জাতীয় সঙ্কটে বাংলা ছবি, উদ্বিগ্ন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা
স্টুডিয়ো সংবাদদাতা: ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান সঙ্কটকে কেন্দ্র করে সাহিত্যিকদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এই অভিমত জ্ঞাপন করা হয় যে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্পের অবস্থা একটি জাতীয় সঙ্কট। কারণস্বরূপ বলা হয়, যেহেতু বাংলা চলচ্চিত্র বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেহেতু চলচ্চিত্রের সঙ্কটকে বাংলার সাহিত্যিকবৃন্দের সঙ্গে আপামর জনসাধারণও জাতীয় সঙ্কট বলে মনে করতে বাধ্য।
সভাপতি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (Tarasankar Bandyopadhyay) তাঁর ভাষণে এই মহৎ শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গুরুতর আশঙ্কা প্রকাশ করেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, চলচ্চিত্রের সঙ্গে সাহিত্যিকদের শুধু যে আর্থিক সম্পর্ক আছে তাই নয়, তার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্কটিও অটুটভাবে গড়ে উঠেছে। মনোজ বসু পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি চিত্রগৃহে বাংলা ছবি আবশ্যিকভাবে দেখানোর দাবি তোলেন। যেখানে শতকরা তিরিশ ভাগের কম বাঙালির বাস, সেই অঞ্চলের চিত্রগৃহেও বাংলা ছবি দেখাতে হবে, অবাঙালিকে বাংলা শেখানোর জন্য। অশালীন হিন্দি ছবির ন্যাক্করজনক প্রভাব থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতেই হবে বলে দাবি করেন তিনি।
আরও পড়ুন: আর্ট ফিল্ম মানে শুধুই যৌনতার ছড়াছড়ি, ক্ষুব্ধ ঋত্বিক
এছাড়া সভায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, সন্তোষকুমার ঘোষ, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা এবং চলচ্চিত্র শিল্পের পক্ষ থেকে অজিত বসু, অসিত চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, পূর্ণেন্দু পত্রী, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সরোজ দে ও বিজয় চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা দেন।
সভায় চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। (১) সকল চিত্রগৃহে বাংলা ছবির প্রদর্শনী আবশ্যিক করতে হবে; (২) বাংলা ছবির নির্মাণে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে উপযুক্তভাবে সহযোগিতা ও সাহায্যদান করতে হবে; (৩) পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক শিল্পসম্মত বাংলা ছবির প্রদর্শনীর জন্য রাজ্যে আর্ট থিয়েটার গঠন করতে হবে; এবং (৪) বাংলা ছবির প্রদর্শনীকে ব্যাপক করবার জন্য চিত্রগৃহের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
আরও পড়ুন: ‘এত নিষ্ঠুর, কৃপণ হবে ভাবিনি’
পশ্চিমবঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রে যে দুর্যোগ উপস্থিত হয়েছে, তা সত্যই জাতীয় সঙ্কট এবং যে কোনও চিন্তাশীল ব্যক্তিকেই তা ভাবিত করবে। নির্বাক যুগ অবসানের পরে ১৯৩০ সালে যখন বাংলা দেশে চলচ্চিত্রের সবাক যুগের সমাগম হলো, তখন দর্শক বাংলা ছবি দেখবার জন্যই কাতারে-কাতারে ভিড় জমাত। বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বই) ছবি দেখবার জন্যে তাকে কিছুমাত্র উৎসাহিত হতে দেখা যায়নি। এমনকী ইম্পিরিয়াল সিনেমার ‘তুফান মেল’ কলকাতার অবাঙালি যুবকদের মধ্যে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করলেও বাঙালি দর্শক এ ছবি সম্পর্কে নির্বিকারই ছিল।
আরও পড়ুন: হিরোইন অভাবগ্রস্ত টালিগঞ্জে ফিরছেন মঞ্জুলা বন্দ্যোপাধ্যায়
হিন্দি ছবির প্রতি বাঙালি প্রথম ঝোঁকে যখন ‘অচ্ছ্যুৎ কন্যা’ প্যারাডাইজ় সিনেমায় প্রদর্শিত হয়। কিন্তু তাও হিসাব নিলে দেখা যাবে সে ছবির সমগ্র দর্শকসংখ্যার শতকরা দশভাগও বাঙালি ছিল কিনা সন্দেহ। এর পরে বোম্বে টকিজ়েরই ‘বন্ধন’, ‘কলান’, ‘ঝুলা’, ‘বসন্ত’, ‘কিসমৎ’ এবং প্রভাত সিনেটোনের ‘অমৃত মন্থন’, ‘অমর জ্যোতি’, ‘দুনিয়া না মানে’, ‘আদমি’, ‘পড়োসি’, সোহরাব মোদীর ‘রোটী’, ‘জেলার’, ‘ঝাঁসী কী রাণী’, মেহবুবের ‘আওয়াৎ’, রঞ্জিতের ‘পরদেশী’ ও ‘মুসাফির’-এর মতো ছবি কিছু-কিছু বাঙালি দর্শককে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল কাহিনি, অভিনয়, গান ও শিল্পচাতুর্যের দ্বারা। কিন্তু বাঙালি দর্শক বাংলা ছবি দেখে যে পরিমাণ পরিতৃপ্তি লাভ করত, খটমট হিন্দি ভাষার থেকে তার চতুর্থাংশেরও তৃপ্তিলাভে সমর্থ হতো না। তাই শহর কলকাতার বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলের চিত্রগৃহের মালিকেরা কোনওদিনই হিন্দি ছবি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করার কথা মনের কোণেও স্থান দিতেন না। হিন্দি ছবি দেখানো হতো অবাঙালি অঞ্চলের চিত্রগৃহগুলিতে এবং বাংলা দেশের অবাঙালি অধ্যুষিত শিল্পাঞ্চলগুলিতে।
আরও পড়ুন: ‘টাকা চেয়ে বসলেন বাবা’
কিন্তু ক্রমে অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগল। চিত্র পরিবেশনের ব্যবসা স্ফীত হয়ে উঠল এবং মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল কাহিনিকে সম্বল করে ভুরিভুরি হিন্দি ছবির নির্মাণ শুরু হলো। সেই সব ছবির বহুল প্রচারের জন্য লাভজনক শর্ত চিত্রগৃহের মালিকদের প্রলুব্ধ করতে লাগল। শুধু শহরের বাঙালিপ্রধান অঞ্চলগুলিতেই নয়, বাংলার সুদূর পল্লী এলাকাতেও যৌনধর্মী নৃত্যগীতসম্বলিত হিন্দি ছবির প্রদর্শনী শুরু হয়ে গেল। নিম্নশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত নরনারী ক্রমেই হিন্দি ছবির কড়া মদের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এই সর্বনেশে নেশা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল বাঙালি দর্শকের সকল স্তরে। বাঙালির রুচি গেল পাল্টে, তা নেমে গেল যৌনবিকৃতির সর্বনাশা পথে, জাহান্নমের পানে।
এখন বাঙালির কাছে বাংলা ছবি লাগে জোলো, বিস্বাদ, নিরামিষের মতো। বাঙালির রুচি ও সংস্কৃতির এমন সুপরিকল্পিত অপমৃত্যু ঘটানোর প্রয়াস জীবনের অপর কোনও ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি। এই সর্বনাশা অবস্থা সম্পর্কে আত্মসচেতন হওয়ার দিন আজ সমাগত।
এই জাতীয় সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতেই হবে এবং এ ব্যাপারে জনসাধারণের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সর্বপ্রকারে সহযোগিতা করতেই হবে।
প্রথম প্রকাশ: অমৃত, জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৫
Edited and Published by Prabuddha Neogi
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করুন

