেষটুকু ছবিতেই দেখে নেবেন। আমরা শুধু বদলের আরম্ভটা জানিয়ে রাখলাম। চিত্রগ্রহণের কাজ এগিয়ে চলেছে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োতে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাক্স বদল’ (Baksa Badal) কাহিনি অবলম্বনে ছবি পরিচালনার ভার গ্রহণ করেছেন নিত্যানন্দ দত্ত। স্বাধীনভাবে এটাই তাঁর প্রথম ছবি। এর আগে প্রান্তিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ‘শেষ প্রহর’ ছবি পরিচালনা করে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের সহকারী হিসেবে নিত্যানন্দ চিত্রজগতে প্রথম প্রবেশ করেন।

‘বাক্স বদল’ অবলম্বনে এই মজার কাহিনি ছবির জন্য ভিন্ন নামকরণ করা হবে। এখনও সে নাম ঠিক হয়নি। ছবির প্রধান চরিত্র প্রতুল, অমিতা, শোভনলাল, হরবিলাস ও রত্নার ভূমিকায় অভিনয় করছেন যথাক্রমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, চারুপ্রকাশ ঘোষ এবং নবাগতা রেখা সরকার। শব্দযন্ত্রী দুর্গাদাস মিত্র এ ছবির প্রযোজক। চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা এবং শিল্প নির্দেশনার দায়িত্ব নিয়েছেন সৌমেন্দু রায়, দুলাল দত্ত ও বংশীচন্দ্র গুপ্ত।

সেপ্টেম্বরে এ ছবির বহিদৃশ্য কালিম্পংয়ে গৃহীত হবে।

প্রথম প্রকাশ: অমৃত, আষাঢ় ১৩৭১


Edited and Published by Prabuddha Neogi

আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

WBFJA

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *