‘অতটা অ্যাপিল করেনি উত্তমকুমারের অভিনয়’
আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের (Soumitra Chatterjee) দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন স্বপনকুমার ঘোষ। উত্তমকুমার থেকে তখনকার বাংলা ছবির অবস্থা, রাজনীতি সবকিছু নিয়েই অকপটে কথা বলেছিলেন অভিনেতা। WBFJA-এর পাতায় রইল সেই সাক্ষাৎকারের পুনর্মুদ্রণ
সৌমিত্র তখন স্কুলের ছাত্র। তাঁর উকিল দাদুর এক মক্কেল একটা স্যুটকেস ওঁদের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন। বলে গিয়েছিলেন, এর ভিতরে ₹৫০০ আছে। তখন ₹৫০০ অনেক। স্যুটকেস থেকে টাকাটা বার করে পকেটে রাখলেন সৌমিত্র। আর তখনই খেলে গেল বুদ্ধিটা। পাশেই বন্ধুর বাড়ি। তিনি বাড়ির লোককে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়লেন যে সেই টাকা নিয়ে উনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। না বাবা এটা ঠিক নয়, বাবা-মা দুঃখ পাবেন, অন্যের টাকা চুরি করা মহাপাপ, ইত্যাদি উপদেশ চলতেই থাকল।
“এটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না যে আমার অভিনয় তখন কতদূর বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল,” বললেন সৌমিত্র। “তবে পরিষ্কার মনে আছে, ওঁরা আমার বলার ধরনেই হোক, কী কথাতেই, বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। দুম করেই। যেমনভাবে ম্যাজিশিয়ন চমকে দেয় দর্শককে। অনেকটা সেভাবেই অভিনয় করে মিথ্যাকে সত্যি করার প্রবণতা ছিল আমার মধ্যে তখন থেকে। পুরোপুরি মিথ্যে নয়, খানিকটা সত্যের আশ্রয় তো ছিলই। ওই টাকাটা যে আমার কাছে ছিল সেটা তো সত্যি।”
আরও পড়ুন: পরিবেশ-রাজনীতির এক মায়াবী ইস্তাহার
ফরাসি পত্রিকা ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’য় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছিলেন সৌমিত্র। ফ্রান্সে ভারত উৎসবের সময়ে। উৎসবের অঙ্গ হিসাবে আয়োজিত সৌমিত্র রেট্রস্পেকটিভ উপলক্ষেই ওই পত্রিকা নিয়েছিল অভিনেতার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার।
জিজ্ঞাসা করলাম, “প্রতিবেদনে ওই ঘটনাটার এত প্রাধান্য দেওয়া হল কেন?”
সৌমিত্র বললেন, “এতে আমাকে চট করেই অনেক দূর পর্যন্ত বোঝা যায়। এমন একটা অস্থিরতা ছিল, এমন একটা অনিশ্চয়তা ছিল আমার মধ্যে, যার জন্য আমি তখন নিজেকে দেখানোর তাগিদে ঘটনাটা ঘটিয়েছিলাম। এই যে লোভ, আমার ভিতরের চাওয়া বা খিদেকে তা নিশ্চয়ই তৃপ্ত করত। তা না হলে কেন আমি ওসব করতাম?”
কলকাতার চ্যাপলিন প্রেক্ষাগৃহে ‘তিন দশকের সৌমিত্র’ শিরোনামে অভিনেতাকে নিয়ে রেট্রসপেকটিভ হওয়ার কয়েকদিন পরে এক সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র বলেছিলেন, “পাশ্চাত্যে একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর কন্ট্রিবিউশন নিয়ে যেভাবে চলচ্চিত্ররসিকরা তাঁর অভিনয়চর্চায় ইন্টারেস্ট দেখান বা দেখাচ্ছেন, ঠিক সেইভাবে এখানে কখনও হয়নি। সেটা হওয়ার মতো পরিবেশও তৈরি হয়নি। সবে শুরু হল। আমাকে দিয়ে হল বলে আমি নিশ্চয় খুশি। আরও খুশি এই কারণে, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও এ দেশে যে সিরিয়াস মূল্যায়নের পাত্র হতে পারে, সেটা দেখে। দেরিতে হলেও তো হচ্ছে।”
আরও পড়ুন: একটু হলেও ব্যতিক্রমী
প্রশ্ন: তিন দশক ধরে আপনি বাংলা সিনেমার সঙ্গে যুক্ত। একটা চটজলদি পর্যালোচনায় আপনার কি মনে হয় না বাংলা ছবিতে অভিনয়ের মান ক্রমশ নীচের দিকে নেমে আসছে?
সৌমিত্র: দ্রুত নেমে আসছে। এবং এটা দেখছি আমি গত দশ বছর ধরে। এর বেসিক কারণ যে খারাপ ছবি, এতে আমার কোনও সন্দেহ নেই। একটার পর একটা খারাপ ছবি, সেখানে ভালো অভিনয় দেখব, আশা করি কী করে! সেই এক প্রেম, এক ঢিসুম-ঢাসুম, একভাবে কথা বলা, চলছে তো চলছেই। বাংলা ছবির আবার সাহিত্যনির্ভর হওয়া দরকার। সাহিত্যনির্ভর না হলে বৈচিত্র্য আসতে পারে না। বাংলা ছবিকে সাহিত্যের কাছে ফিরে যেতে হবে। বাংলা ছবির উন্নতির এটাই প্রধান শর্ত। একটা সময় দেখা গিয়েছে, উত্তমকুমার ‘অনুপমা’র মতো ছবিতে অভিনয় করছেন। পাশাপাশি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ বা ‘ওরা থাকে ওধারে’র মতো একেবারে হালকা মেজাজের ছবিতেও কাজ করেছেন। তখন চিত্রনাট্যে চরিত্রগুলি এমনভাবে সৃষ্টি করা হতো যে তাতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জীবনবোধ ট্রান্সফার করার সুযোগ ছিল। মেনস্ট্রিম সিনেমাই পৃথিবীর সব দেশে দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি করে। এখানে মেনস্ট্রিম তা পারছে না বলেই নতুন তেমন কেউ আসছে না। আসবে কেন? নতুনদের কি কোনও নিরাপত্তা দিতে পারছে মেনস্ট্রিম সিনেমা? যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ছবির অভিনয়ের ক্ষেত্রে আছেন তাঁদের মধ্যেই বা উল্লেখ করার মতো অভিনয়ের যোগ্য ক’জন অবশিষ্ট আছেন? উত্তমকুমারের মতো এতটা শক্তি নিয়ে ক’বার আর ক’জন হিরো আসবে বা আসে?
প্রশ্ন: উত্তমকুমার কিন্তু একেবারে শূন্য থেকে উঠে এসেছিলেন
সৌমিত্র: এই ধারণাটা ঠিক নয়। ছোটবেলা থেকে তাঁর অভিনয়ের একটা প্যাশন ছিল। তিনি ছোটবেলা থেকে অভিনয় করতেন। অভিনয় করতে ভালোবাসতেন। থিয়েটর-টিয়েটর করে যেভাবে এদেশে অভিনয়ের প্রাথমিক ব্যাকগ্রাউন্ডটা তৈরি হয়, তাঁর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন হয়তো সাংঘাতিক কিছু ছিল না। আমারই বা কতটা আছে? আমরা দু’জনেই বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। উত্তমদা আমারই মতো স্টেজের বড়-বড় অভিনেতার দ্বারা ইন্সপায়ার্ড। আমার অবশ্য সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল ব্যাপক। হলিউডের তখন স্বর্ণযুগ, কী স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে আসছে, সেইসময় উত্তমদা নিয়মিত ওসব ছবি দেখতেন। সিনেমার অ্যাক্টিংটা তিনি বুঝেছেন সেখানেই। তাই উত্তমকুমার ট্রেনিং-বর্জিত বা ব্যাকগ্রাউন্ড-বর্জিত, এটা বলতে আমি রাজি নই। তাছাড়া তাঁর মধ্যে অভিনয়ের খামতিগুলো ভরাবার নানা চ্যানেলও ছিল। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসতেন। নিজে ভালো গান গাইতে পারতেন। আমার যেটা মনে হয়, শেষপর্যন্ত স্টারডম অভিনেতা উত্তমকুমারের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। এতবড় স্টার হয়ে উঠলে তা হতেই পারে। হওয়া স্বাভাবিক। অনেকসময় অনেক ভালো রোল তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন এর জন্যই। যেমন ‘অভিযান’ বা ‘সংসার সীমান্তে’। এই সিদ্ধান্ত অভিনেতা উত্তমকুমারের ক্ষতি করেছে নিঃসন্দেহে।
আরও পড়ুন: অনন্য মায়াময় ফ্রেম তৈরি করে ‘ডিয়ার মা’
প্রশ্ন: তবু, উত্তমকুমার নিশ্চয় অত্যন্ত বড়মাপের অভিনেতা ছিলেন?
সৌমিত্র: (একটু ভেবে) হ্যাঁ।
প্রশ্ন: কিন্তু আপনি সম্প্রতি বলেছেন বলরাজ সাহনি ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ সিনেমা-অভিনেতা
উত্তর: নিশ্চয়ই। আমার কাছে সিনেমার অভিনয়ের আদর্শ হচ্ছেন বলরাজ সাহনি। তাঁর মধ্যে আমি কোনও ম্যানারিজ়ম দেখিনি। একটা চরিত্র থেকে আরেকটা চরিত্রে যেতে পারতেন অক্লেশে, তফাতটুকু বজায় রেখেই। যথার্থ সিনেমার মাপে অভিনয়, বাস্তবানুগ অভিনয় করতেন বলরাজ। তাঁর চেহারার আবেদনও কি কম ছিল? রোমান্টিক রোলেও তিনি সফল। প্রসঙ্গত দুই তুলসির কথা বলতে পারি। তুলসি লাহিড়ি এবং তুলসি চক্রবর্তীর কথা। সিনেমার মাপের অভিনয়ে এঁরা দুজনেই উদাহরণ হতে পারেন। এই আমলের কথা বলতে গেলে নাসিরুদ্দিন শাহর নাম আসে।
প্রশ্ন: উত্তমকুমার?
সৌমিত্র: তুলনাটা ঠিক হয় না। উত্তমকুমারের জঁর হয়তো একটু বদলে যায়। সেই অর্থে রোমান্টিক হিরো হিসাবে তো বলরাজজিকে কাজ করতে দেখা যায়নি। এক নাগাড়ে করে যেতে হলে উত্তমকুমারের মতো অভিনয় ক্ষমতা তাঁর বজায় থাকত কি না সেটা আর একটা পরীক্ষার ব্যাপার। তাহলেও রোমান্টিক অভিনয়ে বলরাজজি যে ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন, সেই সূত্র ধরে বলতে পারি, তাঁর সময়ে এমন পারফেক্ট সিনেমা-অভিনেতা আমি কমই দেখেছি।
আরও পড়ুন: মৃণাল সেনের ছবি থেকে বাদ পড়লেন অমিতাভ বচ্চন
প্রশ্ন: তবু উত্তমকুমার…
সৌমিত্র: সত্যি কথা বলতে কী, অতটা অ্যাপিল করেনি আমাকে উত্তমকুমারের অভিনয়।
নিজের অভিনীত চরিত্র সম্পর্কে একটা বাছাই? সৌমিত্রর লিস্টে আছে দু’ধরনের নাম। আছে ‘অপুর সংসার’, ‘অভিযান’, ‘একটি জীবন’, ‘কোনি’, ‘সংসার সীমান্তে’ এবং ‘শাখা প্রশাখা’।
“‘গণশত্রু’তে অভিনয়ের মান খুব উঁচু ছিল। ‘শাখাপ্রশাখা’র অভিনয় আরও এক ধাপ এগিয়ে,” বললেন সৌমিত্র। এ ছাড়াও রয়েছে আরও কয়েকটি চরিত্র। যেমন ‘দত্তা’র নরেন, ‘চারুলতা’র অমল বা ‘সমাপ্তি’র অপূর্ব।
প্রত্যাশার অভিনয় মেনস্ট্রিম ছবিগুলিতে পাওয়া অসম্ভব। দর্শকের সে প্রত্যাশা পূরণ করে সিরিয়াস গোত্রের ছবি। কিন্তু সেখানেও পরিবেশ অনুকূল না থাকলে তা পাওয়া কি সম্ভব? পরিবেশ বলতে এখানে বিষয়ের কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবানুগ বিষয়, যে বাস্তবের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় রয়েছে সিরিয়াস মনের দর্শকদের। সময়বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।
আরও পড়ুন: সেন্সর বোর্ডের মৌখিক আপত্তি, আটকে গেল ‘কাল্পনিক’
স্বীকার করেন সৌমিত্র। বললেন, “কবিতাকে যেমন বলা হয় ইমোশন রিকলেক্টেড ইন ট্র্যাঙ্কুইলিটি, তেমন সিনেমাতেও সময় রিকলেক্টেড হওয়া দরকার। হয়ও। ‘একটি জীবন’ এর উদাহরণ হতে পারে। ছবিটার কাজ ১৯৮২ সালে শুরু হয়। ছবিতে তখনকার বাস্তব পরিস্থিতি চিত্রনাট্যে উঠে আসেনি, আসার কোনও কারণও ছিল না। কিন্তু ছবির বিষয় কি বর্তমান সময় সম্পর্কেও একটা সচেতনতাকে জাগ্রত করে না? আমার চারপাশে যা ঘটছে তক্ষুণি-তক্ষুণি ছবিতে তার প্রতিফলন কমই ঘটে। সেটাও ঘটে, ঘটেছে আমার ক্ষেত্রে। একে আমার পরম সৌভাগ্যই বলব। ‘শাখা প্রশাখা’য় একরকমভাবে সত্যজিৎ রায় সাম্প্রতিক সময় তুলে ধরেছেন। মৃণাল সেন নতুন যে ছবিটা তৈরি করতে চলেছেন (চিত্রনাট্য শোনার ভিত্তিতেই বলছি) সেখানেও রয়েছে এই সময়কে তুলে ধরার আন্তরিক প্রচেষ্টা।”
সমাজ ও রাজনীতিসচেতন শিল্পী সৌমিত্র। বামপন্থী রাজনীতিতে আগ্রহও দেখা গিয়েছে তাঁর। যদিও এই মুহূর্তে তিনি খানিকটা নির্লিপ্ত। চারপাশে যা ঘটছে তা নিয়ে কোনও মন্তব্যও শোনা যায় না তাঁর মুখে। একজন সমাজ ও রাজনীতি সচেতন শিল্পী হিসাবে তিনি কি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন?
তাঁর কথায়, “একা কিছু করা যায় না। একটা পার্টি বা দলের দরকার। আজ এখানে সেরকম কোনও পার্টি বা দল নেই যাঁরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কথা না ভেবে, মানুষের সত্যিকারের অভিযোগগুলি বিবেচনা করবে। আমি এখন কোনও পার্টির ওপর আস্থা রাখতে পারি না যাঁদের আহ্বানে মানুষের পাশে দিয়ে দাঁড়াতে পারি। সেভাবে তাঁরা তো আমাদের ডাকেনও না। যাঁরা ডাকেন তাঁরা স্বার্থসিদ্ধির জন্যই ডাকেন। যাঁরা আজ সরকারের বিরুদ্ধে বলছেন তাঁরা যখন সরকারে ছিলেন, কী করেছেন। কাকে বিশ্বাস করি!”
প্রথম প্রকাশ: আনন্দবাজার পত্রিকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯০
Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন





